somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মণিপুরিদের রাস উৎসব: একটি ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা

১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগামীকাল ১২ নভেম্বর ২০১৯ উৎযাপিত হবে মণিপুরিদের রাস উৎসব। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষ্ণ, চৈতন্য ও বৈষ্ণবভক্ত মানুষেরা এই পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিভিন্নভাবে রাসলীলা উদযাপন করে থাকেন। রাসলীলা উদযাপনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে এদেশের মণিপুরি জনগোষ্ঠীর। প্রায় ১৭৫ বছর ধরে মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার জোড়ামন্ডপে আয়োজিত হয়ে আসছে তাদের রাস উৎসব।



এক
কী এই রাসলীলা? ‘রাস’ এসেছে ‘রস’ থেকে। ‘রস’ মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম। ‘লীলা’ অর্থ নৃত্য। রাসলীলা মুলত পুরাণের কৃষ্ণ ও বৈষ্ণব সাহিত্যের অতিজনপ্রিয় চরিত্র শ্রীমতি রাধার অপ্রাকৃত প্রেমলীলার একটি আখ্যান । বৃন্দাবনের গোপীদের নিয়ে রাধা ও কৃষ্ণ এই রাস করেন । নানানজন নানানভাবে রাসলীলার ব্যাখ্যা দিয়েছেন । বৈষ্ণব কবিরা নিজেদের মতো করে রাধা ও কৃষ্ণকে উপস্থাপন করেছেন তাদের রচনায় । তারা বলছেন, পরমাত্মার সাথে আত্মার মহামিলনই রাস। পরমাত্মা কে ? যিনি ইশ্বর তিনিই পরমাত্মা। তিনি শ্রীকৃষ্ণ । আত্মা কে? শ্রীমতি রাধা ও গোপীরা, যারা পূণ্যবলে কৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভ করেছে । ভাগবৎ পুরাণে অবশ্য শ্রীমতি রাধার কথা নেই। সেখানে বলা হচ্ছে, বৃন্দাবনের রাসমন্ডলে সেখানকার গোপীদের সান্নিধ্য দিতে কৃষ্ণ রাসলীলা করেন । তাহলে যাদের সাথে এই লীলা হয়েছিল, তাদের অনেকেই লৌকিক দৃষ্টিতে অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী , অর্থ্যাৎ বিষয়টা পরকীয়া। কিন্তু ভাগবৎকার রাসলীলা বর্ণনার শুরুতেই বলছেন, নাহ এটা আপ্রাকৃত, মানে অলৌকিক লীলা। ভগবান নিদ্রার দেবী যোগমায়াকে আশ্রয় করে এই লীলা করেন যেখানে গোপীরা উপস্থিত থাকেন আত্মারূপে।

এগুলি পুরাণের কথা। রাসের ব্যাখ্যা পেতে চাইলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বাংলার ভাবান্দোলন যার সূত্রপাত হয় মূলত দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেব ও তৎপরবর্তী চন্ডীদাস (১৪শ শতক) ও বিদ্যাপতির (আনু. ১৩৭৪-১৪৬০) বৈষ্ণবপদ রচনার মধ্য দিয়ে । বৈষ্ণবরা কৃষ্ণকে দেখেছেন স্রষ্টা আর রাধাকে দেখেছেন সৃষ্টির প্রতিনিধি হিসাবে। স্রস্টার কাছে পৌঁছানোর সহজতম তরিকা হল প্রেম ৷দীর্ঘকাল ধরে সুফি সাধকরা বাংলায় ‘ইশক’ এর মাধ্যমে খোদায় লীন হয়ে যাওয়ার ধারনাটি প্রচার করছিলেন । সুফি-সাধকরা বলতেন, ‘ হক্ এর সঙ্গে জীবের মিলনের একটিই পথ, তা হল প্রেম বা ইশক’ ৷ নদীয়ার শ্রীচৈতন্যের রাধাভিত্তিক ভাবান্দোলনের সাথে এই দর্শনের গভীর যোগসূত্র পাওয়া যায় ৷ চৈতন্যদেব রাধার মতো পরমাত্মায় লীন হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন ৷ মুলত শ্রীচৈতন্য জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের ধারনাটি লাভ করেছিলেন বাংলার সুফি-সাধকদের কাছ থেকেই।

