somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাবান জিনিসটা কী, জানেই না ভাইবোন

২৩ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছেলেটির নাম নাজিব। বাচ্চা মেয়েটি তার বোন। শাবানা। এরা যে মুলুকে থাকে, সেটি নিতান্তই পাণ্ডববর্জিত। সেখানে বাতাসে পাক খায় ধুলো। ধুলোর গায়ে তাত। খর রৌদ্রের তাত। সেই রোদ ঠিকরে আসে খটখটে নীল আকাশ থেকে। নীল আকাশে ছায়ার খোঁজে ভেসে বেড়ায় শুকনো মুখের, ফর্সা সব মেঘ। সন্ধেয় তারা ঘুমোতে যায় ঢেউ খেলানো দিগন্তের দিকে। এক দিকে পাঁচমাঢ়ি। অন্য দিক হোসঙ্গাবাদ। মাঝখানে এক নিঝুম জগৎ। পিপারিয়, ভারত।
সেই স্টেশনে কিছু কিছু মানুষ নামেন অবশ্য। অরণ্য-সাফারির জন্য গাড়ি মেলে বেশ সস্তায়। যারা নামেন সেখানে, তাঁরাই দেখতে পান এই ভাইবোনটিকে। প্ল্যাটফর্মের শান ফুঁড়ে উঠেছে যে ঝাঁকড়া পিপুল, তারই ছায়ায় ঠাঁই নিয়েছে দু’জন। যদিও শীতের সূর্য, তবু পিপুলের পাতা সূর্যের ওমটুকু গুঁড়ো গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দেয় নীচে এই দু’জনের শরীরে। সেই ছায়াতেই দিব্যি খেলাধুলো, আর জল চাইলে, ওই যে, একটু দূরেই প্ল্যাটফর্মের কল। তার গ্রানাইট বেসিনের গায়ে বড় বড় করে দেবনাগরীতে লেখা, ‘ভিকলাঙ্গোঁ কে লিয়ে’! তা থাক, নির্বিবাদে সেই জল-কল ব্যবহার করে ওরা। পান থেকে স্নান পর্যন্ত নানাবিধ কাজে। আমি যখন নাজিবকে দেখলাম, সে খুব মন দিয়ে তার পায়ে একটুকরো পাথর ঘষছিল। ফুটিফাটা পায়ে যেন শতাব্দীর ধুলো। পাথর ছাড়া কে-ই বা দূর করবে সেই মালিন্য? নাজিবের ছোট্ট পায়ে পাথরখণ্ড ওঠানামা করে। জল নেওয়ার মগ নেই, কিন্তু তাতে কী? একটা আধভাঙা স্টিলের টিফিনবাটি, ওটাই দিব্যি মগের কাজ চালিয়ে দিচ্ছে। দেখতে দেখতে প্রথমে বিস্ময়, অতঃপর মধ্যবিত্ত মায়া জাগে আচমকা। আহা, এরা কি কখনও সাবান পায়নি? হোটেল থেকে পাওয়া একটুকরো সাবান দিই ওকে। সঙ্গে একটা শিশিতে একটু তেল। আর, ডিটারজেন্ট-এর কয়েকটি স্যাশে! সেই সম্পদ হাতে পেয়ে বেশ খানিকটা হতভম্ব হয়ে পড়ে নাজিব। এ তো ভারি রঙ্গ জাদু! এ সব দিয়ে যে কী হবে, সেই কথা তার মাথার মধ্যেই আসে না। নাজিবের সাবান কেনার পয়সা নেই, কথাটি সত্যি। আসলে, অর্ধেক সত্যি। নাজিব কখনও সাবান চোখেই দেখেনি।
তার বোনের অবশ্য এই সংকট নেই। কচি শিশু, কথা ফোটে নাই। সে দাদার পাশে বসেই ছিল, দেখামাত্র থপথপিয়ে এগিয়ে আসে। তারপর, সাবানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, আর আরাম করে সাবানের টুকরোটা চেটে দেখে, স্বাদটা কী রকম!
