somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবিতার অদৃশ্য গল্প

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৫:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[কবিতা নিজে যেমন কখনো কখনো কোনো না কোনো গল্পের ওপর ভর করে সবিশেষ কবিতা হয়ে ওঠে, আবার অনেক কবিতারই রচিত হওয়ার নেপথ্যে থাকে চমকপ্রদ গল্প। কারণ একটি কবিতা যখন কবির মগজে নির্মিত হতে থাকে, তার আড়ালে থাকে নানা ঘটনা, উপাদান, উদ্দীপনা এবং দৃশ্য-অদৃশ্য বিষয়-আশয়। এসবের মধ্যে কিংবা পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে গল্পের বীজ। সব গল্পই যে খুব আকর্ষণীয় কিংবা চমকপ্রদ, তা হয়তো নয়, কিন্তু এমন কিছু কিছু কবিতা আছে যেগুলোর রচিত হওয়ার গল্পগুলিও কবিতার মতোই আকর্ষণীয়। তেমনি কয়েকটি কবিতার নেপথ্য-গল্প নিয়ে এই রচনা। কবিতাগুলির সঙ্গে নিচের এ আলোচনা কবিতার কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নয়, কেবলি কবির নিজের কিংবা কবিতাগুলির আড়ালের গল্প]

১.
নারায়ণের ঘাট

নারায়ণ তিতাসের এক খেয়াঘাটের মাঝি। এই তিতাস অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস নয়, কিন্তু তারই হয়তো কোনো এক শাখা। এটি কুমিল্লার হোমনা ও মুরাদনগরের সীমান্ত নির্ধারণ করেছে যে এলাকা দিয়ে তারই একটি গ্রাম রঘুনাথপুর, আমার মামার বাড়ি। আমার শৈশবের বহু স্বপ্ন ও স্মৃতি এই তিতাস আর রঘুনাথপুরকে ঘিরে। এর মধ্যে একটি বড় জায়গাজুড়ে আছেন নারায়ণ মাঝি এবং তার খেয়াঘাট। তিতাসের প্রায় পাড় ঘেঁষেই আমার নানার ভিটে। নদীটাও প্রায় মৃত, কেবল বর্ষাতেই তার খানিকটা জৌলুস টের পাওয়া যায়। যদিও এই নদী একদিন ছিল গভীর ও তীব্র, অনেক ভাঙাগড়ার গল্প আছে তাকে জড়িয়ে। নানীর মুখে শুনেছি, এই নদী বেয়ে এসেই জলডাকাতরা বারবার লুটে নিয়েছে তার সোনায় গড়া সংসারের বহু মূল্যবান জিনিস, আবার গড়েছেন, আবার ছিনিয়ে নিয়ে গেছে লুটেরারা। কিন্তু আমার শৈশবে নদীটার সেই ঐশ্বর্য ছিল না আর, তবু সে ছিল এক নদী। বহু বিকেল-সন্ধে-রাত এই তিতাসের তীরে কত যে সুন্দর কেটেছে, ভাষা তার সামান্যই প্রকাশ করতে পারবে। আমার ষষ্ঠতম মামা প্রাণ খুলে গাইতেন রবীন্দ্র-নজরুল, আমি আর মৌন তিতাস তার গভীর শ্রোতা। অন্যদিকে নারায়ণের ঘাটটি ছিল আমার আরেক প্রিয় জায়গা। মামাবাড়ি গেলে সুযোগ পেলেই ছুটে যেতাম তার খেয়ায়, মনের সুখে তার নাওয়ে তিতাসের এপার-ওপার করতাম। দেখতাম কত পথিকের খেয়া পারপার। কখনো ঘাটে বসে গল্প জমাতাম নারায়ণ মাঝির সঙ্গে, তাকে ডাকতাম নানা বলে।
কিন্তু সুনীল শৈশব একদিন শেষ হয়, জীবন তার রুক্ষ নির্মমতা নিয়ে হাজির হয়, নিয়তির হাতে ছিন্নভিন্ন হতে হতে পৃথিবীর পথে নগরের ছায়ায় বেড়ে উঠতে যাই।
তারপর কেটে গেছে বহুদিন, আমি কিশোর থেকে তরুণ হয়েছি, নানা ঘাটে জল খেয়ে তিলোত্তমা নগরীতে নিয়তি নির্ধারণ করেছি। নানা টানাপোড়েনে বহুদিন যাওয়া হয়নি তিতাসের কোলে, হয়তো তেমন করে আর মনেও পড়ে না। সে কেবল এক দূরস্মৃতি, নারায়ণও যেন অনন্তকাল ধরে বসে আছেন তিতাসের ঘাটে আর দেখছেন তার আজন্মের সাথী নদীটির মৃত্যু। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখলাম কিছুই হারায়নি, কিন্তু বদলে গেছি আমি, আমার দেখা আর আমার জীবন।
একরাতে, সময়টা বোধহয় ১৯৯৮-৯৯র কোনো এক হিমেল দিন, যখন আমি পত্রিকা অফিসের কাজ সেরে পান্থপথের নির্জন পথ বেয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছি, অনেকটা আকস্মিকভাবেই আমার ওপর ভর করলেন নারায়ণ মাঝি, তিতাস আর আমার প্রিয় হারানো শৈশব। বাসায় ফিরে সঙ্গে সঙ্গেই নামিয়ে ফেললাম এই কবিতাটি :

