somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খুনীদের ক্ষমা না করার চোয়ালচাপা জেদ

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খুনীদের ক্ষমা না করার চোয়ালচাপা জেদ
অনিকেত চক্রবর্তী

ঈদের চাঁদ দেখা গেল কীনা, মনের মধ্যে সেই কৌতূহলের ন্যূনতম উঁকি পর্যন্ত নেই।
নেই আরো অনেক কিছু। যেমন, রাতেই দুধের মধ্যে খেজুর মিশিয়ে খুরমা বানানোর তাগিদ নেই। ভোররাতেই চুলায় আগুন দিয়ে সেমুইয়ের পায়েস রাঁধার ইচ্ছা নেই। সাতসকালেই গোসল করে নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ ‍‌মেখে সামনেই মিতালী সঙ্ঘের মাঠে দৌড়ে গিয়ে জড়ো হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই। আলিঙ্গনের উষ্ণ সান্নিধ্যে একে অপরকে কাছে টেনে নেওয়ার ছবি উপহার দেওয়ার ইচ্ছা নেই।
যা আছে, তাহলো, চারঘরের এক উঠোনে খা খা করা শূন্যতা।
অথচ বারুইপুর-ক্যানিং রোড ধরে এগিয়ে, ঘুটিয়ারি শরিফ যাওয়ার সড়কে পথের দাবি মোড় পেরিয়ে, গরিবদের মধ্যে বিলি হয়ে যাওয়া ‘মুখার্জিদের চরজমি’কে ডানদিকে রেখে, ক্যানিং-২ নং ব্লকের নারায়ণপুর গ্রামে আসার এতটা পথ জুড়ে তো দেখা গেল, কত বড় বড় তোরণ! রাস্তার মোড়ে মোড়ে। তাতে লেখা ‘ঈদ মুবারক’। লেখা ঈদ উদ্‌যাপন কমিটির নাম। সেমুইয়ের দোকানে ভিড়। কাচের রঙিন চুড়ি থেকে শুরু করে জামাকাপড়ের দোকানেও ভিড়। কত আয়োজন! কত উৎসাহ! কত হাসি! কত কথা!
কিন্তু নারায়ণপুর গ্রামে মাদার আলি মোল্লার ভিটেয় সব নিঃস্তব্ধ। উঠোনটা খা খা করছে সুন্দরী বেওয়ার বুকভাঙা শূন্যতার মতোই।
সেই নিঃস্তব্ধ উঠোনে একটা দড়িতে রোদে মেলা কিছু মলিন জামাকাপড় ঝুলছিলো। এককোণে এনামেলের হাঁড়ি কাত করে লম্বা গলা ঢুকিয়ে খাবার খুঁটে খাচ্ছিলো তিনটে হাঁস। রাত পোহালে যে ঈদ, তা এই উঠোনে টের পাবে না ঈদের চাঁদও।
দরমার বেড়া দেওয়া টিনের চালার যে ঘরটাতে মাদার আলি মোল্লা থাকতেন, দরজা ঠেলে তার ভিতরে চোখ ফেলে মলিন আলোর মধ্যেই দুটো তক্তপোশ, গুটিয়ে রাখা মশারি, একজোড়া চটি দেখতে দেখতে মনে পড়ছিলো হাওড়ার কল্যাণপুরের বাকসিহাটের কিশোর শেখ বাবুয়ার কথা। সি পি আই (এম)-কে সমর্থন করার অপরাধে গত ৮ই মে তৃণমূলীরা শেখ বাবুয়ার মুখ মাথা উড়িয়ে দিয়েছিলো বোমার স্প্লিন্টারে। মনে পড়ছিলো বাগনানের রবিভাগ পূর্বপাড়ার দিনমজুর শেখ সাইদুলের কথা। প্রথমে তরোয়াল, তারপর গুলি, শেষে বোমা মেরে যাকে খুন করেছিলো তৃণমূলীরা সেই ৮ই মে’র দিনটিতেই। মনে পড়ছিলো বহরমপুরের রাস্তায় ১২ই জুন কংগ্রেসীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নিমতলার এক্রামূল হকের কথা। মনে পড়ছিল মুর্শিদাবাদের রানীনগরের চরবাথানে শেখ মনতাজের কথা। মনে পড়ছিলো আরো কত শহীদ কমরেডের কথা। যাঁদের পরিচয়, তাঁরা সংখ্যালঘু কিনা তার চেয়েও বড় কথা তাঁরা মানুষ ছিলেন। সি পি আই (এম)-কে জীবন দিয়ে ভালবাসতেন। প্রাণ দিতেও পিছপা হতে না চাওয়া মানুষের কাছাকাছি মানবদরদী ছিলেন। ক্যানিংয়ের নারায়ণপুর গ্রামের মাদার আলি মোল্লা ছিলেন তাঁদের মত একজন।
