'৭১ এর সুশীল সমাজের ডেফিনিশন আজকের বাংলাদেশে সুশীলদের ডেফিনিশনের মত ছিল না। একটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভালমত কাজ করাতে গেলে যেরকম ভূমিকা ও যোগ্যতা থাকার দরকার তাদের ঠিক তেমনি ছিল। আজকের মত টিভিতে এসে দুটো কথা বলেই তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করতেন না। তারা টকশো সেলিব্রিটি ছিলেন না, প্রত্যেকেই রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত এবং দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত্যেকের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
একটি রাষ্ট্রের ভিত দাঁড়িয়ে থাকে তার শিক্ষার উপরে। আর এটাতেই আঘাত হানতে তৎপর হয় পাকিস্তানি হানার গোষ্ঠী। কারণ একটি জাতিকে যুগ যুগ পিছিয়ে দেবার সবচাইতে সহজ উপায় হচ্ছে তার শিক্ষার কারিগরদের নিঃশেষ করে দেয়া যেটা চরিতার্থ করতেই চেয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার গোষ্ঠী। আর তাদের ডানহাত এক্ষেত্রে ছিল আল বদর ও আল শামস বাহিনী।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অনেক ঘটনা জানা যায় এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডায়েরী থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বঙ্গভবন থেকে রাও ফরমান আলীর একটি ডায়রী পাওয়া যায়; যাতে নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবিদের তালিকা ছিল। এই ডায়রীতেই স্পষ্ট উল্লেখ আছে, আল-বদর তথা, জামাত ও ছাত্র-সংঘ বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের তালিকা তৈরী, হত্যার উদ্দেশ্যে ধরে আনা ও হত্যাকান্ডে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে।
এ ডায়েরী থেকে আরো জানা যায় সিআইএ এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিল। ডায়েরীতে হেইট ও ডুসপিক নামে দুইজন আমেরিকান গোয়েন্দার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ইঙ্গিত আছে।
বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত অরার জন্য আলবদর ও আলশামস বাহিনীকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। এই তালিকা প্রণয়নের মূল কাজ করেন চৌধুরী মঈনুদ্দিন আর এটি এক্সিকিউশনের মূল কাজ করেন আশরাফুজ্জামান। বুদ্ধিজীবিদের নাম-ঠিকানা পাকিস্তানীর কাছে তথা, রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে সরবরাহ করেছিল এই চৌধুরী মঈনুদ্দীন। আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে কটি ডায়েরী উদ্ধার করা হয়, যাতে বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল এবং এই বুদ্ধিজীবিরা সবাই শহীদ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালে আশরাফুজ্জামানের গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিন বলেন, রায়ের বাজার ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে আশরাফুজ্জামান নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল।
দেশ স্বাধীন হবার পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড তদন্তের প্রথম উদ্যোগ নেন জহির রায়হান। "বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড অনুসন্ধান কমিটির" প্রথম আহবায়ক ছিলেন তিনি। ফলাফল জহির রায়হানের চিরতে নিখোঁজ হওয়া।
বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবি ৪২ জন, সাংবাদিক ১৩ জন ও অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) ১৬ জন।
আজকে হয়তো আমাদের এসব সূর্যসন্তানরা বেঁচে থাকলে আমরা এক অন্য বাংলাদেশ দেখতে পেতাম। কিন্তু পাকিস্তানি বরাহের দল আর এদেশী জারজ সন্তানদের জন্য আজকের দিনে আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষদের হারিয়েছি। আজকে সেইসব শহীদদের জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাদেরকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ গড়ার শপথ তো আমাদেরই নিতে হবে।