somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিহিলিজম - নিহিলার প্রতি প্রেম

১০ ই মে, ২০১৬ রাত ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিহিলিজম নিয়ে লেখার ইচ্ছা অনেকদিনের। আজকে বসলাম কী-বোর্ডের সামনে আঙুল গেড়ে, দেখি কি বেরোয়!

প্রথমে বোরিং পার্টটা সেরে নেওয়া যাক। উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞাঃ

"নিহিলিজম হচ্ছে একটি দার্শনিক মতবাদ, যা প্রচার করে - জীবনের বিশেষ কোন অর্থ, গুরুত্ব, বা উদ্দেশ্য নেই, নৈতিকতা এবং নীতিগত মূল্যবোধের কোন পরম সুবিধা নেই। দিনশেষে সকল সমাজসৃষ্ট নীতিবিদ্যাই বিমূর্ত এবং অকার্যকর।"

নিহিলিজমের নিহিল শব্দটা আসছে ল্যাটিন থেকে, এর মানে 'কিছুই না'।
অর্থাৎ ঘোড়ার ডিম
অর্থাৎ কচু
অর্থাৎ লবডঙ্কা
অর্থাৎ শূন্য।

আর নিহিলিজম হচ্ছে এই কচু ঘেঁচু শূন্য লবডঙ্কার দার্শনিকতা।

এইটার উৎপত্তি ঘটে মূলত উনিশ শতকের দিকে, কির্কেগার্ড তাঁর 'দা প্রেজেন্ট এইজ' এ কন্সেপ্টটা নিয়া ভাল গুঁতাগুঁতি করলেন। তখনো এর নাম নিহিলিজম হয় নাই, কির্কেগার্ড নাম দিলেন "লেভেলিং"। তিনি বললেন, মানুষের জীবনে লেভেলিং হইল কব্বরের আন্ধারের মতো, প্রত্যেক মানুষ এই লেভেলিং এর সম্মুখীন হয় একাকি, তাঁর কোন সঙ্গী নাই এই ব্যাপারে; এই লেভেলিং এর মুখামুখি হইলে সব তত্ত্ব-বিশ্বাস নিয়া প্রশ্ন জাগে ইত্যাদি ইত্যাদি।


চিত্রিতঃ কির্কেগার্ড এবং তাঁর হাওয়া-হাওয়াই চুল

কিন্তু কির্কেগার্ড পাগলা আশাবাদি দার্শনিক তো, তিনি জিনিসটারে ছোট্ট স্কেলে পজিটিভ ভাবে নিলেন। বললেন, না, লেভেলিং ভালু, কারণ যারা এই চ্যালেঞ্জটারে জয় করতে পারে, তারা জীবনে আর কোন জায়গায় গিয়া আত্ম-সংশয়ে ভোগে না। প্লেটোর ভাষায়- নো দাইসেলফ; তো তারা দাইসেলফ-রে চিনা ফালায়।

নিহিলিজম এর ঋণাত্মক প্রভাব পরিণতি নিয়া তিনি আর বেশি সাউন্ড করলেন না।

এরপরে আসলেন নীটশে। আইসাই কয়টা বই আর বিতর্কিত মন্তব্য দিয়া মজলিস গরম করে ফালাইলেন। তাঁর 'জরাথুস্ত্র কৈছে' (Thus Spoke Zarathustra) বইতে একবার কইলেন, 'ঈশ্বর মৃত, আর আমরাই তারে মাইরা ফালাইছি' আর এইটা না বুইঝাই মানুষ তারে খুশির চোটে ফাদার অফ নিহিলিজম বানায়া ফেলল। নীটশে, দা ট্রু নিহিলিস্ট!


এবং ট্রু মোচ-প্রেমি!