মণিপুরিদের রাসলীলাটি মুলত একটি নাট্য আঙ্গিক । বলা ভাল ক্লাসিক্যাল নাট্য আঙ্গিক। এমনিতে মণিপুরের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ধারণা করা হয় এদের ঐতিহ্যগত লোকনৃত্যই কালক্রমে ধ্রুপদী নৃত্যধারায় পরিণত হয়েছে। মণিপুরিদের রাস ও রাসের থিম ভারতবর্ষে প্রচলিত অন্যান্য রাসের চেয়ে আলাদা। মণিপুরি পুরাণ লেখকরা দাবি করেছেন, মিথলজি অনুসারে মণিপুর রাজ্যই হলো সেই স্থান যেখানে রাধাকৃষ্ণের অনুসরনে শিব পার্বতী রাসলীলা করেন। পুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী মণিপুরের কৌব্রু পর্বতকে রাসলীলার উপযুক্ত করে তোলার জন্য শিব সূর্য, চন্দ্র এবং পাঁচটি গ্রহকে আহ্বান করেছিলেন। মণিপুরি ভাষায় এদের নাম হলো নোঙমাইজিঙ (সূর্য), নিঙ্‌থোউকাপা (চন্দ্র), লেইপাক্‌পোকপা (মঙ্গল), য়ুমসাঙকেইসা (বুধ), সাগোলসেন (বৃহস্পতি), ইরাই (শুক্র) এবং থাঙজা (শনি)। সাতদিন সাতরাত শিব-পার্বতীর রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত সহযোগী ছিলেন গন্ধর্ব এবং অন্যান্য দেবতারা। রাত্রিবেলার অনুষ্ঠানের জন্য নাগরাজ অনন্তদেব তাঁর মাথার মণি দান করেন। নাগদেবের মণির নামানুসারে এই স্থানের নাম হয় মণিপুর।

পুরাণকাররা তাদের মতো করে ইতিহাস রচনা করেছেন । বস্তুত এই পুরাণগুলি লেখা হয়েছে দ্বাদশ শতকের দিকে যখন শৈবধর্মের প্রকট প্রভাব ছিল। ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর এই অঞ্চলে শৈবমতাদর্শের লোকেরা একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় রাজা পামহৈবা ভিন্নমতের গ্রন্থাদি ও নিদর্শন ধ্বংস করে দেন। এর ফলে মণিপুরের ইতিহাসও ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু মণিপুরের বৈষ্ণবরাও শিবকে শ্রদ্ধা এবং পূজা করতো ফলে শিব-পার্বতীর লীলাভিত্তিক গীত ও নৃত্য থেকে যায় । তারপর ইতিহাসের এক সময়ে বাঙলার ভাবান্দোলন যখন মণিপুর গিয়ে পৌঁছে তখন বৈষ্ণব পদকর্তাদের রচনাবলী মণিপুরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এগুলির উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় মণিপুরি রাসলীলার আঙ্গিক। ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার সাথে মণিপুরের লোকনৃত্যের ঐক্যতানে গড়ে উঠে এই নব্য ক্লাসিক্যাল শিল্পআঙ্গিক। রাধাকৃষ্ণের দর্শন গিয়েছিল বঙ্গ থেকেই। মণিপুরি রাসের গানগুলিও বাংলা ও ব্রজভাষায়, অধিকাংশই বাঙ্গালি বৈষ্ণব কবি ও পদকর্তাদের লেখা ৷

দুই
তাহলে দেখা যাচ্ছে রাসলীলা যেটি ছিল দ্বাপর যুগের ঘটনা এবং যার সংঘটন স্থান ছিল শ্রীব্রজধাম, সেটাই এই যুগে এসে হয়েছে পূণ্যতিথি রাসপূর্ণিমা। ভারতবর্ষের নানান স্থানের কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবরা নানানভাবে রাস উদযাপন করে থাকেন। শাক্তরা পূর্ণিমার এই দিনে দেবদেবীদের নানান মূর্তি বানিয়ে পুজা দিত। নবদ্বীপের রাস উৎসবে পটুয়াদের দিয়ে বড় বড় পট আঁকিয়ে মঠে-মন্দিরে প্রদর্শন করা হত। তাই রাসপূর্ণিমার আরেক নাম ‘পট পূর্ণিমা’। আর ওপরে গরুর গাড়ির চাকার থেকেও বড় বড় কাঠের চাকা তৈরি করে তার মাঝখানে রাধাকৃষ্ণকে বসিয়ে চারপাশে অষ্টসখীর মূর্তি বসানো হত। আর ধীরে ধীরে সেই চাকার সাথে অষ্টসখীদের ঘোরানো হত। এই ছিল রাস। এখনও অনেক অঞ্চলে তাই আছে ।

