somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হেনার মৃত্যু ফতোয়া এবং কিছু কথা - মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সম্প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়ায় হেনা নামের এক তরুণীর দুঃখজনক মৃত্যুর খবর সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। সরেজমিনে ঘটনাটির সত্যাসত্য যাচাই করা আমাদের সম্ভব হয়নি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এরপর গ্রাম্য সালিসে ধর্ষক ও ধর্ষিতা উভয়কে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেওয়া হয়। ঘটনার একপর্যায়ে হাসপাতালে নেয়ার পর তরুণী হেনা মৃত্যুবরণ করে। তবে ঘটনাটির বর্ণনায় বলা হয়, ফতোয়ার কারণে হেনার মৃত্যু হয়েছে। মর্মান্তিক ঘটনাটি এবং এর সঙ্গে ফতোয়াকে জড়িত করার বিষয়ে কিছু বলা প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক. প্রথমেই যে বিষয়টি বলা দরকার সেটি হচ্ছে ইসলামী শরীয়তে ধর্ষকের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি আদালত ইচ্ছা করলে ক্ষেত্রবিশেষে ধর্ষককে ‘চরম সন্ত্রাসী আচরণে’র দায়ে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু ধর্ষিতার জন্য কোনো শাস্তির প্রশ্ন তো নেই-ই; বরং সে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহানুভূতি ও সুবিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। মুসলমান সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব, রাষ্ট্রের তরুণী-যুবতী তথা নারীসমাজের সম্ভ্রমের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া।
দুই. সংবাদপত্রের ঘটনা বর্ণনায় স্পষ্টতই বোঝা যায়, হেনার ওপর শাস্তি প্রয়োগের তথাকথিত বিচারকাজটি পরিচালনা করেছে গ্রামের মাতবর-মোড়ল প্রভাবিত গ্রাম্য সালিস। মাতবর-মোড়লরা তাদের সামাজিক প্রভাবের কারণে ওই সালিসে দু’জন অর্ধশিক্ষিত মৌলভী সাহেবকে যুক্ত করে নেয়। এতে কেউ কেউ ‘বিচারের’ পুরো প্রক্রিয়াটিকে ‘ফতোয়া’ বলে প্রচার করার সুুযোগ পেয়ে যায়। অথচ দেশের আলেমসমাজ বারবার বলে এসেছে, গ্রাম্য সালিসের সঙ্গে ফতোয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অর্ধশিক্ষিত মৌলভী তো দূরে থাক, সাধারণ পর্যায়ের কোনো মাওলানারও ফতোয়া দেয়ার অধিকার নেই। ফতোয়া দিতে পারেন কেবল ফিকহ-ফতোয়া বিষয়ে উচ্চতর ইসলামী জ্ঞানার্জনকারী এবং এ বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিত্বদের কাছে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ব্যক্তি।
ইসলামে ফতোয়ার বিষয়টিকে এ জন্যই অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, এর মাধ্যমে মুসলমানদের জীবনের সব শাখা-প্রশাখার কর্মকাণ্ডের শুদ্ধাশুদ্ধি সাব্যস্ত হয়। ফতোয়া কেবল বিবাহ-তালাকের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, নামাজ-রোজা, আয়-উপার্জন, লেনদেন, আচার-আচরণ থেকে নিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রেই হালাল-হারাম চিহ্নিত হয় ফতোয়ার মাধ্যমে। এ জন্যই ফতোয়া মুসলিম জীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
কয়েক বছর ধরে এ দেশে গ্রাম্য সালিসের বিভিন্ন ঘটনাকে ‘ফতোয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে। অবমাননা করা হচ্ছে ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষাকে। কথায় কথায় বলা হচ্ছে, ‘ফতোয়ার শিকার’। ‘ফতোয়াবাজি’ নামক নতুন শব্দ বানিয়ে গালির অর্থে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এটা চরম দুর্ভাগ্যজনক ও দ্বীনধর্মের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
তিন. শেষ যে প্রসঙ্গটি সবার সামনে থাকা দরকার, সেটি হচ্ছে ফতোয়া এবং কাজা (বিচার) দুটি পৃথক বিষয়। ফতোয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমের মতামত। আর কাজা (বিচার) হচ্ছে রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ কর্তৃক দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রদত্ত রায়। আর সে রায় বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব হচ্ছে সরকার বা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের। সুতরাং শরীয়তের ‘হদ-তাযির’ তথা বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের দণ্ডবিধি সম্পর্কে বিচারিক রায় দেয়া বা তা বাস্তবায়ন করা কোনো মুফতির (প্রকৃত অর্থেই ফতোয়াদানকারী) কাজ নয়; বরং এটি বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব। সে প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, কোনো নারী বা পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হলেও তার ওপর শরীয়তের শাস্তি প্রয়োগ করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও আদালতের। ফতোয়া বা মুফতিকে এর সঙ্গে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এটা তাদের কাজও নয়।
ফতোয়ার বাস্তব রূপ, তার আওতা, ফতোয়ার নামে গ্রাম্য সালিস—এসবের পার্থক্য না বুঝে সরাসরি ফতোয়াকে আক্রমণ করা মুসলমানদের জন্য আত্মঘাতী আচরণ। এ ক্ষেত্রে বুঝে না বুঝে ফতোয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, ফতোয়া নিষিদ্ধের দাবি তোলা এবং ফতোয়াকে নারী নিগ্রহের কারণ মনে করা চরম নির্বুদ্ধিতা। মূলত নারীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রেরণা জোগানোর ক্ষেত্রে ফতোয়ার ভূমিকাই প্রধান। আমরা চাই হেনার মতো আর কোনো নারীর যেন এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু না ঘটে। একই সঙ্গে ফতোয়া বা ইসলামী কোনো পরিভাষা ব্যবহারে সংযত শব্দ প্রয়োগ ও আচরণের জন্য সব মহলের প্রতি আন্তরিক অনুরোধ জানানোকেও আমরা আমাদের দায়িত্ব মনে করি।
লেখক : মুদীর ও বিভাগীয় প্রধান
(উচ্চতর ফিকহ ও ফতোয়া অনুষদ)
মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা

তথ্য সূত্র
৮টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×