somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভারতবর্ষের পথে

০৫ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৭:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এডওয়ার্ড সাইদের ওরিয়েন্টালিজম যদি হয় মধ্যপ্রাচ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের দলিল, তাহলে ফরস্টারের এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া -কে ভারত উপমহাদেশে সেই একই শাসনের প্রামাণ্য চিত্র বললে খুব একটা ভুল হবে বলে মনে হয়না, যেটুকু পার্থক্য তা দৃষ্টিভঙ্গি ও উপস্থাপনায়। আর একটি ছোট পার্থক্য হল মধ্যপ্রাচ্য ও ভারত উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শক্তির ভিন্নতা, যদিও বস্তুত উভয় শক্তিই একই মায়ের পেটের যমজ সন্তান। উভয়েরই জন্মস্থান ইউরোপ। সমবয়সী বোনের মত বখরা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স খেলনা হিসেবে বেছে নেয় আফ্রিকা, এশিয়া ও আমেরিকাকে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকা এই দুই দেশ নিজেরদের মধ্যকার জাতিগত বিরোধ নিষ্পন্ন করার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে ভিন্ন মহাদেশে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। আর সেই লড়াইয়ে বলির পাঁঠা হয় এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার নিরীহ অধিবাসীরা।
খ্রীষ্টের জন্মের আগ থেকেই ভারত উপমহাদেশের সাথে ইউরোপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, আর তা ছিল স্থলপথে। মধ্য এশিয়ার অধিবাসীদের অর্ন্তকলহ এবং মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের মধ্যকার লাগাতার যুদ্ধের কারণে এক সময় সেই লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৪৯৮ খ্রীষ্টাব্দে পর্তুগীজ ক্যাপ্টেন ভাস্কো-ডা-গামা ভারতের বর্তমান কেরালাতে নোঙ্গর করেন। কেরালার তৎকালিন রাজা ভাস্কো-ডা-গামাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান এবং পর্তুগালের সাথে কেরালার নিয়মিত লেনদেনে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে রাণী এলিজাবেথের আশীর্বাদে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ নামে একটি কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দে এই কোম্পানী ভারতের তৎকালিন সুরাতে নোঙ্গর ফেলে। ১৬৬৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজা চতুর্দশ লুইয়ের অধীনে ফ্রান্স ‘ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠা করে এবং ভারতে ইংল্যান্ডের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিযোগীতার ভিত্তি স্থাপন করে। সম্রাট আকবর ও সম্রাট শাহ জাহানের সময় ভারতের সাথে ইউরোপীয়দের বাণিজ্যিক ও রাজনোইতিক সম্পর্ক শান্তিপূর্ণ ছিল। ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দএ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স আবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দক্ষিণ ভারতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স কর্ণাটকের নবাব আনওয়ারুদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতায় বাণিজ্য করছিল। আনওয়ারুদ্দিন কর্ণাটকের মাটিতে তাদের যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে বলেন। কিন্তু ফরাসি গভর্নর ডুপ্লেই ৪০০০ ভারতীয় সিপাহী নিয়ে ইংরেজদের বানিজ্যিক ঘাঁটি মাদ্রাজ আক্রমণ করে। এরপর ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে দুই দেশের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়।
