ফেসবুকের দুএকটা গ্রুপে দেখলাম কয়েকজন ডিপ্রেশন এর পোস্ট দিচ্ছেন । কয়েকজন এর প্রোফাইল এ দেখলাম এরকম পোস্ট । কয়েকমিনিট নিয়ে পড়ুন এটা । আত্মহত্যার আগে নাহয় একটু সময় করে পড়ে গেলেন । আমার আত্মতৃপ্তি থাকবে একজন মৃত্যুপথযাত্রী আমার পোস্ট পড়ে গেছেন । যদিও লাইফে অনেক বড় কিছু করে ফেলে নাই , তবুও পড়েন ।
আপনারা ডিপ্রেশন জিনিসটা কি এখনো তবে উপলব্ধিই করেন নাই।
এমন কোন একটা সময় গেছে হয়তো আপনার ঘড়ের চাল নেই ডাল নেই, তার উপর আপনার Needs আছে। আপনার বাবার হাতে টাকা নেই। সেই ডিপ্রেশন কি এখনো আপনার স্বপ্নেও আসে নাই। আপনি যখন পরীক্ষা দেন, রাত জেগে একা আপনি পড়া লেখা করেন নাই। সেই প্রত্যেকটা রাত আপনার মা-বাবাও জেগেছিলেন। আপনার রেজাল্ট এর সময় আপনার মা-বাবার দুশ্চিন্তা আপনার থেকে কয়েকগুণ বেশী ছিল সেটা জানেন কি ? আপনি খারাপ করলে কতটা কষ্ট পাবেন সেটা চিন্তা করে তাঁহারা কি পরিমান কষ্ট পেয়ে গেছেন সেটা না বলাই থাক।
এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরাও গেছি। খারাপ রেজাল্ট আমাদেরও হয়েছে। ভার্সিটিতে আমরাও চান্স পাই নাই। ডিপ্রেশন আমাদেরও ছিল। কিন্ত সাহস হারাই নাই। আমার আশেপাশের মানুষের কানাঘুষা আমারও কানে আসতো। কেউকেউ আমার মা-বাবাকেও ব্যাঙ্গ করতো, কানে নেই নাই। যেই অধ্যায় চলে গেছে, পেছনে গিয়ে সেটা ঠিকতো করতে পাড়ব না তাই না? সামান্য সামান্য ফেসবুকে মার্কেটিং জানতাম। অনেকের পুরনো মোবাইল বিক্রি করে দিতাম। সেখান থেকেই সামান্য প্রফিট বানাতাম। কয়েকটা টিউশানি নিলাম। সেখানেই চিন্তা করলাম যা আমি পারি নাই আমার স্টুডেন্ট রা পাড়বে। সেই লিস্টে ঐ প্রতিবেশীদের সন্তানও ছিল। খাড়াপ রেজাল্ট থাকায় টিউশানির বেতন স্কেলটাও অন্য সবার থেকে কম ধার্য করত সবাই। সব মেনে নিলাম। পুরো দুইটা বছর এই ডিপ্রেশন কি জিনিশ হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করলাম আমি। জেএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট যখন আসলো তখন সামান্য শান্তি এলো মনে। যেই স্টুডেন্ট ক্লাস সিক্স থেকে রেগুলার পাশ করে এইটে উঠতে পারে নাই সেই স্টুডেন্ট A পেল। বলছি না আমিই করে দিয়েছি, স্টুডেন্ট টা অনেক মেহনত করেছে। কিন্তু ওর যে মোটিভেশন আর গাইডেন্স দরকার ছিল সেটাতো আমিই দিতেছি। খারাপ সময় এলো স্টুডেন্ট টা যখন ক্লাস নাইনে উঠলো। ওর বাবা মা আরো ভালো টিচারের ব্যাবস্থা করলেন। এই টিচার সব ব্রাইট স্টুডেন্টদেরই পড়ান। মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা সামান্য এদিক সেদিক করে হয়তো বেতনটাও জোগাতেন। আমাকে নিয়ে রিস্ক নিতে চাইলেন না। তবে সরাসরি বললেন না। এরই মধ্যে অন্য স্টুডেন্ট এর এসএসসি রেজাল্ট