নারায়ণের ঘাটে গিয়েছি কতদিন
তবু আজও মনে হয়, আমি কি দেখেছি
তোমায় মাঝি, হে নারায়ণ, দেখেছি কি
কোনো জন্মে, তিতাসপাড়ে?

কত কৈশোরসন্ধে ও কুমারীসদৃশ ভোর
গোধূলিবিকেল আর ঘরেফেরা পাখিসন্ধ্যায়
আমি হেঁটেছি, হেঁটে হেঁটে
চলে গেছি তিতাসহিজলছায়া মেখে...

আর অনেক অনেক রাতে সৌরজ্যোৎস্না
মেখেছি তিতাসহাওয়ায় আর গভীর
গভীর শুনেছি দূরগামী দাঁড়িদের
নিশি-জাগার শব্দ, পাখিডানার গান...

তবু, আজ, এই নির্ঘুম, শাহরিক রাতে
মনে হয়, তিতাস দেখিনি আমি কোনোদিন
দেখিনি তিতাসছায়া, সেই নারায়ণ মাঝিকে
কখনো দেখিনি আমি এই জন্মে
দেখেছি কেবল নদীর শব আর রক্ত
আর ধূলিদীর্ণ এক নারায়ণ-মুখ।

২.
উপকূলে পাখিহত্যা হচ্ছে

কবিতা বড়ই রহস্যময়ী। সে যে কখন কীভাবে মনের গোপনে ঘর বাঁধে, টের পাওয়া যায় না কিছুই। কখনো একটা অনুভব হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই একটি কবিতা হয়ে ঝরে পড়ে, কোনোটা হয়তো একটা বোধ বা পঙ্ক্তি হয়ে অনুরণন তোলে কিন্তু সম্পূর্ণ কবিতা হয়ে উঠে না কখনো। আবার কোনো একটা দৃশ্য বা ঘটনা হয়তো মনের ভেতরে ঝড় তোলে, উত্তেজিত-সংক্ষুব্ধ করে, কিন্তু তাৎক্ষণিক কোনো ফসল তাতে তৈরি হয় না। কিন্তু অবচেতনে সে খেলা করতে থাকে, অনেক কিছুর মধ্যে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে থাকে। বহুকাল পর নিজেকে যখন প্রকাশ করে তখন হয়তো কবির এক ধরনের গভীর ক্যাথারসিসই অনুভূত হয়। কারণ সজ্ঞানে না হলেও তিনি এর জন্য একটি অদৃশ্য চাপ হয়তো নিজের অজান্তেই বয়ে বেড়াচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি তা তখনি টের পেলেন, যখন তা মাথা থেকে কাগজে নেমে পড়লো।
এই কবিতাটির ঘটনাও অনেকটা এরকমই।
কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ তখন কাজ করতেন উপকূলীয় উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট-এ। তারই আমন্ত্রণ ও প্ররোচনায় এবং কোস্টের প্রযত্নে আমার সত্যিকারের উপকূল সন্দর্শন হয়। তো সেবার, ২০০২ কিংবা ০৩-এ, দ্বিতীয় দফায় আমি গিয়েছিলাম ভোলায় উপকূল আর চরের জীবন ও প্রকৃতিকে পাঠ করতে। আমরা ট্রলারে করে কয়েকজন সাংবাদিক ও কোস্ট কর্মকর্তা বেরিয়েছি চর-দর্শনে। যখন ফিরে আসছি, চর কুকরিমুকরির কাছে এসে দেখলাম, দূরে একটি ট্রলার থামিয়ে ছোট একটি নৌকোয় করে অতিথি পাখি শিকার চলছে। বন্দুকের শব্দে আমরা সচকিত হলাম এবং নৌকাটিকে তাড়া করলাম। শিকারিরা তড়িঘড়ি করে পালাল। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেকগুলো পাখি শিকারিদের হাতে মারা পড়েছে। এরই মধ্যে জানতে পেলাম, শিকারিরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় এক পাণ্ডার চেলা এবং তারা এখানকার বন বিভাগের অবৈধ-অনুমতি আদায় করে পাখিহত্যার মউজে মেতেছেন। মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেল। অগত্যা ট্রলারের সহকারীকে পানিতে নামিয়ে দু-তিনটি নিহত পাখি উদ্ধার করে ছুটলাম বন কর্মকর্তার কাছে। তিনি কাচুমাচু করে নানা ব্যাখ্যা দিলেন। তাকে বেশ কড়া দু কথা শুনিয়ে ফিরে এলেও মনের মধ্যে একটা গভীর কান্না যেন বেড়ে উঠছিল। ঢাকায় ফিরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি রিপোর্ট লিখি, যা প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয় সম্ভবত ‘উপকূলে নির্বিচারে পাখিহত্যা’ শিরোনামে।
কিন্তু তারপরও বুকের ভেতর যে এর জন্য হাহাকারটি শেষ হয়নি, তা টের পেলাম যখন ঘটনার বহুদিন পর, এক রাতে, আমার ওই সময়ের এক প্রিয় ঠিকানা কবি ওবায়েদ আকাশের হাতিরপুলের বাসায় কবিতাটি আচমকাই লিখিত হয়ে গেল :