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ভারতে বাণিজ্য করতেই এসেছিল। ভারতে তাদের প্রভাব সেই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকত যদি না ভারতীয় শাসকেরা তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য এই বিদেশীদের দ্বারগ্রস্থ হত। ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে নাজিম উদ্দীনের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে নাজির জং সিংহাসনে অভিষ্ঠিত হয়। নিজাম উদ্দীনের ভাইপো মুজাফফর জং নাজির জংকে উচ্ছেদ করে সিংহাসন লাভের আশায় ফরাসিদের সাহায্য কামনা করে। অন্যদিকে, মুহাম্মদ আলি আনওয়ারুদ্দিনকে সরিয়ে কর্ণাটক দখল করার জন্য ফরাসিদের দ্বারগ্রস্থ হয়। ডুপ্লেই নিজাম জং ও আনওয়ারুদ্দিন উভয়কেই পরাজিত করে এবং নিজেকে কর্ণাটকের গভর্নর ঘোষণা করে। মোহাম্মদ আলি এরপর ব্রিটিশদের দ্বারগ্রস্থ হয়। কোম্পানী ক্লাইভের নেতৃত্বে একদল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে। ১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দে বিখ্যাত আর্কট-এর যুদ্ধে ব্রিটিশরা ফরাসিদের পরাজিত করে। এরপর ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স আবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ সময় বাংলার শাসক ছিল আলীবর্দি খানের নাতি সিরাজ-উদ-দৌলা। আলীবর্দি খানের শাসনামলে ইংরেজদের সাথে বাংলার বাণিজ্য অটুট ছিল। সিরাজ-উদ-দৌলা সিংহাসনে বসেই ইংরেজদের সাথে কলহে লিপ্ত হয়। সিরাজ ইংরেজদের কলকাতার ঘাঁটি ছাড়তে বাধ্য করে। এ খবর ইংল্যান্ডে পৌঁছালে ইংল্যান্ড কর্ণেল ক্লাইভের নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে। অবস্থা বুঝে সিরাজ ইংরেজদের সাথে সমঝোতা করে, কিন্তু একই সাথে ফরাসিদের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠায়। ইংরেজরা সিরাজের অভিসন্ধি উপলব্ধি করে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করে। ইংরেজদের সাথে এই বিরোধের কারণেই পলাশীতে বাংলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়।
সিরাজের পর ইংরেজরা মীর জাফরকে বাংলার গদিতে বসায়। বাংলার কর্তৃত্ব নেওয়ার পর মীর জাফর ইংরেজদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করলে ইংরেজরা তার জামাই মীর কাসিমকে তার স্থলাভিষিক্ত করে। পরে মীর কাসিম ইংরেজদের তাড়ানোর আশায় মুঘল সম্রাট সুজার সাহায্য কামনা করে। এরপর বক্সারের যুদ্ধে সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ভারতের অন্যান্য স্বাধীন রাজারাও ভারত থেকে ব্রিটিশ উৎক্ষেত করতে সবসময়ই সক্রিয় ছিল। বড় শাসকদের মধ্যে ছিল- পাঁচ মারাঠা প্রধান, নিজাম ও টিপু সুলতান। এসময় নেপোলিয়ান ফ্রান্সের শাসকের পদ গ্রহণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং উপনিবেশিক প্রতিযোগিতায় ইংরেজদের টেক্কা দেওয়ার জন্য ইউরোপ থেকে ভারতের অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ভারতের পথে নেপোলিয়ান মিশর পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। টিপু সুলতান নেপোলিয়ানের কাছে সাহায্য প্রার্থণা করলে নেপোলিয়ান টিপু সুলতানকে কিছু সৈন্য প্রেরণ করে। ইংরেজরা টিপুর কাছে তার সেনাবাহিনী থেকে ফরাসিদের অপসারণ দাবি করে। টিপু তা নাকচ করে দিলে তারা বোম্বে ও মাদ্রাজ থেকে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে। যুদ্ধে টিপু নিহত হয়।
