somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুঃখিত, শর্মিলা বোস, গ্রহন করা গেলনা (২য় পর্ব)

১৮ ই জানুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৫:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব

***************************************************************
৩. প্রত্যক্ষ বা সরাসরি মিথ্যাচার
প্রফেসর বোসের এই গবেষণা প্রবন্ধে বেশ কিছু মিথ্যে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, তবে খুব চাতুর্যের সাথে। কারণ, তিনি তথ্যগুলো পরিবেশন করেছেন সূত্র দিয়ে ঠিকই, কিন্তু সেটা সর্বজনবিদিত সূত্রগুলো এড়িয়ে (এই আলোচনার ২য় পয়েন্টে ত্রুটিপূর্ণ তথ্যসূত্রের আলোচনাটা হয়েছে)।
সবচেয়ে বড় মিথ্যে তথ্যটি তিনি পরিবেশন করেছেন ৭১ এ বাংলাদেশে "অপারেশন সার্চলাইটে" নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা নিয়ে। যেখানে সুলিখিত সব সূত্রে এই সংখ্যাকে ৯০ হাজারের উপরে বলে ধারনা করা হয়েছে, সেখানে তিনি সেটাকে ৩৪ হাজারের বেশী মানতে রাজী নন। সেজন্য তিনি বরাত দিয়েছেন তৎকালীন সিআইএ চীফের ৬ মার্চ আর ২৬শে মার্চ মিটিঙে করা মন্তব্যকে, যেখানে একটা সাধারণ ধারনা প্রকাশ করেছেন সিআইএ চীফ। ড. বোস কি আর কোন সূত্র পেলেননা? তাঁর কি ধারনা ২৬শে মার্চের পর এদেশে আর কোন পকিসৈন্য আসেনি? অফিশিয়াল ডকুমেন্টেই বন্দীর সংখ্যা যেখানে ৯০ হাজারের বেশী, অধিকাংশ সূত্রই যেখানে নিয়াজীর বাহিনীকে ৯৩ হাজার সৈন্যসমৃদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছে, সেখানে প্রফেসর বোস খুব সুকৌশলে সংখ্যাটিকে ৩০ হাজারের কাছাকাছি রাখতে চান। এখানে যে ব্যাপারটা খেয়াল করতে হবে তা হলো, তিনি এই সংখ্যাটিকে শুধু ইতিহাস বর্ণনার খাতিরে উল্লেখ করেছেন, তা কিন্তু নয়। সুষ্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এ মিথ্যাচারটি এই প্রবন্ধে হয়েছে, এবং সেই উদ্দেশ্যটি হলো তাঁর মূল বক্তব্যের জন্য একটি সংখ্যাতাত্বিক ব্যাখ্যা, যেখানে তিনি দাবী করেন যে ৭১ এ পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের বাঙালী সহযোগী বাহিনী, যেমন রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটি ও অন্যান্য -- এদের দ্বারা সংঘটিত ধর্ষনের সংখ্যা কয়েক হাজার মাত্র। পাকবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩৪ হাজার ও তাদের সহযোগী বাঙালীর সংখ্যা ১০ হাজারের মতো ধরে নিয়ে তিনি দাবী করেন,
"Most commentators on sexual violence in East Pakistan do not appear to realise how small a force was attempting to put down a rebellion in a province with a population larger than all the other provinces in West Pakistan put together"।
অথচ, সংখ্যাতাত্বিক বাস্তবতা বলে, ৯০ হাজারের বেশী পাক হানাদার আর অগুনতি রাজাকার ও অন্যান্য সহযোগীরা মিলে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর ২ লাখের বেশী ধর্ষণ করার কথা।

প্রফেসর বোসের পরবর্তি মিথ্যাচারটি আরো হাস্যকর। এখানে তিনি তাঁর সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন হামুদুর রহমান কমিশনের বক্তব্য যেখানে হামুদুর রহমান দাবী করেছেন যে ব্রিটিশ-অস্ট্রেলিয়ান মেডিক্যাল টিমটি ঢাকায় মাত্র কয়েকশ গর্ভপাত সম্পন্ন করেছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ক্রমাগত "২ লাখ" শব্দটির অপব্যবহারের কারণেই এই সংখ্যাটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
"Hamoodur Rahman Commission’s article says, “The falsity of Sheikh Mujibur Rahman’s repeated allegation that the Pakistani troops had raped 2,00,000 Bengali girls in 1971 was borne out when the abortion team he had commissioned from Britain in early 1972 found that its workload involved the termination of only a hundred or more pregnancies"
অথচ বাস্তবতা হলো, তৎকালীন বাংলাদেশে যে ব্রিটিশ, আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তারদের দল এ্যাবরশনের কাজ পরিচালনা করেন তাদের সদস্য, আইপিপিএফ চেয়ারম্যান ওডার্ট ভন শুলজ, ড. জিওফ্রে ডেভিস ও অন্যান্যদের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে শুধু ঢাকার ক্লিনিকগুলোতেই ২৩ হাজার এ্যাবরশন সম্পাদিত হয়। এই সংখ্যাকে হামুদুর রহমান কমিশনের মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে কয়েকশ' হিসেবে ঘোষনা করেছে, আর প্রফেসর বোস সেটাই ব্যবহার করেছেন। তিনি কাদের পক্ষে কথা বলতে চাইছেন? যুদ্ধে নিগৃহিত নারীদের পক্ষে? নাকি, যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী হানাদারদের পক্ষে?