১৭ই আগস্ট সকালে ঘুটিয়ারি শরিফ স্টেশনের সামনে বাজারের ভিতরে তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা মাদার আলি মোল্লার মাথায় পিছনে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে খুন করছে সেই মানুষটিকে। কিছু বলার, কিছু দেখার সুযোগ পাননি তিনি। হাড়োয়ার আলাউদ্দিন মোল্লা তবুও সুযোগ পেয়েছিলেন হানাদার দুষ্কৃতীদের অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়েও ঘৃণা প্রকাশ করার। ঘরছাড়া ছিলেন বহুদিন। তৃণমূলী সন্ত্রাসে। যেদিন সেই মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রামে ফিরবেন বলে ঠিক হয়েছিলো, বিবিকে খবর দিয়েছিলেন গরম ভাত রেঁধে রাখতে। অনেকদিন খাওয়া হয়নি গরম ভাত। ঘরে ফিরে খাবেন। মেয়ে মিষ্টি বিলি করেছিলো গ্রামে। আব্বা ফিরবেন, সেই আনন্দে। হাড়োয়ায় ঘুসিঘাটায় সেদিন আলাউদ্দিন মোল্লা আসামাত্র তৃণমূলীরা তাড়া করে খুনের উদ্দেশে। একটি বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন প্রবীণ সেই শিক্ষক। রেয়াত করেনি দুষ্কৃতীরা। সি পি আই (এম) করেন। অতএব গুলি করে সেই বাড়িতেই হত্যার শিকার হয়েছিলেন তিনি। সামনের ২০শে অক্টোবর সেই মৃত্যু পা দেবে এক বছরে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে বলেছিলেন তিনি, ‘আমি একজন শিক্ষক। তোমরা ছাত্রের মতো...।’
কিন্তু নারায়ণপুর গ্রামের মাদার আলি মোল্লা কথা বলারই সুযোগ পাননি। বাজারে কিছু একটা কেনার জন্য ঝুঁকেছিলেন তিনি। তখনই ওত পেতে থাকা দুষ্কৃতীরা হানা দিয়ে মাথার পিছনে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। শহীদ হয়ে যান তিনি।
সেই মাদার আলি মোল্লার ভিটেয় উঠোনে পা দিয়ে, ঘরের দাওয়ায় উঠে ষাট ছুঁই ছুঁই সুন্দরী বেওয়ার মুখোমুখি বসে মোটা কাচের চশমার আড়ালে তাঁর চোখের জল দেখার কষ্টের চেয়েও গর্বে বুক ফুললো তাঁর মুখে স্বামীর কথা শুনে। ‘‘সকালে উঠে চা খেয়েই বাইরে বের হয়ে যেতেন পার্টির কাজে। কত মানুষের সঙ্গে তাঁর কত কথা। বলতাম, তুমি যে এত পার্টি করো, পার্টি তোমায় কী দিয়েছে বলো। উনি বলতেন, পার্টি কেন দেবে ? পার্টিকেই তো দেখতে হবে আমাদের।’’
তাই বলে পরিবারকে অবহেলা করতেন না মাদার আলি মোল্লা। যতটুকু যেভাবে করা যায়! প্রতি বছরের মতো গতবারও এমন ঈদের দিনে পরিবারে চার ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি সবার জন্য মনে করে নতুন জামাকাপড় নিয়ে এসেছিলেন তিনি। ঈদ হয়েছিলো ঈদের মতোই। কিন্তু এবার ? নারায়ণপুরেরই বাসিন্দা জালাল সর্দার জিজ্ঞাসা করেছিলেন রোকেয়া মোল্লাকে, জামাকাপড় কিনেছ ঈদের জন্য ? মাদার আলি মোল্লার ভাইপো’র স্ত্রী, গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রোকেয়া মোল্লা তাঁকে উত্তর দিয়েছেন, ‘কী আর কেনাকাটা করবো ? মনে শান্তি নেই যে !’
শান্তি সত্যিই নেই ।
যেদিন মরদেহ থেকে লালপতাকা সরিয়ে বাদামতলায় মাটি দেওয়া হচ্ছিল মাদার আলি মোল্লাকে, সেদিনও, ওই সময়েও বোমা ছুঁড়েছিল তৃণমূলীরা। ছেলে শাহ আলম বললেন, ‘‘পরশুদিনও ফোনে ওরা হুমকি দিয়েছে। বলেছে, তবুও পার্টি ছাড়ছিস না তো তোরা ! দেখবি এবার। বাপকে নিয়েছি। তোদেরও নেব।’’
ভয় লাগে না ?
এবার উত্তর দেন আরেক ছেলে সাজাহান মোল্লা। ‘ভয় ? কেন ভয় করবো ? আমরা গ্রামের সবাই আরো একজোট।’ শহীদ পরিবারের উঠোনে শুধু শূন্যতা নেই। এই প্রতিজ্ঞাও আছে।
এভাবেই শূন্যতার মধ্যেও প্রতিজ্ঞা নিয়ে বেঁচে থাকা এবার ঈদের দিনে। মাদার আলি মোল্লা, জয়নাল আবেদিন মোল্লা, আবুর আলি মণ্ডল, হোসেন মণ্ডলসহ রাজ্যের আরো অনেক শহীদ পরিবারের। উৎসব এসেছে বটে। কিন্তু এইসব পরিবারে সেই উৎসবের আবাহনও নেই, বিসর্জনও নেই। আছে খুনীদের ক্ষমা না করার চোয়ালচাপা জেদ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×