টিপু সুলতানকে ভারতের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়। টিপু সুলতানের পর ভারতে যে সম্মিলিত স্বাধীনতা আন্দোলন হয় তাকে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করে। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে দুই ব্রিটিশ রেজিমেন্টের ভারতীয় সিপাহীদের আরম্ভ করা এই বিদ্রোহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মুঘল সম্রাট শাহ আলমের পুত্র বাহাদুর শাহ নিজেকে ভারতের অধিপতি ঘোষণা করে। স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের কিছু রাজা ছাড়া অনেকেই অংশগ্রহণ করে- অউদের তালুকদারেরা, কানপুরের নানাসাহেব, ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঁই তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ সৈন্যদের হাতে দিল্লীর পতনের পর স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাঁটা পড়ে।
১৮৫৭-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতের জন্য নতুন বিল পাশ হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়া সমগ্র ভারতবর্ষের সম্রাজ্ঞী হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। ভিক্টোরিয়া একটি ঘোষণাপত্র জারি করে স্বাধীনতা আন্দোলনের সকল বিদ্রোহীর জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ভিক্টোরিয়া তার শাসনামলে ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যান। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে সপ্তম এডওয়ার্ড সিংহাসনে বসেন। ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন পঞ্চম জর্জ। ফরস্টারের এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া এ সময়েরই গল্প।
ফরস্টার যখন প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া লেখেন তখন ভারতে ব্রিটিশ শাসন ক্রান্তিকালে এসে ঠেকেছে। সমগ্র ইউরোপে তখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় ভারতে ব্রিটিশ রাজ নাজুক হতে শুরু করে। একই সময়ে ইংল্যান্ডের নিজের ঘরে আগুন লাগে। আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। একই সাথে ভারতের শিক্ষিত শ্রেণী স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করে।
আমাদের গল্প ভারতের চন্দ্রপুর জেলায়। এক আকাশ ভাগাভাগি করা ছাড়া চন্দ্রপুরের ভারতীয় অধিবাসী ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে আর কোনোই মিল নেই। উপন্যাসের শুরুতেই শাসক ও শোষিতের মধ্যে একটি পরিষ্কার সীমারেখা টেনে ফরস্টার তার গল্প শুরু করেন। পরিবেশগত পার্থক্য দেখানোর পর ঔপন্যাসিক চন্দ্রপুরে জাতিগত পার্থক্য, তার মাত্রা ও প্রভাব- এগুলো ব্যাপারে আলোকপাত করতে থাকেন। ভিক্টোরিয়া উত্তর ব্রিটিশ শাসনামলের সমালোচনা করতে ফরস্টার বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি। উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়েই মুসলিম চরিত্রদের কথোপকথনে তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। সাম্রাজ্যের প্রজাদের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের অবজ্ঞা, জাতিগত বিদ্বেষ,অনৈতিক আচরণ উপন্যাসের বিভিন্ন জায়গায় তুলে ধরতে ফরস্টার সব সময়ই উদার ছিলেন। ইংরেজদের এই আচরণের ব্যাখ্যা দিতে যেয়ে জর্জ অরওয়েল তার “Shooting an Elephant” প্রবন্ধে বলেন, “ সাদা মানুষ যখন স্বৈরাচার হয় সে তখন তার নিজের স্বাধীনতাকেই ধ্বংস করে। সে একজন ফাঁকা, কৃত্রিম, গতানুগতিক সাহেব প্রতিমূর্তিতে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতিতে সারা জীবন সে তাই করবে যা একজন আদিবাসী তার কাছ থেকে যা আশা করে”। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ড. আজিজ যখন তার বন্ধুদের সাথে খেতে বসে তখন তার উপরওয়ালা মেজর ক্যালেন্ডার তাকে তার বাংলোয় ডেকে পাঠায়। যদিও তখন ড. আজিজের সাথে তার কি প্রয়োজন ছিল তা জানা যায়না, কিন্তু তা যে পেশাগত না তা বুঝতে ভুল হবার কথা নয়। ড. আজিজ মেজর ক্যালেন্ডারের বাংলোয় পৌছে দেখে মেজর ক্যালেন্ডার ততক্ষণে বের হয়ে গেছে। বন্ধুদের ত্যাগ করার পূর্বে আজিজ তার বন্ধুদের বলে যে মেজর ক্যালেন্ডার তাদের রাতের খাবারের সময়টা জেনে গেছে, তাই তার ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়নি।