উপকূলে হত্যা হচ্ছে পাখি, আহা পাখি
দূরের সবুজ-নীল-উন্মূল পাখি
মৃত্যুকে বুকে নিয়ে মিশে যাচ্ছে ইলিশার জলে...

স্বচ্ছ জলবর্ণে রক্তলাল ছোপরেখা আর চিত্রলতার সঙ্গে
উপকূলে পাখিহত্যা হচ্ছে

উপকূলে পাখিহত্যা হচ্ছে
শহরের সুগম্য বন্দুক শীতের বাতাস কেটে
ঢুকে যাচ্ছে পাখিদের বুকে

সেই পাখি, আহা সেই পাখি, পাখি, পাখি
কোন পাখি? কোন পাখি? কেবলি রক্ত আর ক্রন্দন
স্বপ্ন আর আবাস আর নিমীলিত আকাশ
আহা, যাচ্ছে সব, মিলেমিশে, ইলিশার জলে
উপকূলে, পাখিহত্যা হচ্ছে

উপকূলে পাখিহত্যা হচ্ছে, উপকূলে, পাখি, হত্যা, হচ্ছে
হত্যার গান ছড়িয়ে পড়েছে পাখির রক্ত ও ঘামে

মেঘে মেঘে ছায়া ছায়া হয়ে পাখিদের ডানাগুলো
যেন উড়ন্ত অস্থির মাছ, ডুবসাঁতারে মিশে যাচ্ছে
ইলিশার জলে

৩.
গ্রামগাথা

১৯৮৮ সালের পর থেকেই গ্রামের সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্কটি প্রায় পুরোপুরি চ্যুত, কালেভদ্রে, বিশেষ উপলক্ষে দু-এক দিন গ্রামে অবস্থান করা ছাড়া। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটেছিল এক বড় দুর্ঘটনা। সম্ভবত ১৯৯৫। মারাত্মক হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আমায় আক্রমণ করে বসল। তখন চলছিল একুশের বইমেলা। একটি প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করি। আমার দায়িত্ব বইমেলায়। চোখ পুরোপুরি হলুদ হয়ে গেছে। তবু শরীরে উৎসাহের কমতি নেই। কিন্তু এরই মধ্যে একদিন শাহবাগের আজিজ মার্কেটে গাণ্ডীব-সম্পাদক তপন বড়ুয়া হলুদ চোখ দেখে ধমক দিলেন, সৈকত, করছেন কী! মরবেন তো? শিগগির ডাক্তার দেখান। দেখেন হেপাটাইটিস-বি কিনা। তাহলে কিন্তু মারাত্মক ব্যাপার। তখন সঙ্গে ছিলেন কবি চন্দন কৃষ্ণ পাল। তিনি পরদিনই তার অফিসের কাছে ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার কিছু টেস্ট দিয়ে পরদিন তার চেম্বারে দেখা করতে বললেন।
টেস্টগুলি দেখেই ডাক্তার বললেন, যদি সত্যিই জীবনকে ভালোবাসেন, তাহলে সব কাজ বাদ দিয়ে গ্রামে চলে যান। পুরো তিন মাস আপনার কাজ হলো বিছানায় শুয়ে থাকা আর পরিমিত খাওয়া-দাওয়া। আর কিছুই নয়। এই-ই হলো আপনার চিকিৎসা।
কী আর করা, যতই থাকুক কষ্ট-বেদনা-ক্লান্তি, জীবনটাকে তো শেষ পর্যন্ত ভালোই বাসি, তাই গ্রামের ছেলে আবার গ্রামেই ফিরলাম, নতুন জীবন আর শক্তি নিয়ে আবার শহরে ফিরব বলে। পুরো তিন মাস! বড় আতঙ্কে ছিলাম, শহর যে গতি ও দুর্গতি দিয়েছে, এতে এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, এতদিন গ্রামে থাকা যেন আন্দামানে নির্বাসন। কিন্তু পরিবারের প্রযত্নে আর অনেকগুলো বইয়ের সান্নিধ্যে সময়টা একরকম কাটছিল। এর মধ্যে আরেকটা বিনোদন ছিল, আমাদের লম্বা বাড়িটার শেষ মাথায় ঘাসের মাঠে ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে বিকেল-সন্ধ্যা দেখা আর নানারকম কল্পনা।
আর এইরকম বিকেলগুলোতেই গ্রাম আমার কাছে নতুন করে ধরা দেয়। তার কিছু চিহ্ন ধরা আছে নিচের পাঁচটি খণ্ডকবিতায় :

