somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জানুয়ারী মাসের গল্প

১৩ ই আগস্ট, ২০০৯ ভোর ৬:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কনকনে শীত,সেই সাথে কুঁইচ কুঁচি বরফে ছেয়ে যাচ্ছে সারা শহর,আমি মাত্র দেড়মাস আগে পৌছেছি টরোন্টো শহরে,বাড়িতে ছোটদুটো বাচ্চাকে বোনজামাই এর কাছে রেখে আমি ছুটছি ৬ ঘন্টার একটা ট্রেনিং-এ ।
২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখে ৫বছরের বাচ্চাকে সংগে নিয়ে টরোন্টো পৌছেছিলাম আমি। তারপর থেকেই আরো লক্ক লক্ক নতুন ইমিগ্রান্টদের মতো আমার পৃথিবীও দুলে উঠেছিলো,কি করলাম আমি? কেন এলাম এই শহরে? কিসের আশায়? এরকম লক্কাধিক প্রশ্ন আমার বিদেশ আসার সব আয়োজনকে ভেংগে চুরমার করেছিলো প্রথম দ-ুতিনদিনেই । কিন্ত মানুষ মনে হয় পৃথীবির সেই প্রানী যে সবচেয়ে বেশী সয়,আমার নানী বলতেন ”যে সয় সে রয়”। আমিও আর সবার মতোই সাধারন মানুষ বরং বলা উচিত বড় বেশী সাধারন। ছোটবোনর বাড়িতে এসে উঠেছি,বোন ও বোনজামাই ডিসেম্বর এর ছুটি শেষে অফিস শুরু করলো আর আমিও বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসার পর অফুরন্ত অবসর পেলাম,সেই সময়কে কাজে লাগিয়ে ম্যাগডোনালস এ কাজ জুটিয়ে ফেললাম ।
২০০৫ সাল , জানুয়ারী মাস ,তখনো আমার সিন কার্ড আসেনি, টরোন্টো শহরে সবাই বলল,এই সময়টা হায়ারিং হয় না, কিন্তু আমাকে ঠেকাবে কার সাধ্য?সেই ট্রেনিংয়েই ছুটছিলাম আমি সেদিন,সে কি উত্তেজনা, আমার আশে পাশের অনেকেই ধন্যি ধন্যি করতে লাগলো,তুই এত তাড়াতাড়ি কাজ পেলি কি করে, আমার ছোটবোনের এক বিদেশী কলিগ তো বলেই বসলো ” তোমার বোন কি অনেক স্মার্ট যে মাত্র দেড়
মাসের মাথায় কাজ পেলো”। না,স্মার্টনেস দিয়ে আমার কাজ হয়নি,কাজ পেয়েছি লেগে থেকে।
২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আমি একটি কলেজে দুবছরের ফুলটাইম পড়াশোনায় ডুকে গেলাম,আর সেই বছর থেকেই আমার চিন্তা কি করে আমি একটা জব পাবো। আমার ফিল্ডেই প্রোফেশনাল জব। যদিও ততদিনে আমি জেনে গেছি যে টরোন্টো শহরে টিকে থাকা কাকে বলে আর জবেরই বা ভবিসৎই কি । এই কথাটা বলতে গিয়েই আমার ছোটবোনর সাথে আমার একদিনের কথোপকথনের লোভ সামলাতে পারছি না। আমার বোন তখন কাজ করতো রায়ারসন ইউনির্ভাসিটিতে যদিও অফিস জব কিন্তু আমার মুর্খতার কারনেই আমি ওকে একদিন বললাম তুই কি কাজ করিস ওখানে ” খুব হেসে সেদিন কনা আমাকে বলেছিলো, মেজপা আমি যা করি তার জন্য আমার তিনটা মাস্টার্স এর কোন দরকার ছিলো না আমার দেশের ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলেই আমি এই জবটা করতে পারতাম”(এখন চাকরি নিয়ে কনা চলে গেছে সেই ডালাস শহর)। এই শহরে আমি মনে হয় এই গল্পটা কয়েক লক্কবার করেছি কারন এই সত্য শুধু কনার জন্য নয় বরং পুরো টরোন্টোর চাকরিবাজারেই এটা ভীষন সত্য। যা হোক,সাহস করে তো পড়া শুরু করলাম এবং সেই প্রথম সেমিস্টার থেকেই চাকরি পাবার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম কারন আগেই বলেছি আমার জীবনের কাল হচ্ছে আমার অদম্য উৎসাহ । আমি কলেজে যাই আর তক্কে তক্কে থাকি আমার লাইনের জবের জন্য একটা ভলেন্টারী কি করে জোটানো যায়,দেখতে দেখতে ২০০৫ সাল প্রায় ফুরিয়ে আসতে লাগলো,একদিন আমার সহপাঠী বন্ধু সুমনের দিদির বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ননপ্রফিট অর্গানাইজেশন(এজিনকোর্ট কমিউনিটি সার্ভিস সেন্টার) এর সুত্র পেয়ে গেলাম,কি খুশি আমি সেদিন,ডেভিডদাকে বললাম দাদা চাকরি দিতে হবে না শুধু গেইল গিলবার্ট(ইডি,এজিন কোর্ট) এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন আমি ভলেন্টারী কাজ করবো ।