ভারতের প্রতি ব্রিটিশদের আচরণ ছিল স্বৈরাচারী, খেয়ালী ভগবানসুলভ। এই আচরণের কোনো রাখ ঢাক তারা করে নি। মিসেস মুর তার ছেলের কাছে তার পরিবর্তিত স্বভাবের কথা জানতে চাইলে রনি খুব সোজা সাপটাভাবেই বলে যে ভারতে ইংরেজরা ভগবানতুল্য। মেজর ক্যালেন্ডারের ক্ষমতা প্রয়োগের প্রবণতা জিউসের খামখেয়ালিপনারই ভিন্ন রূপ। ভারতীয়দের সাথে সিটি ম্যাজিস্ট্রেট রনি হিসলপের আচরণ সোজা ভাষায় স্বেচ্ছাচারিতা। ফিল্ডিঙের বাসভবনে আজিজ ও গোডবোলের প্রতি অবজ্ঞা, নবাব বাহাদুরকে তাচ্ছিল্য- এসব আচরণে সে সব সময়ই প্রমাণ করতে চায় যে সে তাদের শাসক ও তারা তার প্রজা। রনির এ আচরণের ব্যাখ্যা দিতে যেয়ে আলবার্ট মেমি বলেন যে, ভারতে প্রধান তিন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইংরেজরাই সবচেয়ে সখ্যালঘু। উপনিবেশগুলোতে উপনিবেশিকদের সংখ্যা সব সময়ই কম। এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদের অবস্থানকে ভিন্ন ও অক্ষুন্ন রাখতে স্বৈরাচারকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। উপন্যাসের শুরুতে চন্দ্রপুরের ভারতীয় ও ইংরেজদের বাসভবনের বর্ণনা সেই পার্থক্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। স্তরে স্তরে সাজানো ব্রিটিশ এলাকা ভারতীয়দের থেকে উঁচু স্থানে অবস্থিত। সৈয়দ মুজতবা আলী তার উপন্যাস অবিশ্বাস্য-এ ও একই রকম পার্থক্যের কথা বলেছেন। তার উপন্যাসের স্থান মধুগঞ্জ। শহর থেকে বিশ মাইল দূরে ষ্টেশনের কাছে চা-বাগান পরিবেষ্টিত বিলিতি ক্লাব। চা বাগান বাদ দিলে মোটামুটি আর সব কিছুই চন্দ্রপুরের সাথে মিলে যায়। নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী সব সময় বসতি গড়ে সাধারণ জন বসতি থেকে দূরে, অথবা নিজেরদের কর্তৃত্ব আরো নগ্নভাবে জাহির করতে সমতল থেকে উপরে।
ব্রিটিশ উন্নাসিকতার আরো অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় উপন্যাসে। মিসেস মুর ব্রিজ পার্টিতে ভারতীয় অতিথিদের ব্যাপারে জানার ইচ্ছা পোষন করলে তাকে বলা হয় যে তার ভারতীয়দের সাথে সামাজিকভাবে পরিচিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ মিসেস মুরের সামাজিক মর্যাদা তাদের চেয়ে অনেক উপরে, দু’এক জন রাণী বাদে। আজিজের বিচার চলার সময় মোহাম্মদ আলী ইংরেজদের জন্য বিশেষ আসন ব্যবস্থার ব্যাপারে প্রতিবাদ জানালে তা ইংরেজদের আত্ম অহমিকায় আঘাত হানে। উপন্যাসটি প্রকাশের প্রায় পয়ষট্টি বছর পূর্বে সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া ধর্ম, বর্ণ, জাত নির্বিশেষে ভারতবর্ষের সকলের জন্য সমান আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। পঁয়ষট্টি বছর পরেও সেই আইনের যথার্থ প্রণয়ন হয়নি।
মেমি বলেন, “ভদ্র ও লাজুক অভিবাসীরা যারা প্রথম কোন উপনিবেশে পা রাখে তাদেরকে চটকদার কিছু পদবী দেওয়া হয় যার চমকে তারা অন্ধ হয়ে যায়”। মেমির মতে, ইউরোপ থেকে পাঠানো শাসকদের হৃদয় আগে থেকেই পঁচে যাওয়া নয়। টার্টনদের সম্পর্কে বলতে যেয়ে হামিদুল্লাহ্‌ বলে যে, “তোমরা হয়ত বিশ্বাস করবে না কিন্তু আমি একসময় টার্টনদের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চেপেছি- টার্টন! সত্যি, আমরা খুবই অন্তরঙ্গ ছিলাম। এমনকি সে আমাকে তার ডাকটিকিটের সগ্রহও দেখিয়েছে”। মেমির কথার প্রসঙ্গে হামিদুল্লাহ্‌ বলে, “তারা এখানে ভদ্রলোক হয়েই আসে, কিন্তু পরে তাদের সেটা হওয়া থেকে বিরত করা হয়”। মেমির উক্তি সবচেয়ে বেশী খাটে “লাল নাক” সাহেব রনির ক্ষেত্রে। ইংল্যান্ডে ভদ্র, মার্জিত স্বভাবের রনি ভারতে এসে স্বৈরাচার ও হিপোক্রিটে পরিণত হয়, যেন আরেক কার্টজ্‌। ফরস্টারের রনি কনরাডের কার্টজের ভারত উপমহাদেশীয় রূপে পরিণত হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য অবিরাম খেটে যাওয়া একজন ব্যুরোক্র্যাট, যার ধর্মও ইংল্যান্ডের জাতীয় সঙ্গীতের সাথে একাত্মা। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজ ধরে রাখা ও ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই তার একমাত্র লক্ষ্য, এজন্য যদি নিষ্ঠুর হতে হয় তবে তাই সই। তার মতে ভারত ‘ড্রইং রুম’ নয়, সহানুভূতি দেখানোর চেয়ে মহান মিশনে সে ভারতে এসেছে। অথচ, ভারতীয়রা শুধু একটু সহানুভূতিই চেয়েছে। ফিল্ডিংকে আজিজ বলে, “একটু সহানুভূতি, আরেকটু সহানুভুতি…” এই সহানুভূতির অভাবই ভারতকে ব্রিটিশ বিরোধী করে তুলে। এরপর তারা আর সহানুভূতি চায় না, ব্রিটিশদের উৎখাত চায়। রনির আচরণে ক্ষুব্ধ মিসেস মুর ভাবেন, “একটু অনুশোচনার ছোঁয়া, তাহলেই ব্রিটিশ শাসন অন্যরকম প্রতিষ্ঠান হতে পারত”।
রনি যে মহান মিশনের দোহাই দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের ন্যয্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তা হল ভারত উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা। ভারত উপমহাদেশে জাতিগত বিভেদ অনেক আগে থেকেই। বিভিন্ন রাজা কর্তৃক উপমহাদেশের রাজনৈতিক ডামাডোলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইংরেজরা তা চাক্ষুসভাবে দেখে। সুতরাং প্রথম থেকেই তাদের ধারণা ছিল যে তা এখনো চলমান। কিন্তু ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের স্বাধীনতা আন্দোলন তা বদলে দেয় সেটা তারা আর উপলব্ধি করতে পারে না। জাত, ধর্ম ভুলে সবাই যে একসাথে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার তা তাদের চোখে পড়ে না। উপন্যাসে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ খুবই স্পষ্ট। সকলেই ভারতীয় বটে, কিন্তু সকলেই নিজ নিজ ধর্মের গন্ডীতে আটক। আজিজ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার হিন্দু সহকর্মী পান্না লাল তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আজিজের বাড়িতে হানা দেয়। আজিজের মুসলিম বন্ধুরা এই বলে একমত পোষন করে যে হিন্দুরাই সকল রোগের মূল। অমৃত রাও আজিজের পক্ষে ওকালতি করলেও তারা একে অপরের প্রতি খুব একটা হৃদ্যতা প্রদর্শন করে না। কিন্তু ভারতের মাটি তাদের এক করতে না পারলেও ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভারতীয়কে এক সুঁতোয় গাঁথতে সক্ষম হয়। উপন্যাসের এক জায়গায় ফরস্টার বলেন, “যতক্ষণ সবাই ইংরেজদের গাল দিচ্ছে ততক্ষণ সব ঠিক আছে, যদিও গঠনমূলক কিছুই করা হয়নি, ইংরেজদের যদি ভারত ছাড়তে হয় তবে এই সভাও বিলুপ্ত হবে”।
ইংরেজদের প্রতি এই ঘৃণাই চন্দ্রপুরের সকল হিন্দু-মুসলিমকে টার্টন, ম্যাকব্রাইড, হিস্‌লপ সাহেবদের বিরুদ্ধে এক করে তুলেছিল। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে খিলাফত আন্দোলনেও এই ঘৃণা মুসলিমদের সাথে হিন্দুদেরকে অংশগ্রহণে উৎসাহী করে তোলে।
মেমি বলেন, “ঔপনিবেশিকরা দাবি করে যে তারা উপনিবেশের লজ্জাজনক অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বালানোর মিশনে ব্রত”। চন্দ্রপুরের সিটি ম্যাজিস্ট্রেট রনিও মেমির সাথে একমত, “আমরা এখানে ন্যায় বিচার ও শান্তি রক্ষা করতে এসেছি”। শুধু ভারত উপমহাদেশেই নয়, ইউরোপীয়রা তাদের অসভ্যদের সভ্যকরণ মিশনে আধুনিক সমরাস্ত্র ও পশুর মন নিয়ে হানা দিয়েছে আফ্রিকা, আমেরিকা ও এশিয়ার আরো অনেক অঞ্চলে । শান্তি প্রতিষ্ঠাই যদি হয় ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য তবে এটা বলতেই হয় যে তারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতেই বেশী আগ্রহী