১.
গোধূলির ধূলি নেই আর, তবু আমাদের গ্রাম
অন্তহীন সৌর-সহোদরা, ধূলিগোধূলিময়...

২.
বিকেলের রোদ এসে শুধুই গল্প জমায় আমাদের
গ্রামে---গ্রামের ঘাসের-গাছেদের সাথে

৩.
সন্ধ্যা নামে, আমাদের গ্রামসন্ধ্যা, পৃথিবীর
রাত্রির সাথে যেনো তার গোপন রাধালীলা

৪.
স্বপ্নের ভেতর আছে এক প্রতি-গ্রাম, এই
গ্রামের আড়ালে---অনৃত-অনঙ্গ আর শোভন-স্বপ্নজ

৫.
হৃদয়ে গ্রামের গল্প অফুরান আর ধানগল্প
যেনো জীবন কেবলি ধানিজমিময়
আমরা কেবলই ফলাই ধান---রুপালিসোনালি ধান
এই ধানগল্প অফুরান...


৪.
অপেক্ষা

কিছু কিছু দৃশ্য আছে যা আমাদের ভাবায়, কল্পনা করতে বাধ্য করে। মাথার ভেতর গেঁথে থাকে। আর তা কখনো কখনো কবিতা হয়ে ঝরে।
তখন ১৯৯৫-৯৬। কাজ করি বাংলাবাজারের একটি প্রকাশনা সংস্থায়। প্রতিদিন আসা-যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া, চা পান ইত্যাদি কারণে বেশ কবারই বাংলাবাজার থেকে প্যারিদাস রোড যাওয়ার মাঝখানের নর্থব্রুক হল রোডের চৌরাস্তায় যেতে হয়। কখনো কখনো বন্ধু কবি মজনু শাহও আমার সঙ্গী। কারণ ও সময়টাতে সেও কাজ করত একটি প্রকাশনায়। তখনই তাকে দেখি। বছর বিশ-পঁচিশের তরুণী সে। সুশ্রী, ছিপছিপে, সহজ সাধারণ সুন্দর। হয়তো শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষয়িত্রী (হয়তো টিউশনি করে)। প্রায় প্রতিদিনই তাকে দেখি। কখনো সে আসছে প্যারিদাস রোড দিয়ে, জুবিলি স্কুলের সামনে দিয়ে, বাংলাবাজার দিয়ে কিংবা যাচ্ছে। কখনো দিনে একাধিকবারও দেখি। হয়তো কেনাকাটা কিংবা কোনো প্রয়োজনে। বড় সহজ তার হাঁটাচলা, ভঙ্গিটাও খুব অভ্যস্ত মানুষের মতো। আশপাশের অনেক দোকানির কাছেই সে পরিচিত। বহুদিন তার চোখে চোখ পড়েছে, সেখানে কোনো বিস্ময় নেই। যেন আমরা উভয়েই উভয়কে চিনি, কিন্তু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করি না, বিরূপতা বা গভীরতাও প্রদর্শন করি না। না, কোনো প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়, কেবলই কৌতূহল। সে কি পরিবারে একা, তার কি অন্য কোনো ভাইবোন নেই? নাকি তার বাবা কিংবা মা শয্যাশায়ী এবং তাদের দেখাশোনা তাকেই করতে হয়? সে কি কখনো ক্লান্ত হয় না, অসুস্থ হয় না? সবসময়ই সে একই রকম সহজ-স্বতঃস্ফূর্ত কীভাবে থাকে? নাকি অন্তরালে কোনো গভীর বেদনা আছে, বাইরেরটা কেবল ছদ্মাবরণ? সে কি কাউকে ভালোবাসে, নাকি ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করে, অথবা তার জন্য কি কেউ অপেক্ষা করে? এসব ভাবনা থেকেই নিচের কবিতাটি :