আসলে নীটশে স্বয়ং আছিলেন অস্তিত্ববাদি দার্শনিক। নিহিলিজমে বিশ্বাসী না। তিনি প্রমাণ করলেন, নিহিলিজম অস্তিত্ববাদের একটা শাখা, এবং খুব সম্ভব অস্তিত্ববাদের ভবিষ্যৎ। কির্কেগার্ড যেখানে থামছিলেন সেখানে তিনি নাক ঢুকায়া শুরু করলেন, চমৎকার একটা ব্যাখ্যা দিলেন।

নীটশে কইলেন, মানুষ তাঁর সকল সিদ্ধান্ত নেয় নির্দিষ্ট কিছু পূর্বনির্ধারিত মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস থিকা। কিন্তু বর্তমান সমাজে আমরা আবিষ্কার করতাছি যে এইসব মূল্যবোধ আর বিশ্বাসের পিছনে মহান কোন উদ্দেশ্য নাই। আমাদের অস্তিত্বের প্রকৃত কোন মানে নাই। কারণ মানব অস্তিত্বের দুইটা কারণ থাকতে পারে,

১। ঐশ্বরিক কারণ।
২। প্রাকৃতিক কারণ।

ঐশ্বরিক কারণে আসেন। ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করছেন, কেন?

ক. হয় তাঁর আমাদেরকে প্রয়োজন, তাইলে আমরা বাঁইচা আছি এক বৃদ্ধ দুর্বল ঈশ্বরের প্রাণরক্ষার জন্যে। আমাদের স্বয়ং কোন অস্তিত্বের মানে নাই।

খ. নইলে তাঁর ইচ্ছা হইছে, তাই বানাইছেন। হুদাহুদি। ইচ্ছা হইব, ধ্বংস কইরা দিবেন। আমরা তাঁর হাতের খেলনা। আমাদের অস্তিত্বের আসলে কোন প্রয়োজন নাই, অতএব মানেও নাই।

কিংবা প্রাকৃতিক কারণ ধরেন। যদি বিশ্ব-সৃষ্টি র‍্যানডম একটা ঘটনা হয়, যদি অভিযোজন-বিবর্তনের ট্রায়াল এন্ড এররের ধাপে ধাপে আমরা সিংগেল কোষ থেকে র‍্যানডমভাবে এই মানুষে পরিণত হয়ে থাকি, তাইলে নিশ্চয়ই আমাদের অস্তিত্বও তেমনি, র‍্যানডম। আমাদের উদ্দেশ্য প্রকৃতির নিম্ন জাতের প্রাণীর চেয়ে বেশি কিছু না। বাঁচো, সঙ্গী খুঁজো, বংশধর পয়দা করো, নিজের জিন ছড়ায়া দেও- এইটাই। টিকতে না পারলে মইরা যাও, বিদায়। দিনশেষে এসবের কিই বা অর্থ?

তো নীটশে কইলেন এই চিন্তা প্রক্রিয়াটা শুরু হইছে পশ্চিমা বিশ্বের অবচেতন মনে। হয়তো এককভাবে পায় নাই, কিন্তু গোষ্ঠীগতভাবে এর প্রকাশ পাওয়া শুরু হবে, রাজনীতিতে।
শিল্পে।
গল্পে-কবিতায়।
অর্থনীতিতে।
সমাজে।
এবং তারপর সাধারণ মানুষের অনুভূতিতে।

এর ফলাফল হিসেবে আমরা আস্তে আস্তে রীতিনীতি মূল্যবোধ ধর্ম রে নিজের সুবিধা অনুসারে গ্রহণ বর্জন শুরু করছি, এবং ফলশ্রুতিতে আমাদের মোরাল কম্পাস, আমাদের ঈশ্বররে মাইরা ফেলতাছি ধীরে ধীরে। এই কারণেই তার উক্তি - 'God is dead, and we have killed him'.

