কিশোরগঞ্জ থেকে আট কিমি দক্ষিন পূর্বে অবস্থিত বরইতলা গ্রামের শরীফা খাতুন। তিনি বলেন পাকি বাহিনী যেদিন আমাদের বাড়িতে আসে, তখন আমি বাড়ির পেছনের কেওড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার কোলে তখন আমার দশ মাসের শিশু সন্তান আব্দুর রউফ খোকন। তারা বাড়িতে ঢুকে আমার শাশুড়িকে মারধর করে টাকা পয়সা চাই। আমার শাশুড়ির তখন ৭০বছর বয়স। শাশুড়ি বলেন, 'আমার কাছে কোন টাকা পয়সা নেই'। তখন তারা আমার শাশুড়িকে মেরে কেওড়া গাছের নিচে ফেলে রাখে। উঁচু লম্বা ৩জন পাকি আর্মি আমার কোল থেকে আমার ১০মাস বয়সী শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে, বাড়ির পেছনের নদীর দিকে যেতে থাকে। তখন আমি দিশেহারা হয়ে তদের পেছন পেছন যেতে থাকি। কান্নাকাটি করে তাদেরকে আমার ছেলে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকি। তখন আর্মি বলে, আমি যদি তাদের পাছনে এরকম করতে থাকি তাহলে তারা আমাকেও গুলি করে হত্যা করবে। আমি এ সময় বলি, 'আমাকে গুলি করে মেরে ফেলেন, তবু আমার ছেলেকে মারবেন না'। এ কথা বলার পরপরই এক আর্মি আমার বুকে রাইফেল ধরে। তখন আরেকজন বলে, 'মারার দরকার নেই, ছেলেটাকে পানিতে ফেলে দাও। মাকে মেরে ফেললে তো সে দেখতে পাবে না, তার সন্তানকে পানিতে ফেলে মারা হয়েছে।' আমার সন্তানের জন্য আমি তখন পাগলের মতো কাঁদছি। আমি যখন ওদের কাছে আমার সন্তানের প্রাণ ভিক্ষার জন্য কাকুতি মিনতি করছি, তখন দেখি, তারা আমার অসহায় অবস্থাটাকে উপভোগ করেছে। এক পর্যায়ে তারা আমার সন্তানকে নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, সেখান থেকে চলে যায়। ছুড়ে ফেলার মিনিট পাঁচেক পর আমি জ্ঞান ফিরে পাই এবং পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আমার বাচ্চাটাকে পাগলের মতো খুঁজতে থাকি। এ সময় আমার পরনের শাড়ি খুলে কোথায় পরে গিয়েছিল তা বুঝতে পারিনি। আমি যখন নদীতে আমার হারিয়ে যাওয়া সন্তানের খোঁজ করছি, তখন আমার ওপর দিয়ে অন্য মানুষের লাশ ভেসে যাচ্ছিল। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় আমার হাতের চুড়িতে কি যেন হঠাৎ বাধে, আমি সেদিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখি, আমার ছেলের আঙুল চুড়িতে লেগে আছে। পানির নিচেই আমি আমার ছেলের নাক ও চোক দেখতে পাই। তখন পানির নিচ দেয়েই ছেলেকে নিয়ে নদীর অপর পারে গিয়ে উঠি
'নদীতে পরে পানি খেয়ে আমার ছেলের পেট ও মাথা ফুলে গিয়েছিল। তখন আর্মির ভয়ে একটি লোক নদীর পার দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে ধর্মের বাপ ডেকে, আমার ছেলের পেট থেকে পানি বের করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। লোকটি ভয়ে ভয়ে আমার ছেলেকে মাথায় নিয়ে এক পাক ঘোরাতেই নাক মুখ দিয়ে পানি বের হয়ে যায়। এর পর আমি তাকে শুইয়ে রাখি। পরে শুনতে পাই পাকিস্তানি আর্মি গ্রামের লোকদের হত্য করে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে। বেলা প্রায় চারটার দিকে আমি নদীর ওপারে বাড়ি যাওয়ার জন্য, একজনের কাছে কাপড় চাই। তার কাছ থেকে কাপড় নিয়ে ছেলেকে কাঁধে করে বাঁশের সাঁকো দিয়ে কোনরকমে নদী পার হই।
গ্রামে ফিরে দেখি, সেখানে কোন লোকজন নেই। আমার স্বামী, শাশুড়ী কারও কোন খোঁজ নেই। এরপর রেল ক্রসিং-এ গিয়ে দেখি সেখানে অনেক লাশ। কারও বুকে, কারও মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমার বাড়ির লোকজনের কোন খোঁজ পেলাম না। পরে আমার বাবার বাড়ির লোকজন আমাদের বাড়ির লোকদের উদ্ধার করে আনে। আমার ছেলের শরীরে কিছু একটা বিধেছিল। সন্ধার পর ডাক্তার আনিয়ে কেটে সেই জিনিসটা বের করে ফেললে, আমার ছেলে জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। এরপর আমার ছেলেকে এক বোতল দুধ খাওয়াই। আমার সেই ছেলে এখনও বেঁচে আছে। সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।'
সুত্র :- পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীরা: ১৯১ জন।
আমার চোখের পানি আমি ওনেক সময় চেষ্টা করেও বের করতে পারি না, কিন্তু এই অংশটুকু পড়ার সময় এমনিতেই চোখ থেকে পানি বের হয়ে গেল। তাই আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০০৯ সকাল ৯:৩৪