আমাদের পাড়ার কুমারগলিতে থাকতো হাদি। হাদি পোলাডা ছিল একটা হাইকুর মত। পিচ্চি। কম কথা কৈত। আর যা কৈত মাথার উপ্রে দিয়া যাইত সব।
হাদির ফ্যামিলি এলাকার অন্যতম পুরান ফ্যামিলিগুলার একটা। অবশ্য আগের মতো সুদিন নাই অদের। চাচিজি মারা গেলেন হাদি যখন এইটে পড়ে। চাচাজি পুরা উদাস হয়া গেলেন তারপর। ব্যবসা করতেন, উদাস মনোভাবের কারণে কঠিনভাবে লস খাওয়া ধরলেন। তারপরে সব বাদ দিয়া চাইলের দোকান দিলেন একটা। ছোট্ট মেহগনির ডেস্কের পিছনে, হাতে স্টিলের চুক্ষা শিক নিয়া বয়া থাকেন সারাদিন, কাস্টোমার আইলে চাইলের বস্তায় ঘাও দিয়া চাইল বের কৈরা দেখান। ঝরঝর কৈরা চাইল পড়ে মাটিতে, তিনি মনে মনে হিসাব করেন। আধা পোয়া। এক পোয়া। দেড় পোয়া। চাইলের ধারা শুকায়া গেলে শিক হাতে ঘুরাইতে ঘুরাইতে আবার গিয়া বসেন ডেস্কের পিছনে। মুখের ভাব দেইখা তাঁর মনের ভাব কিছু বুঝা কঠিন।
হাদির মামা চাচাদের প্রথম দিকে দেখতাম, ক্রমশঃ তারাও বিলুপ্ত প্রাণিতে পরিণত হওয়া শুরু করলেন। হাদির মামা একদিন চা খাইতে টঙয়ে আয়া গপ্প করেন। আমরা মনোযোগ দিয়া শুনি আর চায়ে চুমুক দেই।
'হাদির বাপে তো আউলাইয়া গেছে। কইলাম ভাইগ্নারে লয়া যাই বাড়িত, শুইনা হ্যাতে খেইপা উঠে। আমারে মারবার আহে। বালছাল। নিজেও মরব পোলাডারেও মারব। এইটুকু পোলা, এখনি সিগারেট খায় বলে হুনলাম, চিন্তা করছেন! এই পোলারে কন্ট্রোল করা লাগব, কিন্তু কউয়ার কেউ থাকলে তো!'
আমরা সম্মতি জানাই নিঃশব্দে। হাদি সিগারেট না, বিড়ি টানে। মতিন বিড়ি। আকিজের চেও দাম কম। যার ঠোঁটে এই চিয জ্বলতে পারে, সেই পোলা অবশ্যি বদ। অবশ্যি কন্ট্রোল করা উচিত।
এলাকার মুরুব্বিরা চাচাজির দোকানে গিয়া কথা তোলেন সাবধানে। পোলা বড় হইতাছে, দেইখা রাখ। আর তুমি একা মানুষ, এইভাবে কি বাঁচন যায়? বিয়া করো একটা। পশ্চিম পাড়ার আরু, অরে কেমন লাগে তুমার? মেয়া ভাল। জামাইডা মরল অসময়, পোলাপান হয় নাই, বাপের উপর চাইপা রইছে। তুমি কও তো কথা কই আমরা।
সেদিন আমরা সুবিধাজনক দূরত্ব, অর্থাৎ টঙে বইসা বইসা এলাকার মুরুব্বিদের লুঙ্গির খুটা ধইরা জান-বাঁচানি দৌড় দিতে দেখি। হাদির আব্বা পিছে পিছে ধাওয়া দিতাছেন, তাঁর হাতে নাঙ্গা শিক, আকাশে উচ্চা কৈরা ধরছেন, আর মুখ দিয়া তুফান বেগে এমন সব সম্বোধন বের হইতাছে যা শুইনা আমাদেরই কান লাল হয়ার জোগাড়। হাদি সেইদিন টঙেই বসা, শালায় দেখি হাসে। মুরুব্বিগণ সম্মানের সাথে পলায়ন করার পরে, তারপর ও গিয়া বাপেরে থামায়, 'আব্বা, বাদ দেন। আসেন দোকান খালি পইড়া রইছে, চোরে চাইল লয়া ভাগব এই চান্সে। আসেন।'
