সকাল থেকে আজ ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। ভালোই লাগছে। আমি আমার প্রিয় রকিং চেয়ারটাতে বসেছি। কোলের ওপর রবি ঠাকুরের লেখা "গল্পগুচ্ছ"। কতবার যে পড়েছি হিসেব নেই। তাও পড়ছি। আপাতত আর কোন বই নেই যে পড়বো। একটু পড়ছি একটু সামনের দিকে তাকিয়ে দেখছি। বর্ষা কালটা আমার খুব পছন্দের। আমার ঘরের সামনে লাগানো লম্বা বারান্দা। তার সামনে কদম ফুলের গাছটা সাদা হয়ে আছে আর মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে। আজ বই নিয়ে বসেছি ঠিকই কিন্তু একটা পাতাও পড়তে পারছিনা। কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের সামনে। ২০ বছর হবে আমি আমাদের নিজেদের বাসা ছেড়ে এখানে এসে উঠেছি। আসলে নিজে থেকে আসিনি। আমাকে ওরা রেখে গেছে। তখন একটা ভাঙা রঙ ওঠা ঘরে থাকতাম। এখন যে ঘরে আছি সেটা আগেরটার চেয়ে ভালো। ঘরটা ছোট। একাই থাকি আমি। একপাশে একটা টেবিলের ওপর কিছু বই, আমার সবচেয়ে পছন্দের সংগী। আর এক পাশে জানালার সাথে লাগানো আমার ছোট্ট বিছানা। তার পাশে একটা আলনায় আমার পুরোনো রঙ উঠে যাওয়া কিছু শাড়ি আর দুটো শাল। আজ এরকম বৃষ্টির দিনে আমার সকাল সকাল খুব মন খারাপ লাগছে। আজ খুব মনে পড়ছে তাকে। চোখের সামনে পুরোনো স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে বারবার।
তার সাথে যেদিন আমার প্রথম দেখা সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি তখন ক্লাস ১০ এ পড়ি। ছোট বেলা থেকে খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করেছি। আমার বাবার সেই সাধ্য ছিল না যে আমাকে পড়াবে। আমার পড়াশুনার খরচ চালাতেন আমার বাবা যে স্কুলে চাকরি করতেন সেখানকার বাংলার শিক্ষক।আমি তাকে বাংলা দাদু ডাকতাম। মাঝে মাঝে সেই দাদুর বাসায় গিয়ে আমি বই এনে এনে পড়তাম। আমার সেই দাদুর বাসায় মাঝে মাঝে কিছু ছেলে এসে কি নিয়ে সব আলোচনা করতো। সব কঠিন কঠিন বিষয়। আমি ওসব কিছু বুঝিনা। আমি একটু আধটু শুনতাম। কিছুই বুঝতাম না। একবার খুব বৃষ্টিতে আমি দাদুর বাসায় গিয়ে আটকে গিয়েছিলাম। বাসায় যাবো কি করে... মা বকবেন... এসব ভাবছি বসে বসে। এমন সময় আমার পাশে এসে বসলেন এক হ্যাংলা পাতলা ছোকড়া। চোখে মোটা চশমা... মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। আমি খানিকটা বিরক্ত খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে যাবো ভাবছি তখনই তিনি বলে বসলেন "এই বৃষ্টিতে বাসায় যাবেন কি করে ভাবছেন?" আমি খুব অবাক হয়ে তাকালাম কিন্তু মুখে কিছুই বললাম না। "আমি রেখে আসবো? আমার কাছে ছাতা আছে।" আমি কি বলবো না বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। তখন বাংলা দাদু এসে বললেন, "মলি, একা যাবি কি করে মা? যে বৃষ্টি! ছাতাও নেই। ওর সাথে যা। ও তোর বাসার সামনে দিয়েই যাবে।" আমি হ্যা না কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। একবার বাইরে তাকাই একবার দাদুর দিকে তাকাই। তারপর ভাবলাম যা হবার হবে....যাই গে।হেঁটে হেঁটে বাসায় যাচ্ছি। তিনি ছাতা ধরে আছেন। আমি চোখের কোণা দিয়ে মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে দেখছি। বেচারা আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে ভিজে যাচ্ছে। আমার হাসিও পাচ্ছে আবার মায়াও লাগছে। দেখতে দেখতে বাসায় চলে আসলাম। আমি বাসার সামনে এসে থাকলাম। ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় ঢুকে গেলাম। আবার পিছনে তাকিয়ে দেখি তিনিও সামনের দিকে হাঁটতে থাকলেন। এরপরে তাকে দেখলাম আমাদের বাসায় আমার বাবা মার সাথে কথা বলতে। কয়েকদিন পর জানতে পারলাম লোকটার নাম অর্ক আর এই লোকটার সাথে আমার বিয়ে। আমার কদিন পর মাধ্যমিক পরীক্ষা। পরীক্ষার পরেই বিয়ে। বিয়ের দিন তাকে দেখে কেন জানিনা আমার খুব লজ্জা লাগছিল আর বারবার সেইদিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বিয়ের পর আমরা ঢাকায় চলে আসলাম। একটা ছোট্ট খুপরির মত বাসায় উঠলাম সাথে একটা বোচকা করে কিছু শাড়ি আর জামা নিয়ে। চলতে থাকলো আমাদের সুখের সংসার। আমার পড়াশুনা করার ইচ্ছা ছিল। তাই সে আমাকে একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল। বছর ঘুরতেই আমাদের দুইজনের সংসারে তৃতীয় প্রাণের অস্তিত্ব উঁকি দিতে শুরু করলো। আমার শরীর খারাপ হতে শুরু করলো বলে আমার কলেজ যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। ৯ মাস পর আমাদের কোল আলো করে একটা ছোট্ট রাজপুত্র এলো। আমরা খুব সখ করে নাম রাখলাম রাজা। এরপর থেকে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন হতে শুরু হল। আমার তিনি খুব ভালো একটা চাকরি পেলেন। ধীরে ধীরে রাজা বড় হতে থাকলো। সেই সাথে রাজার বাবার পদোন্নতি। এরপর একদিন আমরা নিজেদের জন্য একটা স্বপ্নের মত বাসা পেয়ে গেলাম। ওখানে উঠে সাজাতে লাগলাম আমার স্বপ্নের সংসার। আর রাজাও বড় হতে থাকলো। রাজার বাবা আমাদের দুজনের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। আমার জীবনে সুখের বন্যা এনে দিয়েছে। রাজা একদিন হঠাত করে একটা মেয়েকে নিয়ে এল বিয়ে করে। দেখতে শুনতে সুন্দর মেয়েটা। রাজার সাথে অফিসে চাকরি করে। প্রথম প্রথম ভালোই ছিল। ধীরে ধীরে বুঝলাম মেয়েটা আমাকে আর রাজার বাবাকে নিয়ে এক বাসায় থাকতে চায় না। কদিন পরে ওদের কোলেও এল আরেক রাজপুত্র। রাজপুত্রের ঘরে রাজপুত্র....আমার মানিক। তারপরেও অশান্তি যেন লেগেই থাকলো। এর মাঝেই রাজার বাবা হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়লো। বছর পড়তে না পড়তেই আমাকে ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। যে মানুষ আমাকে একদিনের জন্যও একা থাকতে দেন নি, আমার চোখে কোনদিন জল আসতে দেন নি, তিনি একদিন আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। এর কদিন পরেই আমার জায়গা হল এই বৃদ্ধাশ্রমে। ভালো ভাষায় যাকে বলে "হোম"। প্রথম প্রথম রাজা আসতো দেখতে। এরপর অনেক বছর হয়ে গেল আর আসে না। ২০ বছর ধরে আমি এখানে আছি। এই এখন আমার ঘর...আমার বাসা....আমার জগত।
আজ আমার সকাল থেকে মন খারাপ। সকাল থেকে মনটা আমার ছটফট করছে। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। মানুষটা যখন বেঁচে ছিলেন প্রতি বছর এই দিনে আমরা আমাদের হারমোনিয়ামে সুর তুলে গান গাইতাম। সে আমার জন্য ফুল কিনে এনে আমার খোপায় পড়িয়ে দিত। ২০ বছর ধরে এই হারমোনিয়ামে ধুলো পড়ে আছে। ২০ বছর ধরে আমি এই দিনে তাকে চোখ বন্ধ করে বলতাম..." কই গো? আমার উপহার কই?" এখন আর উপহার পাইনা। শুধু পাই দীর্ঘশ্বাস। আজ সারাটা দিন এভাবেই পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে কেটে গেল।
বিকেল বেলা আমার ঘরের বাড়ান্দায় খুব মিষ্টি একটা রোদ আসে। আমি তখন আমাদের হোমের আমারই মত একাকী বন্ধুদের নিয়ে গল্প করি। এখানে আমরা সবাই খুব একা। সবাই আমরা ভেতরে ভেতরে মরে গেছি। শুধু অপেক্ষা করি কবে কার ডাক আসবে। আজ বিকেলে আমরা সবাই বসে আছি। এমন সময় বাসার সামনে একটা কালো গাড়ী এসে থামলো। গাড়ী থেকে একজন বৃদ্ধ আর এক ছেলে নেমে এল। আমি ৮০ বছরের বৃদ্ধা....চোখে এখন দেখিনা বললেই চলে। তারপরেও আবছা আবছা ভাবে যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে এই যে বৃদ্ধ গাড়ী থেকে নেমে আমাদের এদিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে সাথে একটা স্যুটকেস নিয়ে....একে আমি চিনি। আরেকটু কাছে এসে আমি তাকে খুব ভালো ভাবে চিনতে পারলাম। এ আর কেউ নয়...আমার রাজা। আমার মানিক আজ তার বাবাকে রেখে যেতে এসেছে ঠিক যেভাবে একদিন আমার রাজা আমাকে ফেলে রেখে গেছিল। আমি ধীরে ধীরে হাসলাম। উপরের দিকে তাকিয়ে বললাম, " ও গো...আজ বুঝি এই উপহার দিলে?" আমি উঠে গেলাম আমার চেয়ার ছেড়ে.... মনে মনে বললাম.... কর্মফল কাউকে ছাড়ে না বাবা.... কাউকে না।