ভারত ব্রহ্মপুত্র নদের বিপুল পানি ভাণ্ডার সরিয়ে নিতে নির্মাণ করছে বহুসংখ্যক জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প। ব্রহ্মপুত্র নদের যেসব উপনদী রয়েছে সেগুলো থেকে পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এতে ব্রহ্মপুত্রের মূল উৎসই শুধু নয়, অন্যান্য উৎসের পানি থেকেও বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে প্রমত্তা যমুনা মরা নদীতে রূপ নিচ্ছে। দেশের পরিবেশ, পানিসম্পদ, কৃষি অর্থনীতি এবং নৌপথে যোগাযোগ হুমকিতে পড়েছে।
ভারতের উৎসমুখ থেকে আসা ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর প্রবাহ একসাথে ধারণ করে যমুনা নদী বিশাল জলরাশি নিয়ে বিস্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবহমান ছিল। কিন্তু ভারতের অংশের ব্রহ্মপুত্রে বহুসংখ্যক পানিবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণের কারণে পানিপ্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া যমুনা নদীতে ব্রিজ নির্মাণের ফলে স্বাভাবিক স্রোতধারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ব্রিজের উজানে ও ভাটিতে নদীতে বিশাল স্থায়ী চর সৃষ্টি হয়েছে। নদীর মূলধারা সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ছে। স্থায়ী চরগুলোতেও গড়ে উঠছে জনবসতি।
জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি তিব্বতের মানস সরোবরের কাছে চেমাইয়াংডুং হিমবাহে। ব্রহ্মপুত্র নদ উত্তর-পূর্বে পুরো আসামের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ৮০১ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে আসামের ধুবড়ি শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দণি-পূর্ব কোণে কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর-পূর্ব কোণ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কুড়িগ্রাম, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জেলার পূর্ব প্রান্ত দিয়ে এ নদ প্রবহমান।
জানা যায়, ভারত যমুনার মূল নদী ব্রহ্মপুত্রে পানির বেশ কয়েকটি সঞ্চয়াগার নির্মাণ করছে। তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের উন্নয়ন পরিকল্পনা মোতাবেক এ নদীর ওপর ১৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নিয়েছে। এসব বাঁধ প্রকল্প পূর্ব ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করবে। তবে এই প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ ভূমিতে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম উৎস ও প্রদায়ক রাঙ্গা নদীর ওপর ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে। ব্রহ্মপুত্রে পানিপ্রবাহ হ্রাস পাওয়া এর অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। আসামে ব্রহ্মপুত্র নদের অন্যতম উৎস পাগলাদিয়ায় একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণ করছে ভারত। এতে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অংশে পানির সঙ্কট হচ্ছে। ভারত ব্রহ্মপুত্রের আরেক উৎস লাংপি নদীর ওপর একটি বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহ আটকে দিয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনার প্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস রাইডাক নদীতে ভুটান-ভারত যৌথ উদ্যোগে বৃহৎ একটি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য যে পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে তাতে ব্রহ্মপুত্র নদে পানির সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের অন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস কপিলি নদীকে কেন্দ্র করে ভারত বেশ ক’টি বাঁধ ও রিজার্ভার নির্মাণ করেছে। সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন এই বাঁধ প্রকল্পের ল্য। এটি নির্মিত হওয়ায় ব্রহ্মপুত্রে পানিপ্রবাহে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের গুরুত্বপূর্ণ উৎস সুবানসিঁড়ি নদীর পানি প্রত্যাহারসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে হাত দিয়েছে ভারত। এ ছাড়া ভারতের নাগাল্যান্ডে ডয়াং নদীর ওপর নির্মিত একটি ড্যাম ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করছে।
ব্রহ্মপুত্রের অন্য উৎস উমিয়াম নদীতে বাঁধ দিয়ে অন্তত চারটি বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করেছে ভারত। এই প্রকল্পের আওতায় ব্রহ্মপুত্রের উপনদী উমিয়ামের পানি সরিয়ে নিয়ে উপক্র নদীতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। পানি প্রত্যাহারের ফলে কার্যত এই অন্যতম উপনদীর পানি থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ প্রায় সম্পূর্ণ বঞ্চিত হচ্ছে।
ভারত তিস্তা নদীর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করায় শুধু তিস্তার প্রবাহই ব্যাপক হারে কমে যায়নি, যমুনা নদীতে তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফলে নদী ভরাট হয়ে বিশাল চর পড়েছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নতুন বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এর সব শাখা-উপশাখা নদী প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাবে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভারত ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে যেসব প্রকল্প গড়ে তুলেছে এর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ভারত তার পরিকল্পনা মোতাবেক গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র দু’টি নদী অববাহিকায় পানির ৩৩টি সঞ্চয়াগার নির্মাণ করবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারত এসব সঞ্চয়াগারের মাধ্যমে ধরে রাখতে সম হবে ৫০ লাখ কিউসেক পানি। বাড়তি ১৫ লাখ কিউসেক পানির ঘাটতি বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ে ঠেলে দেবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদীবিশেষজ্ঞ কামরুন নেছা বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ কমে আসবে। শুকনো মওসুমে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ পানির উৎস। এই নদী দিয়ে পানি আসা কমে গেলে বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। ভারত চাইলে একতরফাভাবে যৌথ নদীর ওপর এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের সাথে বাংলাদেশের নিবিড় আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলতে হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।