যে সময়কার কথা বলছি, তখন এই উপমহাদেশ একটি ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক 'যুগ সন্ধিক্ষণের ' ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সময়টা "উনিশশো সাতচল্লিশ " সাল ,, জুলাই মাস ,এক সাদা চামড়ার ব্রিটিশ আইনজীবী টেবিলের ওপর
ভারতবর্ষের ( ভারত, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান) মানচিত্রের ওপর পেন্সিল -কম্পাস নিয়ে ঝোঁকে বসেছেন, ব্রিটিশ -ভারতের পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছেন, এখান দিয়ে বাংলা এবং পাঞ্জাবের সীমান্ত রেখা টানতে হবে। কাজটা শুধু কঠিন না অনেকটা দুঃসাধ্যের মতো, কারণ হাতে আছে খুবই অল্প সময়। টেনশনে তার কপালে বিন্দু -বিন্দু ঘাম জমছে, ঘনঘন চা খাচ্ছেন, মাঝেমধ্যে বড় -মোটা পাইপের সিগারেট ফুকছেন। সাথে আরও একজন সহযোগী ছিলেন : সুইডেনের প্রধানবিচারপতি 'আলগেট ব্যাগিও। এতক্ষণ যে মানুষটির কথা বলছিলাম, তাকে এই উপমহাদেশের সবাই চিনে,, তিনি ' সিরিল রেডক্লিফ '। 1947 এ ভারত ভাগের উদ্দেশ্য সীমান্ত রেখা নির্ধারণে ব্রিটিশ -ভারতের শেষ গভর্নর লর্ড মাউনব্যাটন যে কমিশন গঠন করেন, ওনি ছিলেন তার প্রধান, যা ইতিহাসে "রেডক্লিফ আইন ' নামে পরিচিত। সাতচল্লিশের জুলাই -আগষ্টের সন্ধ্যা গুলোতে খুব ঠান্ডা মাথায় পেন্সিল -কম্পাস দিয়ে জনাব রেডক্লিফ ( রেডক্লিফ লাইন) যে রেখা টেনে দিলেন তাতেই শুরু হয়ে গেলো সাড়ে ছয় দশকের এক অমানবিক জীবন, ছিটমহল!!
একশো নব্বই বছরের শাসনের নামে শোষণ এবং জুলুম ও অত্যাচারের পর 'স্যুট টাই পরা ' 'সভ্য ' ব্রিটিশরা বাধ্য হয় ভারতবর্ষের ভূখণ্ড ছাড়তে। 15 জুলাই 1947 সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন 1947 পাস হয়, এতে অখণ্ড ভারত বিভক্ত হয়ে ধর্মের ভিত্তিতে "ভারত ' ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন -সার্বভোম রাষ্ট্র গঠন হয়। 47'র 14 আগষ্ট পাকিস্তানকে এবং 15 আগষ্ট ভারতকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে,, দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন হলেও, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের রাজা 'নারায়ণ ভুগ বাহাদুর এর কিছু জমিদার সত্ত্ব এবং জমি ছিলো বৃহত্তর রংপুরে। একইভাবে রংপুরের মহারাজা "গোপাল লাল রায় ' এর কিছু তালুক ছিলো 'কুচবিহার ' সীমান্তের ভিতরে। ব্রিটিশ সরকারের সাথে এদের ছিলো দহরম -মহরম ভাব, এবং এগুলো এদের নিজস্ব সম্পত্তি হবার ফলে রাষ্ট্র আলাদা হয়ে গেলেও দুই প্রান্তের এই জমিগুলোর বিষয়ে কোন সমাধানে আসা যায়নি,, ইতিহাস বলে এবং অকাট্য, অমোঘ সত্য হচ্ছে,, মূলত এখান থেকেই ' ছিটমহল সমস্যার শুরু। কারণ জানা যায়,, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ( সেসময় পূর্ব পাকিস্তান) রংপুরের 111টি জায়গায় কোচবিহারের রাজার ভূখণ্ড ছিলো এবং পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে কোচবিহারে রংপুরের মহারাজার 51 টি জায়গায় জমিদারি ভুখন্ড ছিলো। যেগুলোর মিমাংসা তখন করা হয়নি বলেই ছিটমহলের উৎপত্তি।
বলা বাহুল্য : "ছিটমহল হলো, একটি দেশের মানচিত্রের ভিতরে বা অভ্যন্তরে অপর দেশের ভুখন্ড।
ভারত এবং পাকিস্তানের সীমানা রেখা নির্ধারণের জন্য ব্রিটিশ গভর্নর 'লর্ড মাউন্টব্যাটন ' একটা কমিশন গঠন করেন। দুই দেশ থেকে দুজন সদস্য এবং 'সিরিল রেডক্লিফ ' কে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়,, উল্লেখ্য রেডক্লিফ ছিলেন একজন আইনজীবী মাত্র, দেশের সীমানা রেখা বিষয়ে তার কোন জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা ছিলো না। 1947 এর 8 জুলাই তিনি ভারতে পৌছে এই কাজ হাতে ন্যান, 13 আগষ্ট চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দ্যান এবং 16 আগষ্ট সীমান্ত রেখা টপ -শিটের মূল কপি প্রকাশ করা হয়। মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে এমন কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা ছিলো প্রায় অসম্ভব, তাছাড়া কাগজে -কলমে সীমানা টেনে দেয়া হলেও যে এ নিয়ে বিতর্ক হবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, কেননা, দুইদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের যাতায়াত, অখণ্ড জমি, সমন্বিত অর্থনীতি, এছাড়াও মৌজা, জমির দাগ, খতিয়ান, সামাজিক, পারিবারিক, গোষ্ঠীর কারণ। আকাবাকা জমি, মানচিত্রের অসংলগ্নতার ফলে বাস্তবিকই রেডক্লিফের সীমান্ত রেখা পুরোপুরি সঠিক ছিলো না। তদুপরি, অভিযোগ আছে,, কমিশনের সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জমিদার, নবাব, চা বাগানের মালিকরা তাদের প্রভাব খাটিয়ে সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ হাসিল করে। আর এতসবের ভিড়ে কোচবিহার এবং রংপুরের সেই জমিগুলোর কোন সমাধান হয় নাই, ফলে তৈরি হয়ে যায় পরবর্তী 67 বছরের এক বিভীষিকাময় জীবনের, যে জীবনের ভুক্তভোগী ছিটমহলবাসী!!
