গেল বছর অফিস থেকে এক সপ্তাহের ট্রেনিং-এ খুলনা যেতে হয়েছিল। সপ্তাহব্যাপী হাড়-মাংস খাটনির পর ট্রেনারকে মনে মনে এক বস্তা গালি আর মুখে এক হাঁড়ি মধুর হাসি দক্ষিণা দিয়ে সোজা চলে গেলাম রেল স্টেশনে কর্মস্থলের টিকিট কাটার জন্য। ঢাকা আমার নিজের শহর নয়। দেশের আরো বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের মত দু’বেলা খাবারের সংস্থান করার জন্য ঢাকার উপচে পড়া জনসংখ্যাকে আরেকটু ত্বরান্বিত করতে আমার ঢাকায় আসা। এই শহরও মেফিস্টোফিলিসের মত দোযখের অনুসারীদের দিকে তার দুই হস্ত উজাড় করে দেয়। কোনোভাবে একটা মোটামুটি চাকুরি জোগাড় করলেও মোটামুটি একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে তার চেয়ে বেশী বেগ পেতে হয়। সারাজীবন মফস্বলের বড় বড় ঘরে রাজত্ব করে রাজধানীর চার দেয়ালের জেলখানাকে কখনোই আপন করে নিতে পারিনি। প্রতি রাতেই ঘরে ফিরে অতৃপ্তি আর অসন্তুষ্টি নামক দুই অনুভূতিকে কোলবালিশ করে কোনোভাবে ক্লিষ্ট বদনটাকে বিছানায় ফেলে পরের দিনের পাপমোচনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। ইংরেজিতে হোম বলতে যেটা বোঝায় এই কবুতরের খোপকে কখনোই তা মনে হয়নি। কিন্তু খুলনার এই রক্ত পানি করা ট্রেনিং চলাকালে সেই খোপটাকে খুবই মিস করছিলাম। একটা দিন বেশী থেকে যাওয়ার জন্য বন্ধুর যারপরনাই অনুরোধ উপেক্ষা করে সেদিন রাতের ঢাকার টিকিট কেটে ফেললাম। বিনিময়ে বন্ধুর বাসায় রাতের খাবারের দাওয়াত নিয়ে এক বেলার খাবারের খরচটা বাঁচিয়ে নিলাম।
খুলনায় যারা কখনো দাওয়াত খায়নি তারা কখনোই বুঝবে না দক্ষিণ বঙ্গের দাওয়াত কি বস্তু। দক্ষিণ বঙ্গের আতিথেয়তা অতিথির দক্ষিণ হস্তকে এক মুহুর্তের জন্য বিশ্রাম নিতে দেয়না বললেই চলে। সাদা ভাতের সাথে ডিম দিয়ে শুরু। সেই ডিম কখন মুরগী হলো আর সেই মুরগীর পিছ ধরে কখনই বা গরু এসে পাতে পড়লো তার হদিশ রাখা কোন দক্ষ নায়েবের পক্ষেও সম্ভব নয়। সে সাথে ডুবে যেতে হয় নাম না জানা অসংখ্য সামুদ্রিক মাছের স্রোতে, “এটা একটু খেয়ে দেখ, এই মাছটা আর কোথাও পাবি না, এটার স্বাদ একেবারেই আলাদা”- নানান ধরণের বায়ানাক্কার হাত ধরে বঙ্গোপসাগরের বেবাক মাছের নাম জানা হয়ে যায়। এগুলোর সাথে প্রতিযোগীতা করে অর্ধ ফুট সাইজের চিংড়িগুলো অ্যান্টেনাগুলো দিয়ে তাদের রাজকীয় উপস্থিতির সিগন্যাল দিয়ে চলে। এহেন আয়োজন আমার মত রসনা বিরাগীর রসনাকে উজ্জীবিত করবে তাতে আর অবাক হবার কিই বা আছে। এরূপ উদরপূর্তির পর যখন ষ্টেশনের দিকে পা বাড়াই তখন সারা সপ্তাহের ক্লান্তি এসে একেবারে পুরো শরীরের উপর ভর করে।
ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন ছাড়তে তখনো ঘন্টাখানেকের মত দেরী আছে। বন্ধুর বাসায় আরো কিছুক্ষণ বসে তারপর আসা যেত। কিন্তু অপরিচিত শহরে বেশি রাত করে বাইরে থাকতে মন সায় দিল না। তাছাড়া তাড়াহুড়ো করে শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরার চেয়ে আস্তে-ধীরে সময় নিয়ে ট্রেনে ওঠাটাই আমার বেশী পছন্দ, এর জন্য যদি কিছুক্ষণ প্লাটফর্মে অপেক্ষা করতে হয় তাহলে তাই সই। ওয়েটিং রুমগুলোতে ঢুঁ দিয়ে দেখি সেখানে এক তিল জায়গা ফাঁকা নেই। তাতেও কোন সমস্যা ছিলোনা। কাঁধে একটা ব্যাগই আমার একমাত্র লাগেজ। ভাবলাম, প্লাটফর্মে পায়চারি করতে করতেই সময় কেটে যাবে।
সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে আকন্ঠ উদরপূর্তির পরিতৃপ্তিকে আরেকটু উসকে দিতেই নিকোটিনের কড়া গন্ধকে বাতাসেই পরাজিত করে তার চেয়ে কোটিগুণ দূর্গন্ধ নাকে হামলা করে আরেকটু হলেই ঘন্টাখানেকের আগের ভোজনকে পেট থেকে ঠেলে বের করে দেয়ার উপক্রম করে। কোথা থেকে গন্ধটা আসছে তার তদন্ত করতে যেয়ে দেখলাম উৎস বের করার জন্য শার্লক হোমস বা ফেলুদা হবার কোন প্রয়োজন নেই। পুরো ষ্টেশনের এক কিমি ব্যাসার্ধ জুড়ে শুধু আবর্জনা আর আবর্জনা। খুলনাকে শিল্প নগরী বলেই জানতাম, অন্তত ছোটবেলা থেকে বই-পুস্তকে তাই পড়ে এসেছি। তারপরও এই অপরিকল্পিত আবর্জনা চাষ কোন শিল্পের অন্তর্ভুক্ত তা মাথা কুঁটেও বের করতে পারলাম না। সারা শহরের আবর্জনা যেন রপ্তানীর জন্য ষ্টেশনে এনে রাখা হয়েছে। ট্যাক্স বা ভ্যাট সংক্রান্ত কোন জটিলতার কারণে মাল গুলো খালাস করা হয়নি- এরকম কিছু একটা হবে হয়ত। কারণ যাই হোক, আমার ক্কুকুর প্রতিসম নাসিকার পক্ষে এই আজব কস্তুরী সহ্য করা নিতান্তই অসম্ভব হয়ে উঠছিল। পুরো ষ্টেশনে একবার নজর বুলিয়ে নিলাম। কোন জায়গাতে যেয়েই এর থেকে নিস্তার নেই। নিজেকে কেন জানি মহাভারতের অভিমন্যু মনে হচ্ছিল, শত্রুর ব্যূহ ভেদ করে ঢুকে পড়েছি বটে কিন্তু বের হবার কোন পথ নেই। ভাবলাম আরেকবার ওয়েটিংরুমের দিকে যাওয়া যাক। বসার জায়গা না পাই, দাড়ানোর জায়গা তো নিশ্চয় পাওয়া যাবে। কিন্তু ওয়েটিংরুমে যেয়ে দেখি সে আশায় গুঁড়ে বালি। তালগাছ হলেও হয়তো এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেত, সেখানে মানুষ আর তাদের বোঁচকা-বুঁচকি গাঁদাগাঁদিতে পা দুটা একটু আরাম করে রাখবো তার জোঁ নেই। লাগাতার তিনদিন পরিবহণ ধর্মঘট হবার কারণে খুলনার তাবৎ ঢাকাগামী মানুষ আমার মতই ট্রেনের আশায় ষ্টেশনে এসে হানা দিয়েছে। ওয়েটিংরুমের দরজার কাছে দাঁড়াতেই মানুষ তো মানুষ, তাদের বোঁচকা-বুঁচকিগুলোও এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাগীদারের দিকে এমনভাবে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো যে সেই পুণ্যবান কাফেলাকে আর কষ্ট না দিয়ে মানে মানে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম।
ট্রেন তখনো এসে পৌঁছায়নি যে ট্রেনে উঠে বসে থাকবো। রুমালে নাকে চেপে অসহায়ের মত এদিক-ওদিক তাকাতেই ষ্টেশনের কাছেই থাই গ্লাস দিয়ে বন্ধ করা একটা মাঝারী আকারের রুম চোখে পড়লো। অনুমান করলাম, রুমটা আর যাই হোক কারো বাসা অন্তত নয়। বাংলাদেশে এখনো এরকম শৌখিন মানুষের জন্ম হয়নি যে ষ্টেশনের পাশে চার পাশে থাই গ্লাস দিয়ে ঘেরা এক রুমের ঘর তুলবে। আমার যুক্তিকে ভিত্তি দেওয়ার জন্য চোখগুলো স্থির হয় রুমটার উপর বড় করে বসানো সাইনবোর্ডের উপর। আমার মাইওপিক চোখগুলো সাইনবোর্ডের লেখা পড়তে ব্যর্থ হওয়ায় সেটা আসলে কি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। রুমের সাইজ বলে তা হোটেল নয়। আবার চায়ের দোকানও যে হবে তার জন্যও সেটা একটু বেশীই টিপটপ। দোকান হোক আর হোটেল হোক, এক কাপ চা আর সিগারেট খেতে চাইলে নিশ্চয় কিছুক্ষণ সেখানে বসতে দিবে। চার দিকে ঢাকা রুমে বাইরের গন্ধটাতো আর নাকে আসবে না। নিজের বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে সেদিকে পা বাড়ালাম।
