যুক্তরাজ্যের মাইকেল ফ্যারাডে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ হেনরি দুজনেই একই বছরে লক্ষ্য করেন যেকোনো চুম্বকের সামনে কোনো তারের কুন্ডলি নাড়ালে কুন্ডলিতে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, ফ্যারাডের উত্তরসুরি ম্যাক্সওয়েল পরবর্তীতে তড়িৎ চুম্বকীয় তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন, আর যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ হেনরি একই নীতি ব্যবহার করে তৈরি করলেন ইলেক্ট্রিক জেনারেটর, এবং একই সাথে টেলিগ্রাফের ধারণাও উপস্থাপন করলেন। আটলান্টিকের এপারে ওপারের মানুষদের মানসিকতার পার্থক্যটা এমনই, যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবনের প্রায়োগিক দিকটা বেশী প্রয়োজনীয়, তত্ত্বীয় রহস্য উদঘাটন কিংবা সামষ্টিকতার প্রয়োজন তাদের নেই। বিংশ শতাব্দীর আগে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান খুবই সীমিত- ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন বৈজ্ঞানিক ও আবিস্কারকেরা পদার্থের গুঢ় তত্ত্ব উদঘাটন করছেন, সমুদ্রের অন্যপাশের মানুষেরা তখন প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে- ইতিহাস বলছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের অধিকাংশের গবেষণার প্রিয় দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র ছিলো না, আইনস্টাইনের আগে যারা যুক্তরাষ্ট্রে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন তাদের সবারই লক্ষ্য ছিলো বাড়তি কিছু পয়সা উপার্জন, তারা ধরেই নিতেন আগামি কিছু সময় তাদের কোনো গবেষণা হবে না কিন্তু বাড়তি উপার্জন হবে। আইন্সটাইন বাদ দিলে সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সাগ্রহে যেতে রাজী হয়েছেন এমন প্রতিষ্ঠিত কোনো বিজ্ঞানীর নাম পাওয়া যাবে না।
গত ৫০ বছরে পরিস্থিতি পরিবর্তত হয়েছে, যদিও এখনও যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা কেন্দ্রগুলো যেকোনো আবিস্কারের প্রায়োগিক দিকটাকেই প্রয়োজনীয় মনে করে তবে গবেষণার বিস্তর সুযোগ সেখানে আছে। ইউরোপের মতো তত্ত্বীয় ক্ষেত্রে গবেষণা সেখানে হচ্ছে না এমনটা বলা যাবে না কিন্তু মূলত প্রায়োগিক উপযোগিতা না থাকলে সেখানে গবেষণার ফান্ডিং পাওয়া কঠিন। যে কারণে সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পার্টিকেল কোলাইডারের জন্য যথেষ্ট অর্থ সংস্থান করা সম্ভব হয় নি , ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলো সম্মিলিত ভাবে সার্নের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কংগ্রেসন্যাল হিয়ারিং এ পার্টিকেল কোলাইডারের উপরে অর্থবরাদ্দের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দেয়।
তবে আমাদের আলোচনার প্রেক্ষাপট মূলত উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক, ফ্যারাডের পর্যবেক্ষণ এবং ম্যাক্সওয়েলের অনুধাবনের আগেই আলোর বৈশিষ্ঠ্য নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, নিউটন ১৭০৪ সালে প্রকাশিত আলোকবিদ্যায় সর্বপ্রথম অনুমাণ করেন আলো আসলে কণিকা, প্রতি বর্ণের আলোকে আলাদা আলাদা কণিকা হিসেবে কল্পনা করলেও নিউটনের ভাবনায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছিলো না।
একই সময়ে আলোর তরঙ্গ চরিত্রের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যাওয়ায় পরবর্তীতে নিউটনের কণিকা তত্ত্ব পরিত্যাক্ত হয়। ম্যাক্সওয়েল যখন তড়িৎ-চুম্বকীয় তত্ত্বের ধারণা দিলেন, বললেন আলো নিছক তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের পরিবর্তনের উপজাত সে সময় থেকেই কল্পনা শুরু হলো আলো কি শূণ্য মাধ্যমে চলাচল করে? না কি আলোর তরঙ্গ প্রবাহিত হওয়ার জন্য আলাদা মাধ্যম প্রয়োজন। প্রতিটা তরঙ্গ প্রবাহিত হওয়ার জনয় মাধ্যমের প্রয়োজন, সে কারণে ইথার তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, এমন কি মাইকেলসন-মরলি ১৮৮২ সালে ইথারের অনস্তিত্ব প্রমাণ করার দুই দশক পরেও ইথারে আলো কিভাবে প্রবাহিত হয় এ বিষয়ে পুস্তক রচিত হয়েছে।
বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আলো উৎপাদনের কৌশল রপ্ত হওয়ার পর উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ক্যাম্ব্রিজে জে জে থমসন গ্যাসের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের কৌশল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তার মাত্র কয়েক বছর আগেই গণতান্ত্রিক ভাবে পরমাণুর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইলেক্ট্রোলাইটের ভেতরে হাইড্রোজেন আয়নের গতিবেগ নির্ণয় করে হাইড্রোজেন আয়নের চার্জ এবং ভরের অনুপাতও নির্ণয় করা হয়েছে- থমসন ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় ইলেক্ট্রন তৈরি করে সেগুলোর চার্জ ও ভরের অনুপাতের মাণ নির্ণয় করে অবশেষে ১৮৯৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রকাশিত জার্নালে ঘোষণা করলেন পরমাণুর অবিভাজ্যতার ধারণা ভ্রান্ত- পরমাণু বিভাজিত হওয়া সম্ভব এবং তা থেকে ঋণাত্মক আধান পাওয়া সম্ভব। তার আগেই হার্টজ লক্ষ্য করেছিলেন যদি ধাতব পৃষ্টকে আলোকিত করা হয় তবে গ্যাসে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়।