চলে আসলো। তোলনামূলক ভালই রেজাল্ট হল ওর। ওরা ছেড়ে দিল না আমায়। ওদের এখান থেকেই আমাকে বলা হলো ওদের বাঁকি বাচ্চাগুলো পড়াতে। ওরা নিজে থেকেই আমার বেতন বাড়িয়ে দিল। Encouragement পেলাম কারো কাছ থেকে। এলাকায় আরো দুএকটা জেএসসি স্টুডেন্ট পেলাম। আগের মতো তলানিতে থাকা। টেনে নিয়ে এলাম এদের। এরকম ও হয়েছে সন্ধ্যায় একজনের প্রাইভেট শেষ করেছিতো রাতে দশ এগারোটার দিকে গিয়ে আবার ঘরে এসেছি আমি । পরীক্ষার আগে কত রাত যে ওদের ফলোআপ করতে গেছি সেটা আমি জানি । এই তোলনায় বেতনটা কম ছিল । এলাকায় যারা প্রাইভেট পড়াতো তাদের অনেকের কাছে আমার এই কাজ বাড়াবাড়ি দেখালো । দুএকজন এটা ফলো করলো । একটা আউট অফ ট্র্যাক এর স্টুডেন্ট কে ট্র্যাক এ ফিরিয়ে আনাটা সহজ উপায় নয় । সেটাও করতে হয়েছে আমাকে । নয় মাস টাইমে একটা তলানিতে থাকা স্টুডেন্ট কে উপরে আনা অনেকটা কষ্টের কাজ । কি পরিমানের অধ্যাবসায় করতে হয়েছে একটা ছাত্রের সাথে তা আমিই জানি । এদের একজন তো অবিশ্বাস্য রেজাল্ট দেখালো। তলানি থেকে উঠে এসে এ+ নিয়ে আসলো। এলাকায় সামান্য ইজ্জত বাড়লো আমার। সবাই পড়াতে চায় এখন। এখানেই আমার ইকনোমিক জ্ঞান ব্যাবহার করলাম। ডিমান্ড বেড়ে গেছে, বাজারে মূল্য ধরে রাখতে প্রোডাক্টিভিটির সাথে সাথে ডিমান্ড টা ধরে রাখতে হবে । অনেককে মুখের উপরই না করে দিলাম। আমাকে এপ্রোচ না করতে পেড়ে আব্বাকে সবাই এপ্রোচ করতে লাগলো। দুই বছর আগে যেই আমি জিরো ছিলাম প্রতিবেশীদের কাছে সেই আমিই হিরো হয়ে গেলাম হয়তো । সেই স্টুডেন্ট যারা আমাকে অহেতুক বাদ দিয়ে দিল ও ক্লাস নাইনে ইংরেজি তে ফেল করে বসলো। এবার ঐ ভদ্রলোক আবার এলেন বাচ্চাকে পড়ানোর ফরমায়েশ নিয়ে। এবার আমি আমার ডিমান্ড বাড়ালাম। কিছুদিন আগে যেই মানুষগুলো আমাকে আমার রেজাল্ট দিয়ে কাউন্ট করতো তারাই তখন আমার স্টুডেন্ট এর রেজাল্ট দিয়ে কাউন্ট করতে শুরু করলো।
ডিপ্রেশন জিনিষ কি এখনো ক্লিয়ার না তো? আব্বা অসুস্ত হয়ে ফেমিলির কাজ থেকে রিটায়ার্ড নিলেন। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে আমরা ছোট ফেমিলিতে এসে পড়লাম। সব আম্মার আর আমার উপর এসে পড়লো। ছোট ভাই বোন এর দায়ীত্ব আমাকেই নিতে হলো। এদের স্কুল কলেজের ফী, আম্মা আব্বার ঔষধ এর টাকা, ফেমিলি খরচ সব আমাকেই টানতে হবে। ডিপ্রেশন সেখানেই শুরু। মালয়েশিয়া আসলাম স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে। যাদের ফেমিলির কেউ স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া আছেন তাঁদের জিজ্ঞেস করলেই হবে স্টুডেন্ট ভিসার ভ্যালু কতটা মালয়েশিয়া । কম সেলারি, নিজের পড়ালেখার খরচ, থাকা খাওয়ার খরচও এড হলো এবার আমার দায়ীত্বের মধ্যে । এমতাবস্থায় ডিপ্রেশন কি কল্পনা করেন। তারপরও দিব্বি আছি। তবে ডিপ্রেশন টা বেড়ে যায় যখন ভাই বোন পরীক্ষা দেয় তখন। ওদের রেজাল্ট এর টাইমেতো কথাই নেই নিজের উপর কি আসে । কি করবে, কি পড়বে,' কিভাবে হেন্ডেল করবে এগুলো চিন্তা করতে করতে । ডিপ্রেশন কি জানেন ? ১২ ঘন্টা কাজ করে আসার পর যখন আপনার মনে হবে আগামীকাল পরীক্ষা ! পড়তে বসবেন কিন্তু মাথায় কিছু আসবে না । তারউপর আপনাকে দুইটার ভেতর পরীক্ষা শেষ করে কাজে ঢুকতে হবে । ঠিক দশ বছর পেছনে চলে যাই বারবার আমি । আব্বা কিভাবে স্ট্রাগল করতেন সেটা ভাবি । বরাবর স্ট্রাগল করতে কার ভাল লাগে ? মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় পালিয়ে যাই । ডিপ্রেশন মানুষকে সুইসাইডেও ইনসিস্ট করে এটা বলে দেয়া লাগবে না নিশ্চই । তখনই মনে পড়ে এটাতো মাত্র শুরু । আব্বা সারা লাইফ করতে পাড়ছেন । আমার থেকে কম শিক্ষা ছিল , কম সুযোগ ছিল । তারপরও করেছেন । আমি সব পাচ্ছি , তবে কেন করতে পারবো না । আমি কেন আত্মহত্যা করবো ? আমি আত্মহত্যা করার জন্যতো আম্মা সারারাত আমার পাশের ঘড়ের বিছানায় শোয়ে ঘুমের অভিনয় করতেন না । আব্বা সারাদিন খেটে এসে যখন জানতে পাড়তেন এই সপ্তাহের মধ্যে বড় অংকের টাকা আমার স্কুলে জমা দিতে হবে শোনে হাসিমুখে শোয়ে পড়তেন । তিনি সারারাত ঘুমোতেন না এই পাপের শাস্তি কি তবে তাঁকে দেব ? সুইসাইড করাটা ইজি । আরামসে খেয়ে দেয়ে ঘড়ের ফেনের সাথে ঝুলে পড়েন , রেল লাইনে শোয়ে পড়েন , ছয়তলা বিল্ডিং থেকে স্টান্ট দেন । আপনি একটা পরাজিত জীবনের কাছে জিতে যাবেন । এই জীবন আপনাকে আর টর্চার করতে পারবে না । আপনি জানতে পারবেন আপনি জিতে গেছেন ,শুধু জানতে পারবেন না পেছনে হেরে যাওয়া দুইটা মানুষের গল্প । যেই প্রতিবেশী আত্মিয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধব এর অবহেলাত আপনি আত্মহত্যা করলেন জানতেও পারবেন না আপনার মৃত্যুতে তাদের কিছু যায় আসে নাই । তারা আগে যেখানে বলতো ছেলেটা পরীক্ষায় ফেল করেছ সেখানে এখন বলে ছেলেটা জীবনের পরীক্ষায় ফেল করেছে । আপনি বরাবর তাদের কাছে পরাজিতই থাকলেন । এই মৃত্যুতে তাদের ঘড়ের কোন কোণে শূন্যতা আসে নাই । কারো কলিজা মোচড় দেয় নাই । ক্ষতি হয়েছে সেই দুইটা মানুষের যারা তাদের পুরো জীবনটাই জীবিত হয়েও আত্মহত্যার নামে করে দিয়েছে ।
বলছি না ডিপ্রেশন করবেন না। এইটা একটা Failure, কাজে লাগান এটাকে । হয়তো ভাল কিছু হবে একদিন। হাল ছাড়বেন না শুধু। আপনার মা বাবা আপনাকে হাল ছাড়ার জন্য জন্ম দেন নাই। কোটি কোটি শুক্রাণুর সাথে যোদ্ধ করে জন্ম নিয়েছেন, তখনো হাল ছাড়েন নাই। এখন কেন ছাড়বেন?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:৪৩