চাচাজি শান্ত হন। পোলার পিছু ধরে ফিরত আসেন আবার। তাঁর হাটায় একটু কাঁচুমাচু ভাব, পোলাপানের সামনে হঠাৎ এমন রাগ দেখায়া ফালায়া শরম পাইছেন বোঝা যায়। আর কোন কথা না কয়া তিনি ডেস্কের পিছনে বয়া পড়েন।
তবে ধাওয়া-থেরাপিতে কাম হয়। মুরুব্বিরা আর বিয়ার কথা বা হাদিরে কন্ট্রোলের কথা তোলেন না। হাদি আর হাদির বাপের জায়গা হয় পাড়ার একটা অদ্ভুত অবাস্তব ডিমেনশনে, যেইটার অস্তিত্ব সবাই জানে কিন্তু কেউ স্বীকার করে না। বিশাল আশ্চর্যের ব্যাপার, এরই মধ্যে হাদি কলেজে উঠে। কম আশ্চর্যের ব্যাপার, ওর নেশাও উঠে সাথে। এলাকার গাঞ্জুট্টী মঞ্জুর লগে দোস্তি পাতায়া পুলের নিচে বয়া গাঞ্জা টাঞ্জা খায় কয়দিন। ফেন্সি খায়া ধানক্ষেতের আইলে পইড়া থাকে। কাশির ওষুধ নিতে নিতে ডিসপেনসারি খালি কৈরা ফালায়। হাদির চোখের নিচে কালি, চাপা বেরায়া গেছে, দেখা হইলেই ফ্যাকাশে হাসি দেয়, মনে হয় আজরাইলের শাগরেদ। আমরা কই, হাদি পোলাডা নষ্ট হয়া গেল। নাজেহাল মুরুব্বিরা কন, তোরা কি করস এলাকার পোলাপান হয়া। অরে ধরবার পারস না? এলাকার নাম নষ্ট হইতাছে অর লিগা।
আমাদের লুঙ্গির নিচে টনক নইড়া উঠে। কথা তো ঠিকই। হাদিরে সোজা করা লাগব। কিন্তু আমরা যেহেতু ইতিহাসের মনোযোগী ইসটুডেন্ট, সুতরাং বুদ্ধিমানের মতো কেউ চাচাজির কাছে নালিশ লাগাইতে যাই না। হাদিরে একদিন কুমারগলির মাথায় চাইপ্পা ধরি। হাদি আমাদের হম্বি-তম্বি হুমকি-ধামকি-জিজ্ঞাসা শোনে। একজন হাত উঠাইতে যায় অর উপ্রে, আমরা শেষ মুহূর্তে থামায়া চোখ গরম করি হাদির দিকে। 'ভালা হয়া যা', আমরা উপদেশ দেই, 'নইলে মাইরা লাত্থায়া বের কৈরা দিমু এলাকা থিকা।' হাদি কিছু না কয়া নির্বিকার মুখে আমাদের দিকে চায়া থাকে, য্যান আমরা গরুর পোঁদে বসা ডাঁশমাছি কতক।
এতে আমরা বুঝতে পারি না হাদিরে সোজা করনের পদ্ধতি সফল হইছে কিনা। বিভ্রান্ত পায়ে আমরা সইরা আসি। হাদি খাড়ায়া থাকে গলির সামনে একলা।
নতুন ব্লেডে দাড়ি চাঁছার সময় গালের মতন অতর্কিতে কাইটা যায় কিছু দিন। চাচাজি দোকানে বইসা থাকতে থাকতে একটা সময় আর উইঠা দাঁড়ান না। দুপুরের সময় বাসায় যাইতে গিয়া গাঞ্জুট্টি মঞ্জু চাচাজিরে দেখে। দেখে তাঁর চারিপাশে মাছি ভনভন করতাছে। মঞ্জু ডাকে আমাদের, আমরা ডাকি হাদিরে। হাদি আইসা রোবটের মতো হইয়া যায়। ও জিগায়, 'আব্বা সাড় দেয় না কেন?'