সিধু বাবুর ফ্যাশন সেলুন- মনে মনে খুশিই হলাম। বসার জন্য চায়ের দোকান আর হোটেলের পর সেলুনই সবচেয়ে ভাল জায়গা। অস্বচ্ছ কাঁচের মধ্য দিয়ে ভেতরটা দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছিলো যে এটা পাড়ার যেন-তেন সেলুন নয়। নাপিত দেখলে নাকি নরুন বাড়ে। সেলুন দেখেই হাতটা নিজের অজান্তেই গালের কাছে চলে গেল। গত এক সপ্তাহের অযত্নে দাড়িগুলো ক্যাকটাসের মত হয়ে গেছে। পরের দিন অফিসে যাওয়ার আগে সেভ করতেই হত। সেটা এখনই হয়ে গেলে ভাল। গালের ক্যাকটাসগুলোকে যত্ন করে বনসাই না করে পুরোপুরি নির্মূল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাই গ্লাসের প্যান ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।
ভেতরে তিন দেয়াল ভর্তি আয়না আর সাত-আটটা ফাঁকা চেয়ারের সাথে পঞ্চাশোর্ধ এক ভদ্রলোক ছাড়া পুরো সেলুনে আর কেউ নেই। দরজা খোলার আওয়াজ শুনে ভদ্রলোক, খুব সম্ভবত সিধু বাবুই হবেন, আমার দিকে তাকান। ক্লিন-সেভড মুখের ক্ষীণকায় একজন ভদ্রলোক। আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে একবার তাকান। ঘড়িতে তখন নয়টা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট।
“চুল কাটাবেন, নাকি সেভ করবেন?”
তার বারবার ঘড়ির দিকে তাকানো দেখেই বুঝলাম দোকান বন্ধের সময় হয়ে গেছে। আমাকে তখনো পৌনে এক ঘন্টার মত সময় কাটাতে হবে। তার কিছু সময় যদি এই ভদ্রলোকের কাছে থেকে নিয়ে নেই তাহলে তার খুব একটা ক্ষতি হবার কথা না, বরং দিনের একদম শেষ সময়ে কিছু ইনকাম হবে। সেভ করতে অন্তত পনের-বিশ মিনিট তো লাগবেই। বাকি সময়ের জন্য অন্য কিছুর ব্যবস্থা করে নিবো।
“সেভ করবো”।
আমাকে কোণার দিকের একটা রিভলভিং চেয়ারের বসতে ইশারা করে ভদ্রলোক ড্রয়ার থেকে সেভ করার সরঞ্জামাদি বের করতে লাগলেন। ড্রয়ার থেকে বের হল একটি কাঁচি, চিরুনি, ক্ষুর ও ধবধবে পরিষ্কার দুইটি তোয়ালে। একটি তোয়ালে আমার গলায় বেঁধে ভদ্রলোক হিটারে পানি গরম করতে দিলেন।
“একটু বসেন। পানিটা একটু গরম হোক”।
সেভ করার সাথে গরম পানির কি সম্পর্ক ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। হয়ত সারাদিন বারবার ভদ্রলোক মানুষের চুল ও দাঁড়ি কেঁটে ক্লান্ত। দিনের শেষে অযাচিত এই কাস্টোমারকে সেবা প্রদানের আগে তার কিছুটা চাঙ্গা হওয়া প্রয়োজন। হাজার হোক বয়স্ক মানুষ, ক্লান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এক কাপ চা যদি তাকে একটু চাঙ্গা করে তুলতে পারে তাতে তো কোন সমস্যা নেই। তবুও মনে মনে একটু হিসাব করে নিলাম- চা বানাতে আর খেতে পনের মিনিট, সেভ করতে বিশ। তার পরও যা সময় থাকবে তাতে আমি আরাম করে যেয়ে ট্রেন ধরতে পারবো। ভদ্রলোককে তার কাজ করতে দিয়ে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম।
রাতের খাবারটা আসলেই একটু বেশীই ভাল ছিল। বসে থাকতে থাকতে কখন তন্দ্রার মত চলে আসলো ঠিক টের পেলাম না। হঠাৎ মুখের উপর নরম-গরম কাপড়ের মত কিছু একটা পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম।
“ভয় পাওয়ার কিছু নাই। গরম টাওয়েলটা গালে একটু রাখেন, দাঁড়িটা নরম হবে,” ভদ্রলোক আশ্বস্ত করলেন।
চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের অনেক শহরের সেলুনে যেয়ে সেভ করতে হয়েছে। আর কোন জায়গায় এটা দেখিনি যে সেভ করার আগে দাঁড়ি নরম করার জন্য গরম তোয়ালে গালে দিয়ে রাখতে হয়। হঠাৎ তন্দ্রা ভেঙ্গে এই অভিনব ব্যবস্থা হজম করে নিতে কিছুটা কষ্ট হয়। আমার বিস্ময় আঁচ করতে পেরে ভদ্রলোক বললেন, “কখনো এভাবে সেভ করেননি, না?”