ক্রমে আলো আসে। নাজিবের মাথায়। যে মুহূর্তে সে বোঝে, এই বস্তুটি দিয়ে ময়লা-টয়লা দূর করা যায়, তৎক্ষণাৎ সে নিজের পা-টা ধুয়ে ফেলে। টিফিনবাটিটা মাজাঘষা করে নেয় একটু। তখনই স্নানটাও সেরে নিতে পারত। কিন্তু, তা করে না। বরং, দৌড়ে গিয়ে বোনটাকে টেনে আনে কলের কাছে। জামাকাপড় ছাড়িয়ে দেয়। তারপর, সারা গা ভাল করে সাবান দিয়ে ঘষে দেয়। ভয় ছিল, পাছে নিজের স্নানটা সারতে গিয়ে ওইটুকু সাবান ফুরিয়ে যায়। তাই, বিরল বস্তুটি থাকতে থাকতে বোনটাকে আগে স্নান করিয়ে দেয়। প্রথমে তো সেই মেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা। তারপর, টু শব্দটি করে না। বেশ আরামই লাগে হয়তো, তাই দিব্যি উপভোগ করে এই স্নানবিলাস। অবশ্য, একসময় ফেনামাখা জল চোখে ঢুকে যেতেই কান্না। জল-টল ঢেলে চোখটা ধুইয়ে দেওয়ার পরে সে ফের ঠাণ্ডা।


তখন কোত্থেকে তার দাদা হাজির করে তোবড়ানো এক বাক্স। তার থেকে বেরোয় ভাঙা একটা লিপস্টিক। একটুখানি রাঙা আভা জাগে ছোট্ট মেয়ের ঠোঁটে আর গালে। গায়ে একটা অন্য জামাও ওঠে। শেষটায় অভিভাবকের দায়িত্ব-টায়িত্ব পালনের পরে নাজিব তার নিজের স্নানে মন দেয়।
স্নান সেরে তার একমাত্র পরিষ্কার জামা-প্যান্টটাই পরে ফেলে। সদাশয় কোনও দাতা দিয়েছেন নিশ্চয়ই। হলুদ একটা শার্ট, তাতে বোতাম নেই। সঙ্গে, ধূসর রঙের প্যান্ট। সেজেগুজে তার মন যায় আমার ক্যামেরাটার দিকে। জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, আমি যদি প্ল্যাটফর্মের ওই দণ্ডটা বেয়ে উঠে একটু খেলা দেখাই, তুমি আমার ছবি তুলবে?
এ কী রে ছেলে, এক্ষুণি স্নান সারলি যে, আবার ধুলো ঘাঁটবি! মনে করিয়ে দিই ওকে। নাজিব লজ্জা পায় একটু। যেন একটা গর্হিত কথা বলে ফেলেছে, এমনই একটা অপরাধীর মতো ভাব ফুটে ওঠে তার মুখে। সেই ভাবটা কাটাতেই বোধহয় হাত ছড়িয়ে গোল হয়ে দৌড়তে থাকে বোনের চারধারে। স্নানের পরে নরম সূর্যের আলোটা ভালই লাগে বেশ! নাজিব আমাকে দেখায়, এখনও একটু সাবান হাতে আছে। বেশ হিসেব করে সপ্তাহে যদি একটা করে দিন স্নান করা যায়, তা হলে ওইটুকু সাবানেই আরও মাসখানেক চলে যাবে!
ওইটুকু সাবান দিয়ে আরও এক মাস! শুনে প্রথমে বিস্মিত হই। তারপর, কেনই বা বিস্মিত হলাম, তা ভেবে ফের আর এক প্রস্ত বিস্ময় জাগে! এ রকমই হওয়ার কথা ছিল হয়তো! আমিই বুঝতে পারিনি।
বোধহয়, আমরা বুঝতে পারিও না। প্রজাতন্ত্রের দিন বাতাসে ছুটির গন্ধ।তাতে অবশ্য পিপারিয়ায় প্ল্যাটফর্মের ধারে পিপুল গাছের কিছু যায়-আসে না।
ওদেরও কি যায় আসে কিছু? ওই যে, নাজিব আর শাবানার! দিব্যি থাকে ভাইবোন। অস্তিত্বের সংকট এবং তার নানাবিধ প্রভাব-টভাব ইত্যাদি ওদের চোখের কোলে কালি হয়ে জমে না মোটেই! বরং, প্ল্যাটফর্মেই বেঁচেবর্তে থাকে ওরা। হিসেব করে, ঠিক কতটুকু করে মাখলে সাবানটা আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকবে! সেইটুকু আনন্দেই ওদের মুখচোখ কেমন ঝকঝক করে ওঠে। আমি পিপারিয়া থেকে ফিরতি ট্রেন ধরি।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×