আমাকে তুমি চিনতে পারছো??
সত্যিই চিনতে পারছো তো???
চিনতে পারছো না!!
হাহাহাহাহা .......
তাহলে আজ তোমাকে,
তোমার অনাগত শত -সহস্র প্রজন্মের কাছে,
আমি আমার শ্রেষ্ঠ পরিচয়টুকু রেখে যাবো
তুমি, আজ হতে বহুকাল পরে,
কোন এক শরতের বিকেলে
যখন আমার পরিচয় মুছে দিতে :
উদ্ধত হবে আমারই সমগোত্রীয় লোক!!
যখন ইতিহাসের কলংক মুছে দিতে :
ঐক্যবদ্ধ হবে স্বজাতীর পবিত্র রংতুলি,
আমি তখনও রয়ে যাবো।
তুমি কেবল তোমার কৌতূহলী চোখ-
সাবধানে খোলা রেখো
কালের বাতাসে কান পেতে থেকো,
কিংবা ইতিহাসের জীর্ণ পাতায়..
কুঁড়ে কুঁড়ে খুঁজে নিও।
যে অব্যক্ত শব্দটি
গত যুগ যুগান্তরে বলা হয়ে উঠেনি!!
তা আজ তোমাদের সম্মুখে এই উন্মুক্ত মঞে
আমি দৃপ্ত কন্ঠে ব্যক্ত করে গেলাম .....
আমি আমার পরিচয় দিয়ে দিলাম।
এই সেই হাত,
একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখো,
সেই পা, চোখ, মুখ, নাক
ঠোঁট আর কন্ঠ গহ্বর।
দেখো ....
যে হাত দিয়ে,
শীতের সকালে কাগজ পোড়ানোর মতো,
কী সহজ স্বাভাবিকভাবে!
শতশত হিন্দুর বাড়িঘর জ্বালিয়ে -পুড়িয়ে ছাই করেছি,
এহাত দিয়েই, পাশের বাড়ির মুসলমানের :
ধন -সম্পদ লুট করেছি নিজের ভেবে।
ঘরের ভিতর থেকে, টেনে হিচড়ে
বের করে এনেছি, তোমার প্রিয়তমা মা-বোনকে।
আর পৌঁছে দিয়েছি, পাক -হানাদের সাক্ষাৎ দোজখে!
এই সেই পা,,
যে পা দিয়ে তোমার গর্ভধারিণী গৃহবধূর
পেটে লাথি মেরে, তোমার আসন্ন সন্তানের
মৃত্যু ঘটিয়ে :অট্টহাসিতে ফেটে পরেছিলাম।
যখন সাত কোটি বাঙালি 'জয় বাংলা 'বলে
আকাশ -বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছিলো
আমি তখন এ মুখেই মুনাফিকের মতো ...
'পাকিস্তান জিন্দাবাদ 'বলে উল্লাসে ভেসেছিলাম!
এ নাক দিয়েই,
তোমার অগনিত শহীদের পবিত্র রক্তের
তাজা ঘ্রাণ নিয়েছিলাম এক নিঃশ্বাসে।
তোমার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রশান্ত বাংলাদেশ যখন,
জানোয়ারদের প্রতিহিংসার লেলিহান আগুনে
দাউদাউ করে জ্বল ছিলো।
তোমার নিস্তব্ধ নগরী যখন,
মৃত্যুর মিছিলে কেঁদে মরছিলো।
আমি তখন নতজানু হয়ে,
কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে,
আমার এই জিহ্বা -ঠোঁট দিয়েই :
পশ্চিম -পাকিস্তানের বুট -জুতো চাটছিলাম পরম আদুরে।
তুমি পরখ করে নাও,
এই সেই খুনি হাত,
যে হাতে এখনো লেগে আছে :
তোমার ভাইয়ের রক্তের ছোপছোপ দাগ!!
এই স্বদেশের সাথে করা 'বেঈমানীর' দীর্ঘ চিহ্ন
তুমি আমাকে এখনো চিনতে পারোনি??
যারা তোমার তিরিশ লাখ সাদামাটা বাঙালিকে,
ঠান্ডা মাথায় হত্যা করলো,
আমি সেইসব খুনিদের আশ্রয়দাতা।
যারা তোমার এককোটি জনতাকে
বাস্তুহারা করে সীমান্তের ওপারে শরনার্থী শিবিরে পাঠালো,
আমি সেইসব জন্তুদের প্রশ্রয়দাতা।
যারা তোমার দুলাখ মা-বোনকে
ক্ষুধার্ত পশুর মতো চিবিয়ে খেলো,
আমি সেইসব নরখাদকদের মদতদাতা।
যারা তোমার নিষ্পাপ শিশুকে, মাটির সাথে,
আছাড় মেরে মাথার খুলি থেকে মগজ বের করলো,
আমি সেইসব হায়েনাদের পরম প্রিয় ভ্রাতা।
তুমি বুঝি বিবেকের চোখ
বন্ধ করে রেখেছো,
তুমি বুঝি তোমার চেতনার দ্বার
রুদ্ধ করে দিয়েছো!!