আলতো করে মাথা নাড়ি। আমার উত্তরে ভদ্রলোক খুশি হন। তোয়ালেটা আবার আমার মুখের উপর দিতে দিতে বলেন, “এই সিস্টেমটা বিদেশী। আমাদের দেশের নাপিতরা এটা জানে না। টাওয়েল গরম পানিতে ভিজিয়ে দশ মিনিট গালে রাখলে দাঁড়িটা নরম হয়। তারপর সেভিং ক্রীম মাখলে সেভটা খুব ভাল হয়। গালেরও কোন প্রবলেম হয়না”।
“আপনি এই সিস্টেম কোথা থেকে শিখলেন?” জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
ভদ্রলোকের উত্তরে অহংকারের কড়া সুর টের পেলাম, “আমার আব্বার কাছ থেকে। উনি শিখছেন আমার দাদাজানের কাছ থেকে। আমার দাদাজান শিখছেন এক ইংরেজের কাছ থেকে। এই শহরে আমরাই সবচেয়ে পুরাতন নাপিত”।
“তার মানে আপনারা তিন পুরুষ ধরে নাপিত?”
“হ্যাঁ”।
ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হল। অনেক সেলুনে সেভ করা আমার অভিজ্ঞতা বলে নাপিতরা কথা-বার্তার ব্যাপারে খুব দিলখোলা হয়। বাঁচাল না, স্রেফ দিলখোলা। একবার কোন টপিক ধরিয়ে দিলে হাতের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুখ চলতে থাকে। আমিও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে মুখ খরচ করে সময় কাটাই। সেভ করা এবং করানো, দুটোই খুবই বোরিং কাজ। এই স্বল্প সময়ের বাক্য বিনিময় সেবা দাতা ও গ্রহীতা দু’জনের মধ্যে একটা ক্ষণস্থায়ী ভাতৃত্ববোধ গড়ে তোলে যেটা কাঁচাবাজার বা মুদির দোকানে পাওয়াটা একেবারেই অসম্ভব।
“খুলনায় আছেন কতদিন ধরে?”
“দাদার সময় থেকে। তার আগে ছিলাম কলকাতায়। দাদা কলকাতায় সাহেবদের চুল-দাঁড়ি কাঁটতেন। পরে খুলনায় আসেন। তখন থেকেই খুলনায়”।
কথা বলতে বলতেই ভদ্রলোক তার কাজ করছিলেন। প্রথমে একটা কাঁসার বাটিতে পানি ভর্তি করলেন। অনেক দিন পর কাঁসার কিছু দেখলাম। ছোটবেলায় কাঁসার থালা ছাড়া খেতে চাইতাম না। তারপর আস্তে আস্তে ভাল সব জিনিস গুলোর সাথে কাঁসার জিনিসগুলোও যে কোথায় চলে গেছে তা বলতে পারবো না। এখন কোথাও আর কাঁসার কোন কিছু দেখিনা। দোকানের চারপাশে একবার চোখ বুলাতেই দেখি আরো কয়েকটা সুন্দর করে সাজানো আছে। দেখেই বোঝা যায় সেগুলোকে নিয়মিত তেঁতুল-পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এই কাজটা আমার দাদী খুব যত্ন করে করতেন। মাঝে মাঝে দাদীকে সাহায্য করার নাম করে গোটা কতক তেঁতুল নিয়ে পালিয়ে যেতাম। হঠাৎ ভদ্রলোক কথা বলে উঠায় আমার কাঁসা সংক্রান্ত স্মৃতিরোমন্থনে ছেদ পড়লো, “আপনি কি ট্রেন ধরবেন?”
“হ্যাঁ”।
“কোথায় যাবেন? ঢাকা?”
