হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন প্রতিশ্রুত পয়গম্বর। (Promised Prophet)ঃ
আল্লাহ্ যে রাসুলে পাক হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)কে দুনিয়ায় পাঠাবেন, একথা পূর্বেই নির্ধারিত ছিলো। তিনি ছিলেন সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। কাজেই তাঁর জ্যোতির্মূর্তি আল্লাহ্ র ধ্যানে প্রথমেই সঞ্চারিত হয়েছিলো। এই জ্যোতির্মূর্তিই নূরে মহাম্মদি। সর্বপ্রথম তাই আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছিলেন মুহাম্মদের নূর। একটি হাদিসে তাই এসেছে,“ আউয়ালা মা খালাকাল্লাহু নূরী” অর্থাৎ রাসুলে পাক (সাঃ) বলেন,“ সর্ব প্রথমেই আল্লাহ্ যা সৃষ্টি করেন তা হলো আমার নূর”। সুতরাং এই কথা সহজেই বলা যায় যে, হযরতে নূর পুর (সাঃ) তাঁহার দুনিয়াতে আগমনের অনেক আগেই সৃষ্টি হয়েছিলেন। সারা সৃষ্টি তাঁর নূরের আলোকেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলো।
প্রতিশ্রুত পয়গম্বরকে এই অর্থেই গ্রহণ করতে হবে। প্রতিশ্রুত পয়গম্বর তিনি- যাঁর আবির্ভাব সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়মে যা অনিবার্য্য, আবির্ভাবের পূর্বেই তা প্রতিশ্রুত। মুহাম্মদ (সাঃ) আসবেন- এই কথা তাই বিশ্বনিখিলের অবিদিতি ছিলো না। হযরত আদম, হযরত নূহ, হযরত মূসা, হযরত ইব্রাহিম, হযরত ঈসা (আঃ) প্রমুখ পূর্ববর্তী যাবতীয় পয়গম্বর ও তত্ত্বদর্শী মহাপুরুষই জানতেন সেই নিশ্চিত অনাগত একদিন আসবেন। তাই তাঁরা প্রত্যেকেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এঁর আগমন সম্মন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। বেদ-পুরাণ, জিন্দাবেস্তা, দিঘা-নিকায়া, তওরাৎ, জবুর, বাইবেল প্রভৃতি পুরাকালীন প্রধান প্রধান ধর্মগ্রন্থে মুহাম্মদ (সাঃ) এঁর গুণগান ও তাঁর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী বিঘোষিত হয়েছে। যেমন-
বেদ-পূরাণঃ
বেদ-পূরাণ এবং উপনিষদ হিন্দুদিগের বিশিষ্ট ধর্মগ্রন্থ। এইসব প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে ‘আল্লাহ্’,‘রসুল’,‘মুহাম্মদ’ ইত্যাদি শব্দ কিভাবে উল্লেখিত হয়েছে দেখুনঃ
‘অথর্ববেদীয় উপনিষদ’-এ আছেঃ
অস্য ইল্ললে মিত্রাবরুণো রাজা, তন্মৎ তানি দিব্যানি পুনস্তং দুধ্যু, হবয়ামি মিলং কবর ইল্ললাং, অল্লোরসুলমহমদকং, বরস্য অল্লো অল্লাম ইল্লল্লেতি ইল্লাল্লাল
‘ভবিস্য পুরাণ’-এ আছেঃ
এতস্লিন্নন্তরে ম্লেচ্ছ আচার্যেন সবন্বিতঃ, মহামদ ইতি খ্যাতঃ শিষ্যশাখা সমন্বিতঃ, নৃপশ্চৈব মহাদেবং মরুস্থলনিবাসিনম্, গঙ্গাজলৈশ্চ সংস্নাপ্য পঞ্চগব্যসমন্বিতৈঃ, চন্দনাদিভিরভ্যর্চ তুষ্টাব মনসা হরম্, নমস্তে গিরিজানাথ মরুস্থলনিবাসিনে, ত্রিপুরাসুরনাশায় বহুমায়াপ্রবর্তিনে,
ভোজরাজ উবাচ-
স্লেচ্ছৈর্গুপ্তায় শুদ্ধায় সচ্চিদানন্দরুপিণে, ত্বং মাং হি কিঙ্করং বিদ্ধি শরণার্থ মুপাগতম
ভাবার্থঃ ঠিক সেই সময় ‘মহামদ’ নামক এক ব্যাক্তি - যাঁর বাস ‘মরুস্থলে’ (আরব দেশে) - আপন সাঙ্গোপাঙ্গোসহ আবর্ভিুত হবেন। হে আরবের প্রভু, হে জগদগুরু, তোমার প্রতি আমার স্তুতিবাদ।তুমি জগতের সমুদয় কলুষ নাশ করবার বহু উপায় জান, তোমাকে নমষ্কার। হে পবিত্র পুরুষ! আমি তোমার দাস। আমাকে তোমার চরণতলে স্থান দাও।
‘অল্লোপনিষদ’-এর একটি স্থানে দেখতে পাওয়া যায়ঃ
হোতারমিন্দ্রো হোতারমিন্দ্রো মহাসুরিন্দ্রাঃ, অল্লো জ্যোষ্ঠং পরমং পূর্ণং ব্রহ্মাণ অল্লাম, অল্লোরসুলমহমদকং বরস্য অল্লো অল্লাম, আদল্লাহ্ বুকমে ককম অল্লাবুক নিখাতকম