ছিল। যে সময় ভারতে তারা অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন ঠেকাতে ব্যস্ত তখন তাদের গ্রেট ব্রিটেনের একাংশ আয়ারল্যান্ড স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের ঘোষণা দেয়। সেই সময়ই ব্রিটেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তিন দিক থেকে কোণঠাসা ব্রিটেন তখন ভারত থেকে তাদের তল্পি গোছাতে শুরু করে। ব্রিটেন উপলব্ধি করতে পারে যে আরেকটি ধাক্কা, তারপর ব্রিটিশ রাজ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়বে। ফরস্টার খুব ভালভাবেই তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই উপন্যাসের শেষে আজিজ ফিল্ডিংকে বলে, “পরবর্তী ইউরোপীয় যুদ্ধ...ওটাই হবে আমাদের সময়”।
এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া-এর মূল বিষয় হল উপনিবেশে উপনিবেশিক ও উপনিবেশিতদের মধ্যে বন্ধুত্ব সম্ভব কিনা। উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়েই ভারতীয় চরিত্রগুলো এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছে। আলোচনায় দেখা গেছে ভারতীয় ও ব্রিটিশদের মধ্যে সম্পর্ক সম্ভব শুধু ইংল্যান্ডেই, যেখানে ইংরেজরা তাদের স্বভাবসুলভ ভদ্রতা বজায় রাখে। উপমহাদেশে তাদের সে আচরণ কর্পূরের মত উবে যায়। হামিদুল্লাহ্‌ বলে, “দুই বছর, তারপরই যে কোনো ইংরেজ ভদ্রলোক টার্টন বা বার্টনে পরিণত হবে”। মেমির মত হামিদুল্লাহ্‌ও স্বীকার করে যে এটা তাদের দোষ নয়, সাম্রাজ্যবাদ নীতিই এর জন্য দায়ী। তবে ইংরেজ পুরুষদের চেয়ে মহিলারা আরেক কাঠি উপরে। হামিদুল্লাহ্‌ তাদের মাত্র ছয় মাস দিতে রাজি আছে অভদ্র উন্নাসিক হওয়ার জন্য। ইউরোপে ব্রিটিশ মহিলাদের সবচেয়ে মার্জিত বলা হয়ে থাকে। ভারতে আসার পথে তারা সেই বিশেষণ ভারত মহাসাগরে বিসর্জন দিয়ে আসে। রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে ইংল্যান্ড বার্মা দখল করলে রাণী নিজে সেখানে অসুস্থ বার্মিজদের সাহায্যের জন্য মহিলা নার্স প্রেরণ করেন। চন্দ্রপুরের প্রাক্তন ব্রিটিশ নার্স মিসেস ক্যালেন্ডারের মতে, “একজন ভারতীয়ের প্রতি দয়া দেখানোর সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে তাকে মরতে দেয়া”। সম্মানের ভিখারি ব্রিটিশ মহিলারা মনে করেন যে ভারতীয়রা কারো সাথে বেশী দেখা হলে তাকে আর সম্মান করে না। ভারতীয়দের সাথে দুরত্ব কমানোর জন্য যে ব্রীজ পার্টির আয়োজন তারা করে তা নিতান্তই প্রহসন। অতিথিপরায়ণতাকে তারা কাজ বলে গণ্য করে, অথচ ইউরোপে ব্রিটিশরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা তাদের উন্নাসিকতার কারণেই ব্যর্থ হয়। ভারতীয়দের নিমন্ত্রণ করে তাদের টেনিস কোর্টের একপাশে ফেলে রাখা যথার্থই তাদের বিখ্যাত অতিথিপরায়নতার জ্বলজ্বলে উদাহরণ। ব্রিটিশদের তুলনায় আজিজ অনেক বেশী অতিথিপরায়ণতার পরিচয় দেয়। তার মারাবার পিকনিক সফল হয়িনি বটে, কিন্তু অতিথিদের সুবিধা ও আনন্দ নিশ্চিত করতে সে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেনি। তার বিদেশী অতিথিরা মদ্যপান করবে, কিন্তু তার ধর্ম তাকে তা নিষেধ করে, ব্রাহ্মণ গোডবোলে মুসলিমদের হাতের খাবার খাবে না, গরু খাবে না- এরকম ছোট-বড় অনেক ব্যাপার মাথায় রেখে সে পিকনিকের আয়োজন করে। ঘুম থেকে উঠতে যাতে দেরী না হয় তাই সে ষ্টেশনেই রাত কাটায়। আজিজের এরূপ অতিথিপরায়ণতাকে ফরস্টার কিছু মাত্রায় বাহুল্য বলেছেন। তিনি এটা ভুলে গিয়েছিলেন যে ভারতীয়রা ইংরেজদেরকে ভগবান মনে করে না, কিন্তু অতিথি মাত্রই ভগবানস্বরূপ।
