মহামান্য,
আপনার এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি যথাবিহীত সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট, ১৯৭৩ সম্পর্কে আপনাকে লিখছি। ‘১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের বিচারে আপনার সরকার নজির স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে এ জন্য আমি বাংলাদেশের প্রচেষ্টার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি। সে লক্ষ্যে বিশেষ আদালত স্থাপন, বিচারক প্যানেল গঠন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) অ্যাক্টকে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে বিতর্কিত কিছু ধারাও পরিবর্তন করা হয়েছে মর্মে জেনেছি আমি।'
স্বচ্ছ বিচারের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে মানদন্ড রয়েছে তা বাংলাদেশের আইনটিতে অনুপস্থিত বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আইনটির বিষয়ে সবচেয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া বিভাগ, দ্য ওয়ার ক্রাইমস কমিশন অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন, দ্য ওয়ার ক্রাইমস প্রজেক্ট ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না এবং এই আইনের মাধ্যমে তাদের যে সাজা প্রদান করা হবে তার বিরুদ্ধেও তারা কোনো প্রতিকার চাইতে পারবেন না। বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যক্তির মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে যা-ই থাকুক না কেন- এ জাতীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইনে। অন্যান্য অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে যে নিয়ম প্রযোজ্য তা এই অ্যাক্টের ক্ষেত্রে রাখা হয়নি। আইনটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগও রাখা হয়নি, যা সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার হরণের মাধ্যমে করা হয়েছে। আইনের চোখে সবাই সমান বলে যে মৌলিক বিধান আছে তা-ও এখানে খর্ব করা হয়েছে। বিচারকে আন্তর্জাতিক মানের এবং স্বচ্ছ করার জন্য এ আইনের সংশোধন খুবই জরুরি।
এই আইন ও বিচারকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না মর্মে যে বিধান রাখা হয়েছে তা-ই আইনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ বিচারের পরিপন্থী করে তুলেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির নীরব থাকা বা নিজেকে নির্দোষ ঘোষণার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং সাক্ষীর দায়দায়িত্ব সম্পর্কে কোনো কিছু বলা হয়নি আইনে। আইনটি যেহেতু যুগোশলাভিয়া ও রুয়ান্ডা যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠনের (এ আদালতের ধারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন হিসেবে স্বীকৃত) আগে প্রণীত হয়েছে, তাই ২০০২ সালে প্রণীত রোম সংবিধি অনুযায়ী আইনটি সংস্কার করা উচিত। বাংলাদেশও রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ।
প্রয়োজনীয় সংশোধন ছাড়া এই আইনের মাধ্যমে বিচারকাজ চালিয়ে গেলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিতর্ক বাড়বে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বর্তমান আইন অনুযায়ী যিনি সাধারণ সামরিক আদালতের বিচারক হওয়ার যোগ্য তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বা সদস্য হতে পারবেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী সামরিক আদালতের বিচারকরা কেবল সামরিক সংক্রান্ত বিষয়েই বিচার করতে পারেন। তদুপুরি ট্রাইব্যুনালের কার্যপদ্ধতি এই আইনের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিষয়টি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আইনটিকে সংশোধন করে যদি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা না হয়, তাহলে এই আইনের মাধ্যমে বিচারকাজ পরিচালনা করা হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির মানবাধিকার রক্ষা অসম্ভব হবে। আইনটি বর্তমানে যে অবস্থায় আছে তাতে দায়মুক্তি থেকে বের হয়ে আসার যে উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে তা যেমন চাপা পড়ে যাবে, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ বার্তা ছড়িয়ে পড়বে যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই এ আয়োজন করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো ক্ষুদ্র বিষয় জড়িয়ে জামায়াতের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব অভিযোগে গ্রেফতার করে তাদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে; তদুপরি ট্রাইব্যুনালের কার্যপদ্ধতি এই আইনের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিষয়টি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যেহেতু আপনার সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ দলের একনিষ্ঠ মিত্র জামায়াত, সেহেতু জামায়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করাই হলো ট্রাইব্যুনালের প্রাথমিক কাজ- এ বিশ্বাসই সমাজে এখন বিদ্যমান। আইনটির যথাযথ সংশোধন করে এবং অভিযুক্তদের জন্য নিরপেক্ষ ও ভয়ভীতিমুক্ত বিচার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে আপনার সরকার ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখবে এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেবে বলে আমরা আশা করি।
যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠনের উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক বিচার অঙ্গনের অনেকেই প্রশংসা করেছিল। কিন্তু স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহের কারণে তারা সবাই উদ্বিগ্ন যে, এর মাধ্যমে অভিযুক্তদের প্রতি নিরপেক্ষ বিচারের মান বজায় রাখার অস্বীকৃতির দরুন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হতে পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধি অনুযায়ী আইনটি প্রয়োজনীয় সংশোধন করে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার ব্যাপারে আমি আপনার সরকারের প্রতি আহবান জানাই। আমার এই অভিমত প্রকাশের সুযোগ দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। এই আইন সংশোধন এবং প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচারের ব্যাপারে আমি আপনার সরকারকে সহায়তা করতে ইচ্ছুক। আপনাদের এ প্রক্রিয়ায় আমি যদি কোনো সহায়তা করতে পারি বলে আপনারা মনে করেন, তাহলে দয়া করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে কোনো দ্বিধা করবেন না।
আন্তরিক ধন্যবাদ
জন বুজমান
কংগ্রেস সদস্য