1958 সালে প্রথম সীমানা নির্ধারণ, ভূমি হস্তান্তর, ছিটমহল সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূন চুক্তি সই করলেও তা ভারত সরকারের অসহযোগিতায় মুখ থুবড়ে পরে।
এরপর বাংলাদেশ সৃষ্টির পর 1974 সালের 16 সেপ্টেম্বর নয়া দিল্লিতে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী 'ইন্দিরা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা ও ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যা ইতিহাসে ' মুজিব-ইন্দিরা ' চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিটি বাংলাদেশের সংসদে অনুসমর্থন পেলেও, ভারতে পক্ষে সম্ভব হয় নি। ফলে, ছিটমহলবাসীদের মানবেতর জীবনের গল্পটা লম্বা থেকে আরও লম্বা হতে থাকে।
1996 সালে কলকাতায় ভারত -বাংলাদেশ সীমান্ত সম্মলনে,, দুইদেশের ছিটমহলের প্রকৃত সংখ্যা এবং জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
2011 সালের 6 সেপ্টেম্বর ঢাকায় মনমোহন সিংয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে 74 'র মুজিব -ইন্দিরা চুক্তির একটি প্রটোকল সাক্ষরিত হয়। যেখানে দুইদেশের অচিহ্নিত সীমানা, স্থায়ী সীমান্ত রেখা,অপদখলীয় ভূমি সমস্যার সমাধান, ছিটমহল সংক্রান্ত বিষয় উল্লেখ থাকে। এবং এই প্রটোকলের ফলে দুই দেশের আইনসভায় চুক্তি সংক্রান্ত জটিলতা দূর হয়।
অবশেষে,, সাতষট্টি বছরের অমানবিক জীবনযাপনের সমাপ্তির উদ্দেশ্যে, একচল্লিশ বছরের অপেক্ষার পর গত 6 মে ভারতীয় সংসদের রাজ্যসভায় এবং 7 মে লোকসভায় স্থল সীমান্ত চুক্তি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংসদের দুই -তৃতীয়াংশ ভোটে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। এর মধ্য দিয়ে ছিটমহলের বাসিন্দাদের দুঃসহ জীবনের ইতি টানার প্রহর গোনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ -ভারতের মধ্যে মোট 162 টি ছিটমহল, যার মোট জনসংখ্যা হলো 51,584 জন। বাংলাদেশের ভিতরে ভারতের ছিটমহল 111 টি, যার সবগুলো বৃহত্তর রংপুর বিভাগের নীলফামারী, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাটে। এর আয়তন 17,158 একর। অপরদিকে ভারতের বাংলাদেশের ছিটমহল 51 টি, যেগুলো কোচববিহার এবং জলপাইগুড়ি তে, এগুলোর আয়তন 7110 একর। এখন ছিটমহল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশ পাবে 17 হাজার একর জমি, আর ভারত পাবে 7 হাজার, এইযে 10 হাজার একর জমির পার্থক্য, যা বাংলাদেশ পাবে, সেই বিষয় নিয়ে কয়েকবছর আগে আজকের ক্ষমতাসীন "বিজেপি "র ডাক সাইটে নেতা 'অরুণ জেটলি ' বলেছিল, 'চুক্তি করে আমরা, বাংলাদেশ কে জমি দেবো না। ' সেই বিজেপি ই আজ সংবিধান সংশোধন করে সংসদে বিল পাস করিয়েছে, কারণ বরাবরই কংগ্রেস ও আওয়ামীলীগের সুসম্পর্কের কথা বলা হয়, যেখানে বিজেপির দূরত্বের কথা, ক্যারিশম্যাটিক লীডার মিস্টার 'মোদী জানেন তিনি বিশ্ব নেতা হতে চলছেন, তাই সবার আগে তাকে আঞ্চলিক নেতা হবার প্রয়োজন আছে, এছাড়াও নিজেদের ঘাড়ে যে 'সাম্প্রদায়িক ' তকমা টা আছে সেটাও মুছে ফেলা জরুরি। গত একচল্লিশ বছরের ঝুলে থাকা এই সমস্যা সমাধানের একটা বড় রাজনৈতিক কৃতিত্ব তাই মোদী সরকারকে দেয়ায় যায়।কেননা কংগ্রেস বরাবরই এই চুক্তির পক্ষে ছিলো, তাই এটা নিষ্পন্ন হবার চৌকসতায় 'বিজেপি ভুল করেনি।