থমসন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো দিয়ে গবেষণা করে নিশ্চিত হলেন ধাতবপৃষ্টকে আলোকিত করলে গ্যাস পরিবাহীর মতো আচরণ করে। তখনও ইলেক্ট্রন ছিলো না, সুতরাং তারা বিদ্যুৎ প্রবাহের হার নির্ণয় করে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য, আলোর পরিমাণ পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ প্রবাহের হারের উপরে এসবের প্রভাব নির্ণয় করলেন।
আলোর তরঙ্গ তত্ত্বের ধারণা অনুসারে তরঙ্গের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে তরঙ্গের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তারপরও একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো না হলে গ্যাস পরিবাহীর মতো আচরণ করে না। এটা আলোর পরিমাণের উপর নির্ভর করছে না বরং আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের উপরে নির্ভর করছে।
নির্গত ইলেক্ট্রনের শক্তিও তারা পরিমাপ করলেন এবং লক্ষ্য করলেন নির্গত ইলেক্ট্রনের শক্তিও আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের উপরে নির্ভর করে। এই আবিস্কার সে সময়ের বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। প্রায় ১ দশক গবেষণা শেষে আইনস্টাইন অবশেষে আলোর কণিকা তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন।
প্রাযুক্তিক উন্নতি যদি সময়ের পরিমাপে বেশী হতো তাহলে হয়তো আইনস্টাইনের ফটো ইলেক্ট্রিক ইফেক্টের ব্যখ্যা কিংবা আলোর কণিকা তত্ত্বের উদ্ভব হতো না। নীলস বোর যখন পরমাণুর আভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করলেন তখন থেকেই ফটোইলেক্ট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যা সহজ হলো, সেই ব্যাখ্যার আলোকেই বলতে হবে কেনো প্রাযুক্তিক অনগ্রসরতা আইনস্টাইনের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনেছিলো, আইনস্টাইন ফটইলেক্ট্রিকইফেক্ট ব্যাখ্যার জন্য নোবেল পেয়েছেন।
নীলস বোরের পরমাণু তত্ত্ব বলছে প্রতিটা পরমাণুর চারপাশে নির্ধারিত কক্ষপথে ইলেক্ট্রনগুলো ঘুরতে থাকে, যখন কোনো আলো ইলেক্ট্রনের উপরে পরে তখন ইলেক্ট্রন আলোর শক্তি গ্রহন করে পরবর্তী উচ্চ শক্তিস্তরে চলে যায়, এভাবে নির্দিষ্ট শক্তিসংগ্রহ করে ইলেক্ট্রন পরমাণু ছেড়ে চলে যেতে পারে।
যদি আলোর পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তাহলে বেশী ইলেক্ট্রন আলোর শক্তি সংগ্রহ করে মুক্ত হয়ে যাবে এবং এভাবেই ফটোইলেক্ট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যা করেছেন আইনস্টাইন। তবে আলোর পরিমাণ যাদৃচ্ছিক বাড়ালে কি হবে সেটা আইনস্টাইন তখনও বলে যান নি।
আইন্সটাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবির্ভাবের পরপর এটাকে অভিনন্দিত করলেও পরবর্তীতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিষয়ে তার এক ধরণের সংশয় তৈরি হয় , তার প্রশ্ন ছিলো যদি দুটো ইলেক্ট্রন কক্ষপথের শক্তিব্যবধানের মাঝামাঝি কোনো একটা শক্তির আলোর তরঙ্গ পাঠানো হয় তাহলে কি ঘটবে? ইলেক্ট্রন কি সে আলোর তরঙ্গ গ্রহন করবে না? যদি করেই ফেলে তাহলে তার কি অবস্থান হবে? তার বক্তব্য ছিলো ইলেক্ট্রন সে আলোর তরঙ্গের শক্তি গ্রহন করবে এবং দুটো কক্ষপথের মাঝামাঝি কোথাও অবস্থান করবে, অবশ্য ইলেক্ট্রন সে শক্তি খুব দ্রুতই ত্যাগ করে আগের কক্ষপথে ফিরে আসবে, কিন্তু আইনস্টাইন পরবর্তীতে দেখিয়েছেন যদি আলোর পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয় তবে তাহলে একই সময়ে দুটো কিংবা তারও বেশী আলোর কণিকা গ্রহন করে ইলেক্ট্রন উপরের শক্তিস্তরে চলে যেতে পারে।
যদি প্রাযুক্তিক উৎকর্ষে এখনকার মতো যত ইচ্ছা ফোটন( আলোর কণিকা) তৈরি করা সম্ভব হতো তাহলে ফটোইলেক্ট্রিক ইফেক্ট আবিস্কৃত হতো না। সে সময়ে প্রতিটি ইলেক্ট্রনই দুই কিংবা ততোধিক ফোটন গ্রহন করে ধাতবপৃষ্ট থেকে যেকোনো তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোর জন্য নির্গত হতো, ফলে বিজ্ঞানীরা আর সংশয়ে ভুগতেন না, তাদের পর্যবেক্ষণ এবং ধারণা অক্ষত রয়ে যেতো।
আইনস্টাইনের ফটোইলেক্ট্রিক ইফেক্টের ধারণাটা পরবর্তীতে যেভাবে কোয়ান্টাম বিপ্লব ঘটাতে সহায়ক হয়েছে তেমন আলোড়ন তৈরি করতো না বিষয়টা।