১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে রাণী ভিক্টোরিয়া ভারত উপমহাদেশে সকলের জন্য সমান আইন জারি করে এটা তো আগেই বলা হয়েছে। এমনকি প্রশাসনের সকল পদে ভারতীয় ও ইংরেজদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ‘ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট’-এ ও সংশোধন করা হয়। পূর্বে যেখানে উঁচু পদগুলো ব্রিটিশদের জন্য সংরক্ষিত ছিল সেগুলো শিক্ষিত, যোগ্য ভারতীয়দের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই সংশোধনী করা হয় ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের স্বাধীনতা আন্দোলনকে মাথায় রেখে। আগে শুধু বাদ্যযন্ত্র বাজানোর জন্য ভারতীয়দের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হত। পরে ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে বিখ্যাত গুর্খা রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়, এবং প্রশাসনিক কর্মকান্ড তদারকি করার জন্যও ভারতীয়দের সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশাসনে সেই সংশোধনী আক্ষরিকভাবে কার্যকর হয় ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে যখন এস.পি. সিনহা ভাইসরয়ের নির্বাহী দপ্তরের সদস্য হন। চন্দ্রপুরেও প্রশাসনিক পদগুলো ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে ভাগ করা। মেজর ক্যালেন্ডার ও ড. আজিজ দুইজনই ডাক্তার, কিন্তু আজিজ ক্যালেন্ডারের অধীনস্ত; রনি ও হামিদুল্লাহ্‌ উভয়েই কোর্টে কাজ করে, কিন্তু রনি হামিদুল্লাহ্‌কে গালাগাল করার ক্ষমতা রাখে।
সামাজিক বৈষম্য আরো মাত্রা ছাড়ায় যখন তা দাপ্তরিক কেতাদুরস্তিতে এসে ঠেকে। আজিজের কলারহীন পোশাককে রনি এমনভাবেই সমালোচনা করে যেমন করে নাজী পার্টি জার্মানীর ইহুদিদের ইহুদিসূচক বাহুবন্ধনী ছাড়া প্রকাশ্যে চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল। উপনিবেশিতদের এরূপ স্টেরিওটাইপিং উপন্যাসে অসংখ্য। এমনকি উদার চেতনার এডেলাও তা থেকে মুক্ত নয়। মারাবার গুহার বাইরে বিয়ে নিয়ে আলোচনা করার সময় এডেলা ধারণা করে মুসলিম আজিজের একাধিক স্ত্রী রয়েছে। সাদা চামড়ার প্রতি কালো ও বাদামিদের আকর্ষন সাদাদের অনেকগুলো ভুল ধারণার একটি। এই যুক্তির জোরেই চন্দ্রপুরের ইংরেজরা আজিজকে দোষী সাব্যস্ত করে। পুলিশ কমিশনার ম্যাকব্রাইডের মতে গরম এলাকার অধিবাসীরা ভেতর থেকেই অপরাধী। ভারতের আবহাওয়াকে পদে পদে বিভিন্ন অনিষ্টের জন্য দায়ী করা হয়েছে। কনরাডের উপন্যাস হার্ট অফ ডার্কনেস-এ ও কঙ্গোর জঙ্গল ও আবহাওয়াকে কার্টজের দূর্নীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে যুক্তির খাতিরে পয়সার অন্য পিঠও দেখে নেয়া ভাল। ভাইকিং বা নর্সদের ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসাহসী ও হিংস্র জাতি বলা হয়। ইতিহাস বলে, নর্স তাদের মূল ভূ-খন্ড ঠেকে দক্ষিণে অগ্রসর হয়। পথে তারা যেসব জনবসতি পায় তাতে তারা লুন্ঠন, রাহাজানি কোন কিছুই বাদ রাখেনি। আবহাওয়ার কথা যদি বলা হয় তাহলে নর্সদের মূল বসতি ছিল ইউরোপের সর্ব উত্তরে যেখানে বারো মাসই শীতকাল, মাটি বলতে যা ছিল তা হল বরফ আর আকাশ সদা অন্ধকার বরফে ঢাকা। এই নর্সরাই পরে নর্মানরূপে ইংল্যান্ডে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। এখনকার ব্রিটিশ বলতে যাদের বুঝায় তারা এই হিংস্র, পাশব ভাইকিংদের উত্তরসূরি। প্রায় হাজার বছরের পরিশোধনের পরও যে কয়লার ময়লা যায়নি তা উপমহাদেশের ইংরেজদের দেখে বেশ বুঝা যায়। হার্ট অফ ডার্কনেস-এ কনরাড প্রাক খ্রীষ্ট ধর্ম যুগের ইংল্যান্ডের যে বর্ণনা দিয়েছেন তার যে সত্য সেটা ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায়। অসভ্যরা সভ্য হয়ে উঠলে যে আরো অসভ্য হয়ে যায় তা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। গরম আবহাওয়া যদি অপরাধীদের জন্ম দেয় তাহলে কি ঠান্ডা আবহাওয়াকে পশুদের জননী বলা অপরাধ হবে কি?