রাষ্ট্রবিহীন, নাগরিকত্বহীন এই অর্ধলাখ ছিটবাসী গত সাড়ে ছয় দশক কী মানবেতর জীবনযাপনই না করেছি। গত শতাব্দীর অর্ধেক সময় জুড়ে এদের ছিলো না কোন শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, এরা পায়নি কোন সেবার সুযোগ, একটি রাষ্ট্রে বসবাস করেও এরা দিতে পারেনি 'ভোট, যোগাযোগ, যাতায়াত, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, গ্যাস রাষ্ট্রীয় সেবা, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, অবকাঠামো, ব্যানিজ্য সবকিছুরই বাইরের ছিলো এরা। এই রাষ্ট্রের নাগরিকগনরাই এদের অবহেলা, অবজ্ঞার চোখে দেখে আসছে! আর আট -দশটা সাধারণ ছেলেমেয়েদের মতো পড়াশোনার সুযোগ পায় নি। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়বার মুহূর্তেও এরা আমার -আপনার মতো হাসপাতাল গুলোতে ভর্তি হতে পারেনি,, এদের ভর্তি করেনি কারণ এরা ছিটের বাসী। রাষ্ট্রের কোন ভাতা এরা পায়নি। এদের জীবন কেটেছে কেমন করে জানেন,, বিএসএফের গুলির আঘাতে জীবন চলে যাবার ভয়ে, কতটা পাশবিক!! ভাবা যায়?? এদের জীবনে উন্নয়নের ছোয়া কখনো লাগেনি, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে এরা সর্বদা অবস্থান করেছে। ছিটমহলবাসীর সন্তানদের কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠোন পেরুনো অনেকটা রুপকথার মতোই। রাষ্ট্র তার উদার বাহু দিয়ে এদের কখোনোই গ্রহণ করে নাই। ইট -কাঠের দালানকোঠায় এদের জীবন কাটেনি বরং চা -চালা ছাউনি আর মাটির ঘরে এরা জড়াজড়ি করে বেঁচে আছে!! সংবিধান নামক রাষ্ট্রীয় খাতায় এদের নাম ছিলো না আদৌ।
উপরন্তু,, একটি স্বার্থপর, লোভী গোষ্ঠী অল্প কিছু অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে এদের দিয়ে সীমান্তে মাদক চোরাচালা, নারী -শিশু পাচার,চুরাই মোটরবাইক আমদানি, ইন্ডিয়ান গরু -শাড়ি আমদানি, মানুষ হত্যাকাণ্ডের মতো রাষ্ট্রীয় অপরাধ করিয়ে নেয়!!
আমার -আপনার মতো এদেরও প্রতিদিন ভোর হয়, সকালবেলা এই মানুষগুলোর উঠোনেও সূর্যের তীর্যক কীরন এসে, এদের নিষ্পাপ শিশুগুলোও নিশ্চয় বারান্দায় হামাগুড়ি দেয়, প্রবীন বৃদ্ধাটি মেঝেতে বসে জীবনের শেষ সুখের প্রহর গুনতে থাকে, গোধূলিবেলায় ঘরেফেরা মধ্যবয়স্কাও প্রিয়তমার কপালে গভীর আবেগে চুমো খায়, বোধকরি মধ্যরাতে এদের দুচালা ভাঙা টিনের ঘরের ফাঁক দিয়ে জোছনার আলো এসে অদ্ভুত সুন্দর বিভ্রম তৈরি করে, আর শেষ রাতে অভিমানী ডাহুক টা ডেকে ওঠে বাঁশঝাড়ের একেবারে শেষ মাথায় অনন্তকাল ধরে।
সব ঠিক আছে,, শুধু ঠিক নেই সঠিকের জায়গায়!! একান্না হাজার ছিটমহলবাসীর জীবন, আমার-আপনার মতো সাজানো -গোছানো, রঙ্গিন আর বর্নীল নয়। এই রাষ্ট্রবিহীন নিদারুন মানুষ গুলো আমাদের মতো খুউব করে বাঁচতে পারে না, এদের জীবনে স্বপ্নের জাল কিভাবে বুনন করতে হয়, সে অধ্যায় রচিত হয় না, এরা বেঁচে থাকে,,, "ভালো না থাকা, টেনেহিঁচড়ে বেঁচে থাকা" আর এই দুইইয়ের মাঝখানে অনেকটা মরে যাবার মতো করে! !