অপেক্ষা করছে কেউ, তোমার জন্য, সুবোধ সোনালি মেয়ে

অপেক্ষা করছে কবোষ্ণ রাত্রি, নরম চাঁদ, আলোআঁধারি,
অপেক্ষা করছে ঘুম, জাগরণ, নৈঃশব্দ, রতি, স্বপ্ন, স্পর্শ,
উষ্ণ ঠোঁট। দিনে তোমার অপেক্ষা করে ফুটপাথ, কামুক
চোখ, মেয়েদের ঈর্ষান্বিত বোধ। পথ তোমার অপেক্ষা
করে---অপেক্ষা তোমার কর্ম, রোদ্দুর, হাওয়া ও ক্লান্তির

তুমি অপেক্ষা করো স্বপ্নের সফলতার, মগ্ন পৌরুষের,
গাঢ়তর চোখ আর আলোকিত পুত্রকন্যাদের। চুপি চুপি
গাঢ় রাতে গোপন রক্ত ঝরার বেদনা ও পূর্ণতার আনন্দে
তুমি বিস্মিত, আলোকিত ও উন্মোচিত হও।

গোপন আয়নায় দেখো নিজের চোখের তারার সবুজাভ,
শস্যবতী কম্পন।

৫.
স্টেলা, দূরবতী

কখনো কখনো এমন আশ্চর্য জায়গা থেকে কবিতার প্রেরণা আসে কিংবা কবিতা-উৎস তৈরি হয় যে স্বয়ং কবিকেই বিস্মিত হতে হয়। আমরা কি আসলেই বুঝতে পারি, কখন আমাদের হৃদয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আনন্দে কিংবা বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে? নিজের কাছেই মাঝে মাঝে আশ্চর্য মনে হয়। এই কবিতার গল্পটাও তেমনই। কবিতার বাইরে আমার একটি প্রিয় পাঠ্য বিষয় ক্লাসিক উপন্যাসের অনুবাদ। সনতারিখ মনে নেই, তবে বেশ ক বছর আগে, এক রাতে পড়া শুরু করলাম চার্লস ডিকেন্সের গ্রেট এক্সপেকটেশনস। এতই বুঁদ হয়ে গেলাম যে, উপন্যাসটি যখন শেষ হলো, তখন দেখি ভোর। আর যা ঘটল তা অভাবনীয়। উপন্যাসটি আমার ভেতরে জীবিত হয়ে উঠল, মনে হলো উপন্যাসের নায়ক আমিই আর ট্র্যাজিক নায়িকা স্টেলাও যেন আমারই হারানো প্রেমিকা। তাদের সমস্ত বেদনাও যেন আমারই বেদনা। এভাবে এক গভীর আচ্ছন্নতার ভেতর দিয়ে বেশ কদিন পর রচিত হলো নিচের কবিতাটি :

স্টেলা, দূরবতী, কোন দূর-অবগাহনে চলে গেছো তুমি
তোমার নির্জন উঠোনে দাঁড়িয়ে আমি
আকাশে দূরতারাদের শূন্যের
হাতছানি

স্টেলা, আমার হৃদয়, ঈশানে যখন আমি
ছিলাম, নৈর্ঋতে ছিলে তুমি
তবু আমরা দুজন ছিলাম বিন্দুর কাছাকাছি

ছিলাম দুজনে একদিন ভোরের সবুজ রোদ
যখন যেতাম হেঁটে দূরের অরণ্যে


স্টেলা, দূরবতী, কোন লীনভূগোলের দিকে
চলে গেছো তুমি

মনে পড়ে তোমার স্বপ্নধূসর মুখ

তুমি কোনো এক হারানো পৃথিবী

[কবিতাগুলি স্থান পেয়েছে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ
শহর যৌবন ও রাত্রি-তে (২০০৪)।
প্রতিটি আলোচনার ওপরে দেয়া উপ-শিরোনামগুলিই কবিতার নাম]
২৯টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×