আমরা কই, 'হাদি শক্ত হ ভাই।'
ও জিগায়, 'আব্বা কি মইরা গেছে?'
'হাদি কান্দিস না', পেছন থিকা কয় একজন।
ও অন্যমনস্কভাবে গাল দেয়, 'কানতাছে ক্যারা বাল! আব্বারে কবর দিমু কই। কয়া গেল না। মামাগো জানান লাগব, তাই না? আমার মুবাইল কোনে রাকছি কেউ দেখসস?'
চাচাজির কবর হয় এলাকার গোরস্তানে। বেশি মানুষ হয় নাই, আত্মীয়স্বজন সব আসেও নাই। বৃষ্টির দিন, নিম্নচাপ চলতাছিল মনে হয়। কবর দিয়া আমরা হাদিরে অর বাসায় নিয়া গেলাম। আজকা রান্না হয় নাই, সুতরাং অর খাবার আসে আশেপাশে থিকা। আমরা চাইরজন অর লগে রাইতটা থাকি। অরে কান্দানোর অনেক চেষ্টা করা হইল, কিন্তু শালায় কান্দে না, আরও অবাক হয়া কয়, কান্দুম ক্যা? মানুষ তো মরবই। অর বরং আপসোস, জানাজার নামাজ পড়াইতে পারল না। এইডা নিয়া বিষণ্ণ মুখে হাদি বয়া থাকে।
তারপরে হাদি দেখলাম মসজিদে কয়দিন খুব নামায টামায পড়লো। টুপি পইড়া বয়া থাকে মসজিদে, দেখা হইলেই ফ্যাকাশে সেই হাসি। কথা কয় খুব কম, ফাঁকে ফোঁকরে দুই একটা বাক্য বেরাইতে শুনি। একদিন মসজিদ থিকা বেরানোর সময় আমারে কয়, জানস, আমি জানাজার নামায পড়ান শিকছি। আব্বা বাঁইচা থাইকা এখন আবার মরলে পড়াইতে পারতাম নামায। আপসোস থাকত না। আমি অর পিঠ চাপড়াইয়া আয়া পড়লাম চুপচাপ। এই সাধারণ কথাডা শুইনা আমার গাও শিরশির কৈরা উঠছিল ক্যান যানি।
তারপর দেখলাম অয় চিল্লায় গেল চল্লিশ দিনের, তারপর কাক্রাইলে থাকলো আরও দুই মাস। হাদির আত্মীয়স্বজন যে কয়জন আইছিল, অরা খুব খুশি। কয় - যাউকগা, পোলারে আল্লায় অবশেষে হেকমত দিছে, আর চিন্তা নাই। হ্যারা হাদির লিগা মেয়া খুঁজব এই সংকল্প নিয়া নিজেদের এলাকায় ফিরত যায়। আমাগো তখন টঙের ভাইব্রাদারি তেমন নাই, ভাঙ্গন ধরছে। আনু ভাই বিসিএস করছে, কইরাই এলাকা ছাইড়া ভাগছে, দেখা করতে গেছিলাম, চিনেই না। আমরাও বাপ-মায়ের দাবড়ানি খায়া দৌড় পাড়ি এইখানে অইখানে আর স্বপ্ন দেখি টসটসা ট্যাকা আর কচকচা বউ এর। হাদির খবর লয়ার টাইম কই?
টাইম হয়ও না আর। দুইবছর পরে এলাকায় ফিরা ছোটভাইগো কাছে শুনি হাদি দোকান বেইচ্চা ভিটা বেইচ্চা এলাকা ছাড়ছে ছয়মাস হয়া গেছে। কেউ জানে না কই গেছে। একদল কয় আবার গাঞ্জা ধরছিল, গাঞ্জার সুখ মিটাইতে বেচতে হইছে সব, এহন অন্য এলাকায় খুঁজলে হয়তো দেখন যাইব ডাকাতি টাকাতি করে, নয় পাক্কা চোর হয়া গেছে। মসজিদের হুজুর রে ধরলাম, হ্যায় কয় হাদির কোন কারণ আছিল না যাওনের। যাওনের আগের দিনও নামায পইড়া গেছে। পরের দিন উধাও।
আমার মাথার ভিত্রে অকারণে অস্বস্তি লাগতে থাকে। আমি অনেক ঝামেলা কৈরা অর মামাগো চাচাগো কাছে খোঁজ লই। হ্যারা কয়, হাদির বাপে অনেক ঋণ কৈরা গেছিল, হাদি ইদানিং সেইডা শুধাইছে। ইদানিং বলতে কবে? এইতো ছয়মাস হইব। আপ্নেগো সাথে আর যোগাযোগ হয় নাই? নাহ, আমরা তো ভাবছি অয় চিল্লায় গেছে। ক্যান কিছু হইছে নাকি?