“হ্যাঁ। কিভাবে বুঝলেন?” একটু অবাক হলাম।
ভদ্রলোক হেসে বললেন, “এটা তো খুবই সোজা ব্যাপার। এই টাইমটাতে ঢাকার ট্রেনটাই যায়। বাকিগুলা ছেড়ে চলে গেছে। কতদিন ধরে এখানে দোকান চালাচ্ছি। সব ট্রেনের টাইম-টেবিল আমার জানা”।
হক কথা। এই সোজা ব্যাপারটা আমার মাথায় কেন ঢুকলো না বুঝলাম না। আবার নিজেকে গর্দভ বলেও গালি দিব সেটাও খুব জোর গলায় পারছি না। চোখগুলো ভদ্রলোকের কাজ দেখতে এত ব্যস্ত ছিল যে মস্তিষ্কের পূর্ণ কার্যক্ষমতাই এখন দুই নয়নের দখলে। অন্য ইন্দ্রিয়গুলো কাজ করছে স্রেফ অভ্যাসের খাতিরে, তাতে মনোযোগের বিন্দুমাত্র আভাস নেই। ভদ্রলোক তখন সেভিং ব্রাশ নিয়ে কিছু একটা করছেন। চশমা ছাড়া আমার ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে যা বুঝলাম তা হল তিনি ব্রাশটাকে বারবার গরম পানিতে চুবিয়ে ব্রাশের ব্রিসলগুলোকে নরম করছেন। তারপর সেভিং ক্রীমের টিউব থেকে ক্রীম বের করলেন একদম মেপে মেপে যেন একটু কম-বেশী হলে আমার গালটাই পুড়ে যাবে। তারপর খুব যত্ন করে ব্রাশে ক্রীম লাগালেন। ছোট থাকতে আমাদের শহরে এক ধরণের আইসক্রীম পাওয়া যেত, সফট কোণ- মেশিনে বানানো ক্রীম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কোণাকৃতি ক্র্যাকার্সের মধ্যে দিয়ে সেটা বানাতে হত। ছোটবেলায় পকেটে টাকা থাকুক আর না থাকুক, দোকানে যেয়ে সেটা বানাতে দেখার মজাটাই ছিল অন্যরকম। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় দোকানের সামনে কিছুক্ষণ থেমে দোকানদারের আইসক্রীম বানানো দেখতাম আর ভাবতাম আমি যদি এভাবে বানাতে পারতাম তাহলে কত ভাল হত। সিধু বাবুকে দেখে আমার সেই দোকানদারের কথা মনে পড়ে গেল। সেভিং ব্রাশের উপর একইভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ক্রীম লাগাচ্ছেন। ব্যাপারটা একইসাথে নস্টালজিক ও হিপনোটিক। ইচ্ছা করলেও সেখান থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক অনন্তকাল ধরে কাজটা করছেন। ব্রাশে ক্রীম মাখানো শেষে ভদ্রলোক আমার মুখ থেকে তোয়ালেটা সরিয়ে নিলেন। তারপর আমার মুখ কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে একটু ভেজালেন। প্রায় লেগে যাওয়া পাতাগুলোতে পানির ছিঁটা পড়ায় চোখগুলো একটু বড় বড় হয়ে গেল। ঘুমের ঘোরটা একটু কাটতে না কাঁটতেই শেভিং ক্রীমের গন্ধটা পাতাগুলোকে জোর করে বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম করে। বইয়ে পড়েছি পপির গন্ধ নাকি সবচেয়ে মাদকতাময়। যারা পপির চাষ করে তারা নাকি চাষ করার সময় নাকে কাপড় বা মাস্ক বেঁধে নেয়। পপির গন্ধ নেওয়ার সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য কোনটাই আমার কখনো হয়নি। কিন্তু সিধুবাবু যখন গালে শেভিং ক্রীম লাগাচ্ছিলেন তখন আমি যে পপির ক্ষেতে বসে নেই তা বিশ্বাস করতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছিল। গালে শেভিং ব্রাশের নরম ব্রিসলের ছোঁয়া আর নাম না জানা মাদকতার হাত ধরে কখন হিপনোস ও তার স্ত্রী প্যাসিথিয়া সপরিবারে আমার ক্লান্তির রাজ্যে অনাহূত অতিথির মত হানা দেয় ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারলাম না।
চোখ খুললাম ঐরাবতের ডাক শুনে। সিধুবাবু তখন আমার গালে অ্যান্টিসেপটিক লাগাচ্ছেন, “ভালোই ঘুম দিলেন”।