ভারতবর্ষে নাট্যাভিনয় ও নৃত্যগীতনির্ভর রাস উৎসবের প্রবর্তন করেন মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ (১৭৪৮-১৭৯৯)। ভাগ্যচন্দ্র সিংহ রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে সাজান। তার উদ্যোগে মণিপুর রাজ্যে প্রথম রাসলীলা মঞ্চস্থ হয় ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে। সেই রাসে তার কন্যা রাজকন্যা বিম্ববতী রাধার ভূমিকায় অভিনয় করেন, তিনি নিজে মৃদঙ্গবাদকের দ্বায়িত্ব পালন করেন । জনশ্রুতি আছে, ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নাদ্রিষ্ট হয়ে রাসলীলা করার তাগিদ পান । রাসের জাঁকজমকপূর্ণ ও শৈল্পিক কারুকার্যখচিত পোষাকগুলোও তিনি স্বপ্নে পেয়েছিলেন বলে মণিপুরি লেখকদের বয়ান থেকে জানা যায় । বিষয়টার এরকম ব্যাখ্যা হতে পারে যে, ভাগ্যচন্দ্র একজন বড় মাপের চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী রাজা ছিলেন। রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে রূপ দিতে তিনি অহর্নিশ পরিশ্রম করেছেন। পঠনপাঠন ধ্যান করতে করতে তিনি মন্দিরেই ঘুমিয়ে পড়তেন । রাসের নাচ, গান, সুর, তাল ও মুদ্রাগুলোকে তিনি একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন যার নাম ‘গোবিন্দ সঙ্গীত লীলাবিলাস’ । রাজা ভাগ্যচন্দ্রের পৌত্র চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে বসে ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর সময়ে রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধতর হয়ে উঠে।



মণিপুরীদের রাসলীলার উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদে, নৃত্যে-গীতে এবং মঞ্চ-অলঙ্করণে যে রাজকীয় গাম্ভীর্য দেখা যায় তাতে অনেক সময় একে রাজদরবারের পরিবেশনা বলেই ভ্রম হয়। অবশ্য রাসের জন্ম হয়েছে রাজদরবারে এই সত্যটি মেনে নিলে এটা নিয়ে কিছু বলার থাকে না। রাসের কষ্টিউমটির নাম ‘পল্লই’। এটি কমপক্ষে ১০টি ভাগে বিভক্ত। যেমন মাথার উপরিভাগে থাকে ‘কোকতোম্বি’। মুখের ওপর পাতলা স্বচ্ছ উড়নাটির নাম ‘মেইখুম্বী’। গায়ে থাকে সোনালি ও রূপালি চুমকির কারুকাজের ঘন সবুজ ভেলভেটের ব্লাউজ যার নাম ফুরিৎ। কোমর পর্যন্ত বক্ষবন্ধরী যার নাম থাব্রেৎ । পল্লইয়ের মুল অংশের নাম ‘কুমিন’। অজস্র চুমকি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়নার দ্বারা এই অংশটি কারুকাজ করা থাকে, যা সামান্য আলোতেও ঝলমল করে ওঠে। আছে জরির কারুকাজ করা পেশোয়ান, খোওল, খাঙ্গই । সাথে মণিপুরি স্বর্নালঙ্কার তো আছেই ।

এই রাজসিক বিষয়টাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করেছে সাধারণ মণিপুরি জনগণ। ধর্ম-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই আছে যেখানে রাজদরবারের বস্তু সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু মণিপুরীদের রাসলীলার ক্ষেত্রে এমন ব্যপার ঘটেছে। রাসলীলা এখন আর রাজার সংস্কৃতি হয়ে নেই, তা হয়ে গেছে সাধারণের সংস্কৃতি।

এই কারণে রাসের ঐ ভারী ‘পল্লই’টি মণিপুরি বিবাহের অত্যবশ্যকীয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে । বিবাহের রাতে মণিপুরি মৈতৈ ও মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া কনেকে কারুকার্যখচিত এই পোশাকটি পড়তে হয় । আরো আশ্চর্যজনক যে মণিপুরি পাঙন যারা ধর্মে মুসলিম, তারাও বিবাহের দিনে রাসনৃত্যের এই পোশাকটি পরিধান করে।