ভাবার্থঃ আল্লাহ্ সকল গুণের অধিকারী, তিনি পূর্ণ ও সর্বজ্ঞ্যানী, মুহাম্মদ আল্লাহ্ র রসুল। আল্লাহ আলোকময়, অক্ষয়, এক, চীর পরিপূর্ণ এবং সয়ম্ভূ।
‘অর্থবেদ’- এ উল্লেখ আছেঃ
ইদং জনা উপশ্রুত নরাশংসস্তবিষ্যতে, ষষ্টিং সহস্রা নবচিতং চ কৌরম আরুশ মেষু দবহে।
ভাবার্থঃ হে লোকসকল, মনোযোগ দিয়া শ্রবণ কর। ‘প্রশংসিত জন’ লোকদিগের মধ্য হতে উত্থিত হবেন। আমরা পলাতককে ৬০,০০০ জন শত্রুর মধ্যে পাইলাম। বলা বাহুল্য, এখানে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এঁর কথাই বলা হয়েছে। কারণ মহাম্মদ অর্থই ‘প্রশংসিত জন’ আর মক্কার অধিবাসীগনের তৎকালীন সংখ্যাও ছিলো প্রায় ৬০,০০০।
বৌদ্ধ শাস্ত্রেঃ
বৌদ্ধদিগের প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘দিঘা-নিকায়া’য় উল্লেখ আছে,“মানুষ যখন গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ভুলে যাবে, তখন আর একজন বুদ্ধ আসবেন, তাঁর নাম হবে ‘মৈত্তেয়’ ( সংস্কৃত মৈত্রেয়) অর্থাৎ শান্তি ও করুণার বুদ্ধ।”
এ কথার প্রমাণে সিংহল হতে প্রাপ্ত একটি তথ্যের উল্লেখ করা যায়, তা হলো-
আনন্দ বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার মৃত্যুর পর কে আমাদেরকে উপদেশ দিবেন? বুদ্ধ বল্লেন, “ আমিই একমাত্র বুদ্ধ বা শেষ বুদ্ধ নই। যথাসময়ে আর একজন বুদ্ধ আসবেন, আমার চেয়েও তিনি পবিত্র ও অধিকতর আলোকপ্রাপ্ত- তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মমত প্রচার করবেন- ”
আনন্দ জিজ্ঞাসা করলেন,“ তাঁকে আমরা চিনব কি করে? বুদ্ধ বল্লেন ,“ তাঁর নাম হবে মৈত্রেয়”। এই ‘শান্তি ও করুণার বুদ্ধ’ (মৈত্রেয়) যে মুহাম্মদ, তাতে কোনোই সন্দেহ নাই। কোরআনুল করিমে মুহাম্মদের বিশ্লেষণেও অবিকল এইরুপই আছে। মুহাম্মদ সম্মন্ধে বলা হয়েছেঃ তিনি ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের জন্য মূর্ত করুণা ও আশীর্বাদ।
পার্শি ধর্মশাস্ত্রঃ
পার্শিজাতির ধর্মগ্রন্থ’র নাম ‘জিন্দাবেস্তা’ ও ‘দসাতির’। জিন্দাবেস্তায় হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এঁর আবির্ভাবের সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। এমনকি ‘আহমদ’ নামটি পর্যন্ত উল্লেখিত হয়েছে। মূল শ্লোক ও তার অনুবাদ নিম্নরুপঃ
Noid te Ahmad dragoyeitim fram-raomi, Spetame Zarathustra yam dahmam Vangnim afritim, yunad hake hahi humananghad hvakanghad, Hushyanthand hudaenad....( Zend-Avesta, Part 1, Translated by Muller, p-260)
অর্থাৎঃ “ আমি ঘোষণা করছি, হে স্পিতাম জরতুষ্ট্র, পবিত্র আহমদ (ন্যায়বানদিগের আশির্বাদ) নিশ্চই আসবেন, যাঁর নিকট হতে তোমরা সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ কার্য্য এবং বিশুদ্ধ ধর্ম লাভ করবে।”
‘দসাতির’ গ্রন্থেও অনুরুপ আর একটি ভবিষ্যদ্বাণী আছে। তার সারমর্ম হলো,“ যখন পার্শীরা নিজেদের ধর্ম ভুলে গিয়ে নৈতিক অধঃপতনের চরম সিমায় উপনীত হবে, তখন আরব দেশে এক মহাপুরুষ জন্ম গ্রহণ করবেন- যাঁর শিষ্যগন পারশ্যদেশ এবং দুর্ধর্ষ পারশিক জাতিকে পরাজিত করবে। নিজেদের মন্দিরে অগ্নিপূজা না করে তাঁরা ইব্রাহিমের ক্বাবা-ঘরের দিকে মুখ করে প্রার্থণা করবে; সেই ক্বাবা প্রতিমা মুক্ত হবে। সেই মহাপুরুষের শিষ্যগন বিশ্ববাসীর পক্ষে আশীর্বাদস্বরুপ হইবে।” “ তাঁরা পারশ্য, মাদায়েন, তুস, বলখ, প্রভৃতি পারশ্যবাসিদের যাবতীয় পবিত্র স্থান অধিকার করবে। তাঁদের পয়গম্বর একজন বাগ্মী পুরুষ হবেন এবং তিনি অনেক অদ্ভুত কথা বলবেন।” (Muhammad in world scriptures: By A. Haq vidyarthi, P-47)