কোথায় আছি, কি করছি তা বুঝে উঠতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। যতদূর মনে পড়ে আমি কোন এক চিড়িয়াখানায় হাতির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাতিটা আমার সামনে এসে হঠাৎ শুঁড় তুলে ডাক দিতেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।
“আপনার ট্রেন এসে গেছে। এখনই হুইসেল শুনলাম”।
ট্রেনের কথা শুনেই পুরোপুরিভাবে জেগে উঠলাম। তাড়াতাড়ি উঠে দাড়াতে গেলে সিধুবাবু বলেন, “এত ত্তাড়াহুড়া করার কিছু নাই। এখনই আসলো। এরপর পরিষ্কার করবে, তারপর ছাড়বে। তাও তো ধরেন মিনিট বিশেক লাগবেই। ততক্ষণে আমার কাজটাও শেষ হয়ে যাবে”।
সিধুবাবুর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে ভরসা করে বসলাম বটে কিন্তু মন থেকে ট্রেন মিস হবার উৎকন্ঠাকে কিছুতেই দূর করতে পারছিলাম না। এরপর তিনি আবার অ্যান্টিসেপ্টিক লাগাতে লাগলেন। তিনি এতই যত্ন করে কাজটা করছিলেন যে এই বারবার অ্যান্টিসেপ্টিক লাগানোতে কিছুটা বিরক্তবোধ করলেও মানা করলাম না। আমি নিজেও শীতের দিন এত যত্ন করে লোশন মাখি না। মিনিট তিনেক ধরে এই বিরক্তিকর কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি বেসিনে মুখটা ধুইয়ে দিলেন। তারপর চেক করতে লাগলেন কোন জায়গায় এখনো দাঁড়ি থেকে গেছে কি না। সিধুবাবু তার কাজ করতে এতই মগ্ন ছিলেন যে আমি যে একবার আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকাবো তার উপায় ছিল না। কতক্ষণ ধরে শেভ করছি আর কতক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছি তা বুঝতে পারছিলাম না। ফরিদ সাহেবের তত্ত্ব মানলে দু-তিন মিনিটের বেশী ঘুমাইনি। স্বপ্ন দেখছিলাম সেটা বুঝতে পেরেছি, কিন্তু কতগুলো সেটা বের করার তো কোন উপায় নেই। ফরিদ সাহেব সেই তত্ত্ব তো আর দিয়ে যাননি। সেই তত্ত্ব পাওয়া গেলে হয়ত আড়াই মিনিটকে স্বপ্ন সংখ্যা দিয়ে গুণ করে একটা ফলাফল পাওয়া যেত। ফরিদ সাহেবের খোয়াবনামা আগে পড়া থাকলে কোন একটা ব্যাখ্যা হয়ত দাঁড় করাতে পারতাম কিন্তু তা পড়া ছিল না। বরং সমাধানের জন্য সবচেয়ে সহজ উপায়টাই বেছে নিলাম, “আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বলেন তো?”
“বেশীক্ষণ না,” ভদ্রলোক তখনো উচ্ছিষ্ট দাঁড়ির খোঁজ করছিলেন, “পঁচিশ-ত্রিশ মিনিটের মত। আমি নিজেও খেয়াল করিনি। আমি আরো কাজ করতে করতে আপনার সাথে কথা বলছিলাম। আপনি কথা বলছেন না দেখে বুঝলাম ঘুমায়ে গেছেন”।
“আমি বুঝতে পারিনি। খুব টায়ার্ড ছিলাম তো,” হঠাৎ পরিস্থিতি অনুধাবন করে আঁতকে উঠি, “ত্রিশ মিনিট? ট্রেন?”
“আমি কাজ করতে করতে খেয়াল করিনি। সেভ শেষ হওয়ার পর অবশ্য হুইসেল শুনছি। এখান থেকে ভালভাবে বোঝা যায়না। চারদিকে ঢাকা তো। তাও আমার মনে হয় এখনই আসছে”।
“এখন কয়টা বাজে?”
“দশটা পয়ত্রিশ”।
“ঢাকার ট্রেন কি টাইম মতই আসে? নাকি লেট করে?”
“এটা ভাই বলতে পারবো না। ঢাকার ট্রেন ছাড়ার আগেই আমি বাড়ি চলে যাই। আজকেই শুধু থেকে গেলাম,” ভদ্রলোকের হাত তখনো দাঁড়ির অনুসন্ধানে ব্যস্ত।
বুঝতে পারছিলাম না কি করবো- ভদ্রলোকের মনের উপর ভরসা করবো নাকি ট্রেনের সময়ানুবর্তিতার উপর। দূরপাল্লার ট্রেন অবশ্য হরহামেশাই লেট করে। ইতিমধ্যেই ট্রেন ছাড়ার দশ মিনিট পার হয়ে গেছে। কত লেট হতে পারে ঠিক হিসাব করে উঠতে পারছিলাম না।
কথাটা হঠাৎ করেই মনে হল, “আপনি এতক্ষণ ধরে সেভ করছিলেন?”