৪. পরোক্ষ বা সূক্ষ্ম মিথ্যাচার
প্রফেসর বোসের এই লেখায় প্রত্যক্ষ মিথ্যাচারের সাথে সাথে কিছু পরোক্ষ মিথ্যাচারও চলে এসেছে। এখানে পরোক্ষ মিথ্যাচার বলতে বোঝানো হয়েছে যে, লেখাটি পড়ে পাঠকের অনুমান একটি মিথ্যের দিকে চলে যাবে। যেমন তিনি বলেছেন,
"The rebellion in then East Pakistan (populated mostly by Bengalis) resulted in war between those who wanted to secede to form the independent country of Bangladesh and those who wished to preserve a united Pakistan. There were Bengalis on both sides of this political divide. Many Bengali members of the armed forces or police defected to the rebel cause, but others remained loyal to Pakistan."
এখানে তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের মূলফ্রন্ট জামাত ইসলামি বাংলাদেশের বক্তব্যের পূর্ণ প্রতিফলন করলেন। এই শিবিরটিও ইদানিং এমন একটি ধুয়া তুলছে যে তখন দেশ দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, যুদ্ধটা ছিল গৃহযুদ্ধ। এটা বলা তখনই সম্ভব হতো, যখন দেশের মানুষ সংখ্যার দিক দিয়ে কাছাকাছি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে দুটো পক্ষ নিত। বাস্তবে কি হয়েছে সেটা কি ডক্টর বোস কোথাও খুঁজে পাননি। উপরের উদ্ধৃতিতে তাঁর শেষ বাক্যটি অনুবাদ করলে এমন দাঁড়ায়, "অনেক বাংলাদেশী সেনা বা পুলিশ সদস্যই বিদ্রোহীদের দলে ভিড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাকীরা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ছিলেন।" এই বাক্যটি পড়লে হঠাৎ একজনের মনে হওয়া কি স্বভাবিক না যে আমাদের বাঙালীদের বেশীরভাগেরই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ছিল? এটা ভীষন রকমের চাতুর্য। এই একটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে তিনি পরোক্ষভাবে ৭১ এর প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ শক্তিকে প্রায় সমান বা কাছাকাছি সংখ্যার বলে পরিবেশন করলেন, যেটা থেকে যুদ্ধটাকে দেশের দুটো রাজনৈতিক ফ্রন্টের মাঝে গৃহযুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করার একটা প্রয়াস যে কেউ পেতে পারে। তদুপরি, উপরের বক্তব্যে তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগনের মতামতের প্রতিফলনও ঘটেনা।

প্রবন্ধের আরেকটি জায়গায় তিনি যুদ্ধে ধর্ষিতা নারীদের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন,
"The available material shows that the victims of rape were Hindu and Muslim, Bengali, Bihari and West Pakistani" -- যেখানে তিনি সব ভিকটিমকে এককাতারে ফেলে দিয়েছেন। যদিও বিহারী হোক বা পাকিস্তানী হোক আর বাঙালী হোক, ধর্ষণ সমানমাত্রার অপরাধ, কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে বক্তব্যটি পড়লে মনে হবে যে ৭১ এ সবপক্ষই সবপক্ষকে "কমবেশী" নির্যাতন করেছে, যেটা তিনি সুচতুরভাবে পাঠকের মনে প্রোথিত করতে চেয়েছেন।

এরকম পরোক্ষ মিথ্যাচার কোনভাবেই প্রত্যক্ষ মিথ্যাচারের চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়।

এপর্যন্ত যে চারটি দিক আলোচনা করা হয়েছে তাতে প্রফেসর বোসের ভুলগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়েছে। অবশ্যই যেকোন বিষয়েই একজন গবেষক গবেষণাকাজ (পরীক্ষণ, নিরিক্ষণ বা তথ্যসংগ্রহ যেটাই হোক ) শুরু করার আগেই একটি ধারনা মনের মধ্যে পুষে রাখেন, এবং তাঁর সকল ব্যাখ্যাকে তিনি সেই ধারনার দিকে নিয়ে যেতেই পছন্দ করেন। তবে এক্ষেত্রে প্রফেসর বোসের মতো জ্ঞানী ব্যাক্তির মনোভাবকে সেরকম নির্দোষ গবেষকের ভুল হিসেবে গ্রহনের চেয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ধারণা করাই বাস্তবসম্মত বলে মনে করি। তবে প্রফেসর বোস শুধু প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ মিথ্যাচার বা দূর্বল সূত্রের আশ্রয়ই নেননি, প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে পাঁচজন সাক্ষ্যদাতার বক্তব্যকে মিথ্যে হিসেবে দেখাতে গিয়ে তিনি যে যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন সেগুলোর মধ্যেও বেশকিছু যুক্তি খুবই দূর্বল। তদুপরি বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য পড়ে মনে হয়েছে তিনি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত নন, অর্থাৎ সেবিষয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা না করেই তিনি প্রবন্ধটি লিখে ফেলেছেন। পরবর্তী পর্বে সেবিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।

(চলবে .....)

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৫:৩৮
১০টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×