তাই আমাকে চিনতে তোমার এতো বিলম্ব!!
যে শিশু উঠোনের কোনে উদোম শরীরে দাড়িয়ে :
মা মা বলে চিৎকার করতো,
আমি তার বিরুদ্ধে ছিলাম।
যে মমতাময়ী 'মা' তাঁর সন্তানকে বুকে জড়িয়ে :
ঘুমপাড়ানির গান শোনাতো
আমি তাঁর বিরুদ্ধে ছিলাম।
যে শিক্ষক স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে আদর্শের বাণী প্রচার করতো,
আমি তাঁর বিরুদ্ধে ছিলাম।
যে মুয়াজ্বিন ভোরের পৃথিবীতে,
আযানের ধ্বনিতে সত্যের আহ্বান করতো,
আমি তাঁর বিরুদ্ধে ছিলাম।
যে কৃষক নবান্নের ধানে, ঠোঁটের কোনে বিশ্ব জয়ের হাসি ছড়াতো
আমি তাঁর বিরুদ্ধে ছিলাম।
যে নবীন ছাত্র মধ্যরাত পর্যন্ত মোমের আলোতে পড়ে :
স্বপ্নকাতর চোখে ঘুমুতে যেতো,
আমি তাঁর বিরুদ্ধে ছিলাম।
যে প্রেমিক তার বুক পকেটে প্রিয়তমার জন্যে
মধুরতম বাক্যটি লিখে ডাকপিয়নে ছুটতো,
আমি তার বিরুদ্ধে ছিলাম।
যে কবি সাম্যের কবিতা লিখতো,
যে গায়ক মুক্তির জয়গান করতো,
যে চিত্রশিল্পী অধিকারের ছবি আঁকতো,
যে মহান নেতা ঝাঝালো কন্ঠে স্বাধীনতার ভাষণ দিতো,
যে মধ্যবিত্ত 'একটু বেঁচে 'থাকার জন্য রাস্তায় নামতো,
আমি তার,তাদের সকলের বিরুদ্ধে ছিলাম।
আমি পক্ষে ছিলাম :বেয়নেটের
মর্টার-গোলা, বারুদ আর শর্টগানের।
যখন নগরীর শান্ত বুক
জলপাই রঙের ট্যাংকে ছেয়ে গেলো,
যখন গ্রামের মেঠোপথ থেকে শহরতলীর অলিগলি
কালো বুটের নৃত্যের ঝংকারে কেঁপে উঠেছিল,
আমি তখন পৈশাচিক আনন্দে :তোমার ভুখন্ডের সর্বত্র :
শান্তিবাহিনী -শান্তি কমিটি গঠনে ব্যতিব্যস্ত!!
এতো পরিচয় দেবার পরও,
তুমি আমাকে চিনতে পারলে না!!!!
আমি এখন শহরের সবচেয়ে উচু ভবনে থাকি,
তোমার ঘরের লুট করা সম্পদে আরাম -আয়াশে ভাসাই,
রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে এখন আমার নিরাপত্তার বিধান হয়,
আমার গাড়িতে সুশোভিত তোমার অবহেলিত পতাকা পতপত করে উড়ে।
আর আমি আজকাল ধর্মের নামে রাজনীতির বেঁচাকেনা করি।
রেশনের লাইনের মতো
যে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়ে
পঙ্গু মুক্তিযুদ্ধাটি বাঁচবার জন্য
তাঁর বীরত্বের সনদ প্রাপ্তির আশায়
প্রতিদিন ভিক্ষুকের মতো দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়,
আমি সেই আপিসের প্রতিটি মনুষ্যকুলের ঘাড়ে,
অদৃশ্য শাসনের ছড়ি ঘুড়াই.।
আমি এখন অখ্যাত কসাই মোল্লা থেকে
জাতীয় মোল্লার মুখোশ পরেছি।
হে বিবেক -বোধহীন, অন্ধ প্রজন্ম
তুমি এখনো বুঝতে পারোনি, আমি কে??
আমি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা থেকে উঠে আসা-
জাতির পতাকা খামচে ধরা সেই পুরনো শকুন।
আমি কামরুল হাসানের ক্যানভাসে ভেসে উঠা সেই 'জানোয়ারের মুখ'
ইয়াহিয়া খানের লেলিয়া দেয়া কুকুর।
আমি জাহানারা ইমামের 'গন আদালতকে'বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে -
জাতীয় এসেম্বলির আরাম কেদারায় বসে থাকা ..
চিরচেনা বেহায়া মুখ।
আমি,,
তোমার নয় মাসের দুঃসহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত :
জাতীয় পতাকার বুকে ..
গত তেতাল্লিশ বছর স্ব-দ্বর্পে দাড়িয়ে থাকা
সেই ভয়াল মানব :
তুমি আমার পরিচয় জেনে নাও,
তুমি স্পষ্ট করে শুনে নাও :
আমি "রাজাকার "বলছি!!!!!!