আমার প্রশ্নের উত্তরে সিধুবাবু বিনয়ের হাসি হাসলেন, “হ্যাঁ”।
“এতক্ষণ? সেভ করতে তো এত সময় লাগার কথা না,” আমার বিস্ময়ের মাত্রা বেশ খানিকটা চড়ে গেল।
আমার প্রতিক্রিয়া সিধুবাবুর অহমে একটু আঘাত করে “আপনি আর কোথায় কোথায় সেভ করেছেন জানি না। কিন্তু একটা কথা আপনাকে না বলে পারছি না। আমরা খানদানি নাপিত। আপনি এই শহরে থাকেন না বলেই হয়ত জানেন না। সেভ করা আর পান বেচা এক কথা না। শুধু গালে সেভিং ক্রীম লাগিয়ে ক্ষুর দিয়ে টান মারলেই সেভ করা হয়ে যায় না। আমি এত সময় নিয়ে যত্ন করে সেভ করে দেই বলেই আমার সেলুন কখনো ফাঁকা থাকে না। আপনি রাত দশটায় এসে ফাঁকা দেখছেন বলেই ভুল বুঝবেন না”।
বুঝলাম আসলেই অজানা অনেক কিছুই আছে। ভদ্রলোকের অহমে আরো আঘাত না হানার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবুও একটা কথা জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, “আপনার আর কতক্ষণ লাগবে?”
“আফটার সেভটা লাগায়ে দিলেই শেষ," আর কোন উচ্ছিষ্ট খুঁজে না পেয়ে ভদ্রলোক আফটার সেভের বোতলের দিকে হাত বাড়ালেন।
আর কথা না বাড়িয়ে আফটার সেভ লাগানোর জন্য চুপচাপ বসে থাকলাম। কান দু’টো চিংড়ির অ্যান্টেনার মত খাড়া করে রাখলাম ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শোনার জন্য। সিধুবাবু তখন আফটার সেভ লাগাচ্ছেন। এই সামান্য আফটার সেভ লাগানোও যে রিচ্যুয়ালের পর্যায়ে যেতে পারে আমার জানা ছিল না। আসলে অনেক কিছুই জানা ছিল না, নতুন নতুন অনেক জিনিসই শিখলাম। সিধুবাবু তার হাতটা আগে পানিতে ভিজিয়ে নিলেন। তারপর আমার গাল আফটার সেভের সুষম বন্টনের জন্য সিক্ত করলেন। তারপর মেপে মেপে কয়েক ফোঁটা লিকুইড দুই হাতে নিয়ে আমার গালে চেপে ধরলেন। তারপর গালের ও গলার প্রতিটি স্কয়ার সেমি মেপে মেপে আফটার সেভ লাগালেন যাতে টিটেনাসের কোন সম্ভাবনাই না থাকে। আফটার সেভ লাগানোর পর আমি উঠে বসতে গেলে তিনি আমার ঘাড় ধরে আবার বসিয়ে দেন। তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালে বলেন, “ একটু বসেন। আফটার সেভটা গালে একটু ভালভাবে বসুক”।
আমার বসার সাথে আফটার সেভ বসার কি সম্পর্ক বুঝলাম না। সেভ করা তো শেষই হয়ে গেছে। আফটার সেভ লাগানো আর খাবার পর সুন্নাতের ডেজার্ট খাওয়ার মানে তো একই- সব শেষ, এবার মানে মানে কেটে পড়। ডেজার্টের পর আবার কিসের আয়োজন থাকতে পারে? কোথাও দাওয়াত খেয়ে সেখানেই বসে হজম করতে হবে এরকম কথা আগে কখনো শুনিনি। তবুও এই খানদানি নাপিতকে তার কাজ পরিতৃপ্তির সাথে শেষ করতে দেওয়ার জন্য বসলাম। কিন্তু আমার মন তখনো পড়ে আছে ষ্টেশনের ভিতরে। ট্রেনের কোন আওয়াজই তখনো পাইনি।
দু-তিন মিনিট পার হবার পর ঠিক করলাম আর দেরী করা সম্ভব না। এবার জোর করেই উঠে দাড়ালাম। মানিব্যাগ বের করে জিজ্ঞেস করলাম, “ কত দিব?”
“সত্তর টাকা”।
আমি সাধারণত কম পয়সায় সেভ করি। সেভ করার জন্য সত্তর টাকা আমার কাছে অনেক বেশী। কিন্তু আর কথা বাড়ালাম না। এই অভাবনীয় সেভের দাম বেশী হবে এটাই স্বাভাবিক। শিল্প নগরীর মানুষের পকেটে পয়সা আর হাতে অঢেল সময় আছে সেটা বোঝা গেল। না হলে এত সময় ও টাকা নষ্ট করে ষ্টেশনের চৌকাঠে এসে চুল ও দাঁড়ি কেটে যেত না। সিধু বাবুর হাতে গুণে গুণে সত্তর টাকা ধরিয়ে দিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ষ্টেশনের দিকে দৌড় মারলাম।
ষ্টেশনে পৌছে দেখি পুরো প্লাটফর্মই ফাঁকা। টিকিট কাউন্টারে গলার আওয়াজ শুনে সেদিকে গেলাম। তিনজন বয়স্ক ভদ্রলোক আড্ডা দিচ্ছেন। খুব সম্ভবত কাউন্টারের লোকই হবেন। প্রথম কাউন্টারে যে ভদ্রলোক ছিলেন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঢাকার ট্রেন কি আসেনি?”