এই গড খালি এব্রাহামিক তিন ধর্মের গড না, এই গড সকল যুগের সকল নিয়ম, সকল অভিভাবকের প্রতিনিধি।

আর তাই নীটশে কইছিলেন, ভবিষ্যতে এই নিহিলিজম- এই অর্থহীনতার আর্তনাদ- সকল সত্যকে শূন্যে পরিণত কইরা দিবে। আর যেহেতু দুনিয়ার সকল রীতি নীতি মূল্যবোধ (কমবেশি) সত্যকে কেন্দ্র কইরা সৃষ্ট, সুতরাং একজন নিহিলিস্টের কাছে সেই সবকিছু শূন্য হয়ে যাবে, কোন গুরুত্ব থাকবে না।

সুতরাং নিহিলিস্ট যখন পাপ করবে, সেটা হবে নিকৃষ্টতম পাপ।
নিহিলিস্ট যখন পুণ্য করবে, তা হবে বিশুদ্ধতম পুণ্য।

নীটশে নিহিলিজমকে রোম্যান্টিক চোখে দেখেন নাই, তিনি দেখছিলেন এটাকে মানব জাতির শ্রেষ্ঠ পরীক্ষা হিসেবে। নতুন কিছু তৈরি করতে গেলে শূন্য জায়গা লাগে, নিহিলিজম সেই শূন্য জায়গার স্রষ্টা। নিহিলিজম পার করার পরই মানুষ (নীটশের ভাষায় তারা তখন মানুষ না, 'ঊবারমেনশ' বা মানবোত্তীর্ণ সত্ত্বা) অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে পেয়ে বাঁচা শুরু করবে।

কির্কেগার্ড এইটাকে দেখছিলেন সুযোগ হিসেবে, নীটশে তাঁর সাথে গলা মিলায়ে বলছেন, হ্যাঁ, সুযোগ অবশ্যি, তবে মানব জাতি সেই পরীক্ষা পাশ করতে পারবে কিনা তা নিয়া আবার সন্দেহও প্রকাশ করছেন।

নীটশের কথা ফলতে দেরি হয় নাই। আমাদের জীবনে নিহিলিজম ছড়াইয়া পড়ছে যাতনাদায়ক ফোঁড়ার মতো। যে মানুষ জীবনে নিহিলিজমের নাম শুনে নাই সেও মাঝেমধ্যে ডিপ্রেশনে ভোগে। কারণ, একক ভাবে না জানলেও ব্যষ্টিগত ভাবে এইটা আমাদের অবচেতন সত্ত্বা জাইনা ফেলছে, এবং সুযোগ পাইলেই সে তা বাইরে ধুমধাম প্রকাশ করে।

উত্তরাধুনিকতা নামের যে মতবাদটি, তা নিহিলিজমের সন্তান।
দাদাইজম, আমাদের হাংরি জেনারেশন- সবার অন্যতম প্রেরণা নিহিলিজম।
রাশিয়ান সাহিত্যের বড় অংশ জুড়ে আছে এটি।
ফ্রয়েড, ইয়াং এরা সাইকোএনালিসিস করেছেন নিহিলিজম কেন্দ্র করে।
ভুরি ভুরি ছবি, গান হচ্ছে এই কনসেপ্টে।

এবং ক্রমশ, এই একবিংশ শতাব্দীতে, নিহিলিজম ধীরে ধীরে একটা কনসেপ্ট হয়ে থাকছে না, হয়ে পড়েছে মস্তিষ্কের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সত্ত্বা, যা সুযোগ পেলেই নিজের চেহারা দেখিয়ে দিচ্ছে বাইরের জগতে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে সবাই নিহিলিস্ট হয়ে পড়ছেন। আর বিভিন্ন বয়সে নিহিলিজমের বিভিন্ন প্রকাশ কে আমরা ভিন্ন ভিন্ন লেবেল দিয়ে আলাদা করে দিচ্ছি-

এটা টিনেজ ডিপ্রেশন
এটা মিডলাইফ ক্রাইসিস
ওটা বার্ধক্যজনিত বিষণ্ণতা;

আর আমরা আটকে আছি নিহিলিজমের নেশায়, নেশা কাটিয়ে নীটশের সেই ঊবারমেনশ হওয়া আর আমাদের হয়ে উঠছে না।

তাই অক্ষুণ্ণ থাকুক দুঃখবিলাস, অক্ষুণ্ণ থাকুক প্রেম। নিহিলার প্রতি প্রেম।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৬ রাত ১২:১৮
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×