২০০৬ সাল জানুয়ারী মাস,আমি এজিনকোর্টে ভলেন্টারী শুরু করলাম , মনে পড়ে কলেজ শিক এ্যান বোরলেন্ড খুশিতে ফেটে পড়ছিলো, আমাকে বলল ” ইউ উইল গেট দ্যা জব সুন”। আমার সময় কেটে যেতে লাগলো,ম্যাক এ পার্টটাইম কাজ করি,ফুলটাইম কাস করি,সপ্তাহে একদিন ভলেন্টারী করি আর স্বপ্ন দেখি একদিন আমি এই শহরে ভালো কাজ পাবো,যদিও সময়র সাথে সাথে আরো বেশী বাস্তবতা আমাকে ঘিরে ধরেছিলো,আমি জেনেছিলাম চাকরি টরোন্টো শহরে সোনার হরিন। ২০০৬ সালের শেষের দিকে কলেজেই পরিচয় হয় কাসমেট জুডির সাথে ও কাজ করে কলেজে আই সেন্টার এসোসিয়েটস হিসেবে,আমার তখনো পড়া শেষ হতে ৬ মাস বাকী,জুডিকে বললাম, আমি কাজ করতে চাই জুডি পথ দেখায়।
২০০৭ সালের জানুয়রী মাসের ৯ তারিখে আমি কলেজে পার্টটাইম কাজ পাবার পরে মনে হয়েছিলো,মানুষের অসাধ্য কি আছে? অনেক আত্বতৃপ্তির আর বিশ্বাসের সুচনা করেছিলো সেন্টেনিয়াল কলেজের কাজটা । মাত্র ৬ টা মাস,আমি পলক ফেলার আগেই শেষ হয়ে গেলো , আমার পড়াও শেষ হলো,সব শেষ, চারিদিকে শুন্যতা, আমি তখনো আলোর খোজে ঘুরছি,এজিনকোর্টে কাজ করতাম গায়ানিজ মহিলা মেয়েলিন সিংরয়ের সাথে,মেয়েলিনের কানেকশনে আমার লাইনেই একটা পার্টটাইম কাজ পেলাম ,খুব অল্প আওয়ার প্রয়োজনের অর্ধেকটাও মেটায় না , কিন্ত এই লাইনেই আমার জব হবে এটুকু নিশ্চিত বুঝে গেলাম আমি । দিন কাটে, রাত আসে আমি আর আমার ছেলে , আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছি জব না জোগাড় করে ছাড়বো না,২০০৭ সাল প্রায় শেষ হয়ে এলো , আমাকে কি আরো একবছর পার করতে হবে? এমনি নানান অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন পার করছি আর ছাড়ছি জব এপ্লিকিশেন,কেমন কেমন করে ডিসেম্বর মাসেই আমি তিনজায়গা থেকে ইন্টাভিউ কল পাই,আশা বেড়ে যায় আরো মনেযোগ দিয়ে কাজ খুজতে থাকি।
২০০৮ সালের জানুয়ারী মাসের ৮ তারিখ, কস্টি থেকে ফোন করে আমাকে জানানো হয় ”উই ওয়ান্ট টু অফার ইউ দ্যা জব” আমার পৃথীবি দুলে উঠে,কেমন নিভার্র মনে হয় জীবনকে। মুলত ,জন্মেছিলাম এই জানুয়ারী মাসেই, রংপুরের কারমাইকেল কলেজের সেই ছোট একতালা বাড়ি,খুব ভোরে আমি এসছিলাম পৃথীবিতে,মা বলেছেন, আমি হবার পরে বাবা যখন আজান দেন তখনো নাকি শীতের কুয়াশা কাটেনি, চারপাশটা অন্ধকার হয়ে ছিলো, আর ঠিক সেইদিনটাতেই পৃথীবির বুক চিরে প্রথম লুনা নামে একটি রকেট চাঁদে গিয়েছিলো বলেই আমার নাম হয়েছে লুনা । এসব গল্প যখন লিখছি তখনো আমার বেসমেন্ট দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এসছে,এখন টরোন্টোতে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়,জানুয়ারী মাস বলেই হয়তো এমন হয়।আমি আধাঁর ঠেলে ঠেলে আলো খুজে বেড়াই,আলোর কোন যোগ নেই আমার রাশিতে ,মধ্যবিত্ত কলেজ শিকের ঘরে জন্ম আমার,খুব বড় করে স্বপ্ন দেখার মতো কোন ঘটনা কখনোই ছিলো না,বরং ছোটবেলা থেকেই জানানো হয়েছিলো ভাগ্য গড়তে হয়,কেউ গড়ে দেয় না। আমি তো গড়তেই চেয়েছি নিজেকে,কিন্তু জানুয়ারী মাস এলেই কেন অন্ধকার হয়ে আসে আমার পৃথিবী?আমার অতীত ,আমার ফেলে আসা সময় ,সবকিছু কেমন সাদা সাদা বরফে ডেকে যায় ।

লুনা শীরিন ,টরোন্টো , কানাডা।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×