আড্ডাতে বাঁধা পড়ায় ভদ্রলোক যারপরনাই বিরক্ত হলেন। প্রায় খ্যাক করে উঠলেন, “কিসের ট্রেন?”
“ঢাকার ট্রেন”।
“ঢাকার ট্রেন চলে গেছে”।
“কখন গেল?” পূর্ব আশঙ্কাকে বাস্তবে পরিণত হতে দেখে কেন জানি অবাক হলাম না।
ভদ্রলোক আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। স্বাভাবিক ব্যাপার, ট্রেন তো চলে গেছেই। কখন গেছে এটা বড় প্রশ্ন না। সুতরাং বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে।
“কালকে সকালে ঢাকার ট্রেন আছে?”
আমার দিকে না তাকিয়েই ভদ্রলোক জবাব দিলেন, “কাউন্টারের উপর লেখা আছে। কালকে আছে কি না সেটা দেখেন”।
গড হেল্প দোজ হু হেল্প দেমসেলভস্- দেয়ালে লেখা চার্ট দেখে বুঝলাম খুব সকালে একটা ট্রেন আছে। তাও ভাল, তাহলে সকালের ট্রেনেই যাওয়া যাক। খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “সকালের ট্রেনের টিকিট আছে? থাকলে একটা টিকিট দেন”।
কন্ঠের সাথে সাথে ভদ্রলোক এবার তার চেহারাতেও বিরক্তির ছাপটা স্পষ্ট করে তুললেন, “টিকিট আছে কি না দেখতে হবে। এখন দেখা যাবে না, কাউন্টার বন্ধ। সকালে ট্রেন ছাড়ার আগে আসেন”।
পরপর তিনটা কাউন্টারের জানালা খোলা রেখে সেগুলো কিভাবে বন্ধ থাকে সেটা বুঝলাম না। ভাবলাম হয়ত রাত হয়ে গেছে বলে তারা এখন গৃহমুখী হবেন তাই আর টিকিট দেওয়ার ঝামেলায় যেতে চাচ্ছেন না। কিন্তু তাদের হাবভাব দেখে সেটা মনে হল না। তখনো চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছেন। একজন তার পানের ডিব্বা খুলে সবার মাঝে বিলালেন। পান মুখে দিয়ে তিনজন আবার আড্ডায় মশগুল হয়ে গেলেন।
কাউন্টারে প্রত্যাখিত হয়ে আবার প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসলাম। রুমালে নাক চেপে পুরো ব্যাপারটা একবার ভাবলাম। সকাল পর্যন্ত সময় পার করতে হবে। তখন এগারোটা পার। একবার ভাবলাম বন্ধুর বাসায় ফিরে যাই। রাতটা কোনোভাবে পার করে সকালে আবার ট্রেন ধরা যাবে। কিন্তু ট্রেনটা একদমই সুবাহ্ সাদিকের সময় ছেড়ে যাবে। কোনভাবে দেরী হয়ে গেলে আবার মিস হয়ে যাবে। অত সকালে রিক্সা বা অটো পাবো তার গ্যারান্টি কি? ষ্টেশনের কাছাকাছি কোন হোটেলও নেই যে সেখানে থাকবো। এরকম কিংকর্তব্যবিমূড় পরিস্থিতিতে চোখ পড়লো হাঁ হয়ে থাকা ওয়েটিং রুমের দরজার দিকে। ভিতর থেকে টিউব লাইটের আলো দরজা দিয়ে ছিটকে পড়ছে। পুরনো পাকিস্তানি আমলের ফ্যান গোঁ গোঁ শব্দ করে ঘুরে নিজের অকাল বার্ধক্যের জানান দিচ্ছে। দরজার কাছে যেয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম। পুরো ওয়েটিং রুম ফাঁকা, কাফেলা তাদের মালামাল নিয়ে গন্তব্যের অভিমুখে। এত সমস্যার মধ্যেও মনের গভীরের এক চিমটি পরিমাণ বিশুদ্ধ প্রশান্তি নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণায় এসে আশ্রয় নিল। ব্যাগটাকে বালিশ করে লম্বা বেঞ্চের উপর ক্লান্ত দেহটাকে ফেলে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।