২৪শে আগস্ট, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। কজন মানুষ জানেন আমি জানিনা সেটা। এই দিবস হওয়ার পেছনে যে কারণ সেটাও বা ক’জন জানেন আমি জানিনা। আসলে আমিও জানতাম না অনেকদিন। ঘটনা সেই ১৯৯৫ সালে। আজ থেকে ২১ বছর আগের ঘটনা। তখন আমি ক্লাস টু তে পড়তাম। আমার সেই তখনকার কথা খুব একটা মনে পড়ে না। শুধু এত টুকু মনে পড়ে আমাদের স্কুল অনেক দিন বন্ধ ছিল। দিনাজপুরে তখন কার্ফিউ চলছিল। বাসা থেকে বের হওয়া নিষেধ ছিল। আমি ছোট মানুষ। কিছুই বুঝতাম না। শুধু খুব বড় কিছু একটা ঘটছে এটা বুঝতাম। যাই হোক বেশ কদিন চারপাশ বেশ গম্ভীর ছিল। এরপর আর একটু বড় হলাম, দেখতাম দিনাজপুরে প্রতি বছর এই দিনে অনেক মিছিল বেরোত। তখন মা বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ইয়াসমিন নামের একটা মেয়ে খুন হয়। কিছু খারাপ লোক তাকে মেরে ফেলে। এই জন্য প্রতি বছর অন্য কোথাও কি হয় জানিনা, কিন্তু দিনাজপুরে এই দিনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। তখন কিছু খারাপ মানুষ কি করে মেরে ফেললো একটা মেয়েকে তা বুঝতে পারতাম না। এরপর আরো বড় হলাম। তখন জানতে পারলাম আসল ঘটনা।
১৩ বছর বয়সী মেয়ে ইয়াসমিন ঢাকা থেকে দিনাজপুরে ফিরছিল। বাসটি ঠাকুরগাঁ যাচ্ছিল। তাই বাসের স্টাফরা ভোর রাতে ইয়াসমিনকে দিনাজপুর- দশমাইল এর একটা চায়ের দোকানে বসিয়ে রেখে চলে যায় যেন সকাল হলে দিনাজপুরের বাসে তাকে তুলে দেয়া হয় এই বলে। এর কিছুক্ষন পর সেখানে আসে দিনাজপুর কোতয়ালি থানার পুলিশের গাড়ি টহল দিতে। সেখানে ইয়াসমিন কে দেখে তারা তাকে জোড় করে তুলে নিয়ে যায়। এরপরদিন ইয়াসমিন এর লাশ পাওয়া যায় একটা ভ্যান এর ওপর। ধর্ষন করে খুন করে তাকে ফেলে রেখে যায় তারা। এই ঘটনার পর দিনাজপুরে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যায় অনেক আন্দোলনকারীরা। এরপর পুরো দেশেই প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়। দিনাজপুরের পরিস্থিতি সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিল দিনাজপুরের পুলিশ বাহিনি। তখন ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারি করা হয়। অনেক আন্দোলন এর পর অবশেষে অপরাধীদের বিচার হয়। ২০০৪ সালে তাদের ফাঁসি হয়।
এই কারণে প্রতি বছর ২৪ শে আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আজ ২১ বছর পরেও এখন মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তোলে, আসলে আমাদের এই সমাজে নারীরা ঠিক কতটুকু নিরাপদ? ইয়াসমিন হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা কি পরিবর্তন হয়েছে? তনু, সোমা সহ আরো কত কত মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে। তাদের বিচার হচ্ছে কি? জানিনা আমি, আমাদের দেশ ঠিক কতটুকু এগিয়েছে? এখন নারীরা ঠিক কতটুকু নিরাপদ এই ডিজিটাল যুগে? এই যে কদিন পর পর আমাদের দেশে এখানে সেখানে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে, কিন্তু তাদের বিচার হচ্ছে কোথায়? একটা ঘটনার নিচে আরেকটা ঘটনা চাপা পড়ে যায়। একটা খুনের নিচে আরেকটা খুনের ঘটনা ঢাকা পড়ে যায়। আমরা বাঙ্গালিরা আবার ভুলেও যাই। নতুন নতুন সংবাদে আমরা পুরোনো ঘটনাগুলোকে ভুলে যাই। তনু হত্যার সময় কদিন বেশ আলোচনা হল, এরপর সব ঠান্ডা। কোথায় গেল তাদের অপরাধীরা? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, আচ্ছা এই যে, যে সব অপরাধীরা পায়ের ওপর পা তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা নারী দিবসে কি করে? তাদের বাসাতেও মা, বোন, বউ তো আছে। তারা নিশ্চয় কিছুটা হলেও বুঝতে পারে যে তাদেরই বাবা-ভাইরা এই অপরাধগুলো করছে। সেই মা- বোন-বউরা কি করে মেনে নিয়ে আছে?তাদের কি একবারও মনে হয় না যে খুনিদের তারা প্রশ্রয় দিচ্ছে, এদের শাস্তি হচ্ছে না বলে, ঘরে ঘরে আরো খুনির জন্ম হচ্ছে? আর সবচেয়ে অবাক লাগে আমার এটা ভাবলে, আমাদের দেশ চালাচ্ছে নারীরা। সে প্রধানমন্ত্রী হোক বা বিরোধি দলের নেত্রী। তারা থাকতেও আমাদের দেশে এই রকম অপরাধ চলছে তো চলছেই। কিন্তু তার কোন বিচার হচ্ছেনা, অপরাধীরা দিব্যি আইন ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। জানিনা কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে আমরা মুক্তি পাবো? কবে এইসব অপরাধীদের বিচার হবে। তবে আমি এটা মনে প্রাণে আশা করি, আমরা নিজেরা যদি শক্ত হই, অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করি, তাহলে হয়তো আমরাই এই সব অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারবো। শুধু তাই না, আমাদের সমাজকে কলুষিত হওয়ার থেকে রক্ষা করতে পারবো। আমাদের এখনও অনেক বাঁধা পেরোতে হবে। আমাদের হেরে গেলে চলবে না। আরো শক্ত হয়ে আমাদের লড়াই করতে হবে। নাহলে প্রতি বছর ঠিক এভাবেই আমাদের দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে হবে।