কেন সাধারন একটি নাচগানের অনুষ্ঠান, একটি শিল্পআঙ্গিক একটা গোটা জনগোষ্ঠির কৃত্যে পরিণত হলো, তার পেছনে গুঢ় রাজনৈতিক সমাজবৈজ্ঞানিক কার্যকারণ লুকিয়ে আছে ৷



তিন
মণিপুরি রাসের শুরুতে বলা হয়, ‘রাস আরম্ভিলা ভাগ্যচন্দ্র মনোহর’, এটা মুলত মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র যিনি রাস প্রবর্তন করেছিলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে করা হয়। এরপর থাকে বৃন্দা নর্তন ও কৃষ্ণ নর্তন ৷ ভাগবত পুরাণের রাস-পঞ্চ-অধ্যায় অবলম্বনে কৃষ্ণ অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, মণ্ডলী সজ্জা, গোপীদের রাগালাপ, কৃষ্ণ-রাধা নর্তন, গোপিনীদের নর্তন, ভঙ্গি পারেং, রাধা কৃষ্ণের নৃত্যে কৃষ্ণের পরাজয় ও রাধার বাঁশি লাভ, কৃষ্ণের অন্তর্ধান, রাধা বিরহ, কৃষ্ণের পুণরাগমন ও যুগলমিলন এরকম কয়েকটি পর্বে থাকে মণিপুরি মহারাসে ৷ টানা সাত থেকে আট ঘন্টা এই নৃত্যগীত চলে একটু সময়ও না থেমে ৷ এখানে রাসের প্রণিক্ষক বা গুরু ছাড়াও সূত্রধারী ও মৃদঙ্গবাদকেরা বড় ভূমিকা রাখেন ৷ রাসের ধারাবাহিকতা, এর সাথে সংশ্লিষ্ট কৃত্য এবং ভক্তসাধারনের ভাবভঙ্গি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাষ মণিপুরি রাসলীলা কেবল একটি নৃত্যের অনুষ্ঠান বা নাটক নয়, এটা অন্য কিছু । রাস দেখতে দেখতে উপস্থিত ভক্ত ও দর্শকেরা রাধা, কৃষ্ণ ও গোপীদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে, অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে, রাস দেখতে আসা স্বজনরা একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে। রাসের কয়েকটি অংশ বিশেষভাবে আবেগময় যেমন বিরহপর্বে কৃষ্ণের অন্তর্ধানের পর রাধার মূর্চ্ছা যাওয়া, গোপীদের বিলাপ ও পদচিহ্ন অনুসরন করে কৃষ্ণকে খুঁজতে যাওয়ার অংশটুকু বেশ মর্মস্পর্শী ৷


চার
মণিপুরি রাসের মুলভাব ভাগবৎ পুরাণ ও বৈষ্ণব কবিদের কাব্য থেকে নেয়া হলেও এর কেন্দ্রে থাকেন বৃন্দা নামের এক চরিত্র। পুরাণ পাঠে বুঝা যায় বৃন্দা সম্পুর্ণ লোকমানসজাত এক চরিত্র ৷ বৃন্দা রাধার একজন দূতী কিন্তু রাস শুরু হয় বৃন্দা নর্তন দিয়েই। বৃন্দা মণিপুরি রাসের ‘চিংপী’ বা সঞ্চালিকা । রাধাকৃষ্ণকে ছাপিয়ে তিনিই মণিপুরি রাসলীলার প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেন । মণিপুরী রাসলীলা মুলত বৃন্দাদেবীরই রাসলীলা । তাকে অনুসরন করেই অন্য গোপিনীরা নৃত্যগীত করেন । নৃত্যগুরুর কড়া নির্দেশ থাকে বৃন্দা ভুল করলে সেই ভুল ভঙ্গিতেই নাচতে হবে অন্যদের ।