শুরুতেই আমি বলেছি এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া সাইদের ওরিয়েন্টালিজম- এর ভিন্ন রূপ- উপস্থাপনা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিচার সাপেক্ষে। ওরিয়েন্টালিজম ঔপনিবেশিক শাসনের উপর প্রবন্ধ আর এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া একটি উপন্যাস। দৃষ্টিভঙ্গির যে পার্থক্য তা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের। সাইদ নিজে একজন প্রাচ্যদেশীয়, তার প্রবন্ধে তিনি পাশ্চাত্যের শোষনকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা কোন পাশ্চাত্যদেশীয় নাগরিকের পক্ষে সম্ভব নয়। একজন পাশ্চাত্য নাগরিক যতই উদার হোক না কেন, উপনিবেশিক শাসনের আসল রূপ সে কখনই অনুভব করতে পারবে না। মি. টার্টনের মতে, “ একজন একই সাথে খরগোশের সাথে দৌড়াতে ও শিকারী কুকুরের সাথে শিকার করতে পারে না”। একজন মিশনারি যতই চেষ্টা করুক শোষিতদের কষ্ট পুরোপুরি উপলব্ধি করা তার কর্ম নয়। মেমি বলেন যে, একজন উপনিবেশিক পুরোপুরি তার গন্ডী ঠেকে বের হয়ে আসতে পারে না, যখন সে বের হয়ে আসে সে তখন সমাজ তাড়িত (outcast) এ পরিণত হয়। এডেলা যখন আজিজের উপর থেকে অভিযোগ তুলে নেয় তখন তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করে। ইংরেজদের জন্য সে একটি ন্যুইসেন্স (nuisance)- এ পরিণত হয়। এমনকি ফিল্ডিং ও তার গন্ডী থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি। ফিল্ডিং-ই প্রথম দাবি করে যে আজিজ নির্দোষ, সে ব্রিটিশ ক্লাব থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে অপসারণ করে, কিন্তু সেও উপনিবেশিক ব্যবস্থার উর্দ্ধে নয়। উপন্যাসের শেষে তার ও আজিজের পূর্ণমিলনিতে সে ব্রিটিশ উপনিবেশকতার সাফাই গায়। আজিজ ভারত থেকে ইংরেজদের অপসারণের কথা বললে ফিল্ডিং তাকে প্রশ্ন করে তাহলে জাপানিজরা ইংরেজদের চেয়ে ভাল শাসক হবে কিনা। ফিল্ডিং কখনই স্বাধীন ভারতের কথা ভাবে নি, ভারতকে সে সবসময়ই উপনিবেশ হিসেবে দেখেছে। ফরস্টার নিজেও এই দোষে দুষ্ট। ভারতের স্টেরিওটাইপিং থেকে তিনি নিজেও মুক্ত ছিলেন না। চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে তিনি কিছু কিছু জায়গায় তিনি ইংরেজদের বাঁধাধরা ধারণা ব্যবহার করেছেন। ভারতীয় অতিথিপরায়ণতাকে তিনি এক রকম হাস্যকর রূপ দিয়েছেন। যদিও এটা বলা হয়ে থাকে যে ঔপন্যাসিক আর তার চরিত্র ভিন্ন সত্ত্বা, তবুও উপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষিতে ফিল্ডিঙের মতকে ফরস্টারের নিজের বললে খুব বেশী ভুল হবার কথা না। ভারতীয়দের প্রতি তার সহানুভূতি প্রশ্নের অতীত, আর সব উপনিবেশিকদের মত তিনিও ভারতীয়দের অনুভূতির প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি। এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া ভারতীয়দের কাছে যেন মায়ের কাছে মাসির গল্প। পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবনের মধ্যকার দূরত্বটা উপন্যাসের ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যকার দূরত্বের মতই অপূরণীয় থেকে গেছে।
উপন্যাসের চরিত্রগুলো উপনিবেশিকতার সংকীর্ণতা পেরিয়ে দুই শ্রেণীর মধ্যে ভাল সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে, সেই একই বিচারে ব্যর্থ হয়েছে তাদের স্রষ্টা। আজিজের কথাই সত্য- স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠিত হবার আগে ইংরেজদের সাথে ভারতীয়দের বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। ফিল্ডিং আজিজের নিকট বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেও তা সমান মর্যাদার দুইজনের বন্ধুত্বের জন্য নয়। সম মর্যাদার বন্ধুত্ব তখনই সম্ভব যখন তাদের মধ্যে আর শাসক ও শোষিতের ভেদাভেদ থাকবে না; কিন্তু তার আগে নয়।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×