আমার ভাল লাগে না। কথা না বাড়ায়া লাইন কাইটা দেই। কয়েকদিন বন্ধুবান্ধবদের কাছে খোঁজ করি হাদির কথা। এই আধুনিক যুগে একটা জলজ্যান্ত মানুষ উধাও হয়া যাইব - এ কেমন কথা! পুলিশের কাছে যামু কিনা ভাবি, কিন্তু বাকি বন্ধুরা আমারে থামায়। দরকার নাই পুলিশরে টানার, পরে তোরেই ঝামেলায় টানতে পারে। এম্নেই খুঁজতে থাক, না পাইলে কি আর করা! সবচে খারাপ সম্ভাবনাটারে ধইরা নিয়া গায়েবানা জানাযা পড়াইলেই হবে।
আমাদের কয়েকজনের ধাক্কাধাক্কিতে বাধ্য হয়া মাসখানেক পরে জানাযা পড়ান হয়। আমরা জানাযায় গম্ভীরমুখে উপস্থিত হই। একে অপরের দিকে চায়া দেখি। প্রায় দশজনের মতো আসছি, আর দুইটা পিচ্চি আসছে কৌতূহলী চোখে। এবং তারপর হাদি অফিশিয়ালি মৃত হয়ে যায় আমাদের মস্তিষ্কের ছায়ার নিচে।
যেহেতু এইটা গল্প, তাই হাদিরে নিয়া রমরমা একটা কাহিনি ফাঁদা যায় এরপর। বলা যায় হাদিরে অনেকদিন পর দেখছি বিয়া টিয়া কৈরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন রূপে বাঁচতে। তারপরে মানব জীবনের প্রকৃতি নিয়া উদাসি বা আশ্চর্য একটা ফিলসফি প্রকাশ কৈরা হাদির গল্পে চমৎকার একটা সমাপ্তি টাইনা দিতে পারি।
কিন্তু বাস্তব হইল, হাদিরে এরপরে আর কখনো কেউ দেখে নাই। হয়তো দেইখা থাকলেও, মানুষটা তখন আর হাদি ছিল না।
আমি এখন বাঁইচা আছি। হয়তো বছরে একবার, কোন শব্দ- কোন পরিস্থিতি- কোন স্মৃতি হাদিকে টাইনা নিয়া আসে আমার মাথায়। আমি মাঝে মধ্যে সন্দেহ নিয়া ওভারব্রিজের ওপরে বসা ভিখারির দিকে চায়া দেখি, বাসের কন্ডাক্টরের দিকে চায়া দেখি, ডাবঅলারে চায়া দেখি। একবার সুন্দরবনে বউ বাচ্চা নিয়া ঘুরতে গেছিলাম, সেইখানে আমাদের গাইডটারে চকিতে দেইখা আঁতকাইয়া উঠছিলাম- এইটা কি হাদি?! কিন্তু না, পরিপূর্ণ হাদি আর আসে নাই আমার সামনে। মানবজাতির সদস্যদের মাঝে র্যান্ডম ভাবে তাঁর অস্তিত্বের কণা আমি অনুভব করি। আমার মনে হয় তখন হাদির কথা, চাচাজির কথা, সেই দৌড়ানির কথা। এবং আমি মইরা যাব একটা সময়, আমার সাথে মইরা যাবে এসব স্মৃতি এবং হাদি পোলাটা।
হাদি - যে পোলাটা হাইকুর মতো ছিল। কথা কম কৈত, কিন্তু যা কৈত মাথার উপ্রে দিয়া যাইত সব।