‘বৃন্দা’ শব্দটি ‘বৃন্দাবন’ থেকে এসেছে নাকি ‘বৃন্দাবন’ নামটিই ‘বৃন্দা’ থেকে এল বলা মুস্কিল। ইম্পেরিয়েল গেজেটিয়ার অফ ইন্ডিয়া (১৯০৯) অবশ্য বলছে সংস্কৃত ভাষায় ‘বৃন্দাবন’ কথাটি এসেছে ‘বৃন্দা’ (তুলসী) ও ‘বন’ (অরণ্য) শব্দদুটি থেকে। বৈষ্ণবরা বলেন বৃন্দাই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণিত তুলসীদেবী । তুলসী সব ধরনের পূজার্চনাতেই লাগে, তাহলে কি তুলসীবৃক্ষই যমুনাপাড়ের বৃন্দা? বিষ্ণুর পরম ভক্ত বলে বৃন্দার আরেক নাম বিষ্ণুপ্রিয়া ৷ যাহোক মণিপুরি রাসের বৃন্দাকে দেখে মনে হয় খুব লৌকিক, যেন পাশের বাড়ির ভজন গাওয়া মেয়েটি যে কেবল কৃষ্ণানুরাগীই নয়, একই সাথে রাধাঅন্তপ্রাণ । যে কৃষ্ণের জন্য কুঞ্জ সাজায়, যে রাধার নিত্যসহচরী হয়ে পাশে পাশে থাকে। যে আকুল কন্ঠে সে গায়, আমি কৃষ্ণের প্রেমে কাঙ্গালিনী / বৃন্দাবনে বৃন্দা দুর্ভাগিনী / আমি যুগলচরণ সেবা করিব / যুগলরূপ নেহারিব / জীবন সফল করিব…। তার মানে দুর্ভাগিনী বৃন্দা নিজে কৃষ্ণকে পেতে চান না, যুগলচরণ পেলেই খুশি। এই যে পরমসত্তার প্রতি সমর্পন, এই কি তাহলে ভক্তির মুল কথা?



পাঁচ
নিত্যরাস, বসন্তরাস, মহারাস, দিবারাস মণিপুরি রাসের এরকম অনেকগুলো ফর্মের মধ্যে মহারাসের স্থান সর্ব্বোচ্চ যেটি হয় কার্তিক পূর্ণিমায়। যেকেউ চাইলেই মহারাস আয়োজনের সৌভাগ্য অর্জন করেনা, এটি পালা করে ন্যস্ত হয় একেকটি পরিবারের কাঁধে । রাস নৃত্যগীতের সাধারন কোন আয়োজন নয়, এটা হয়ে গেছে কৃত্য ও কঠিন সাধনার ব্রত । রাসের এক মাস আগ থেকে এই সাধনা শুরু হয়। মাসব্যাপী চলে রাসের প্রস্তুতি। বিশেষ দিনে নাচের প্রশিক্ষক বা অজাকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রন জানানো হয় । তিনি রাজী থাকলে শুভ কোন তিথিতে শুরু হয় নাচের চর্চা, নৃত্যকলা ও শিল্পরস উত্তীর্ন হবার কঠিন শর্ত নিয়ে । রাসের মূদ্রাগুলো শাস্ত্রীয়, নৃত্যভঙ্গি ধ্রুপদী । সঙ্গীতগুলো লেখা বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষায়, কাব্যমানসম্পন্ন। সেগুলি শ্রুতিমধুর কণ্ঠে পরিবেশনের জন্য দুর দুরান্ত থেকে দক্ষ সূত্রধারী নিমন্ত্রণ করে আনা হয় । আনা হয় মৃদঙ্গবাদক। রাসের শিল্পীরা যে পোশাক পরবে তাও সেক্রিড পোশাক, দেবতার কাছে রেখে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে তার পূজা দিতে হয় । রাসের আগের দিন ‘বার্তন চালানি’ বা গুরুকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাসে উপস্থিত থাকার নিমন্ত্রন ।

রাসের মঞ্চটি হতে হয় বাঁশ ও কাগজের তৈরী, তারও নিজস্ব ডিজাইন আছে। মঞ্চ বসাতে হয় মাঝখানে, দর্শকরা যাতে গোল হয়ে বসে দেখতে পারে । রাস শুরুর আগে আগে হয় নটপালা কীর্ত্তন, সেখানে রাসের সাফল্যের জন্য মঙ্গলকামনা করা হয় । এ এক বিশাল কান্ড। কেবল শিল্পের মাপকাঠি দিয়ে মেপে একটি জনপদের এই বিশাল কাণ্ডকে মাপা সম্ভব না । এই প্রযোজনাটির আড়ালে থাকে একটা গোটা জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব ও পরিচয় নির্মাণের নিরবিচ্ছিন্ন উদ্যোগ। একটা জাতিসত্তা যারা এককালে নিজেদের ভূখন্ড হারিয়ে এদেশে এসে বাস করছে, সংখ্যাগুরুর চাপে নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে যে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে , রাসলীলা সে লড়াইয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ ৷

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৫৬
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×