somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তারেক মাসুদের সাক্ষাতকার

২৮ শে এপ্রিল, ২০০৭ বিকাল ৫:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথমবার পুরোটা আসেনি। তাই আবার পোস্ট দিলাম। বলা বাহুল্য এডিট করা যাচ্ছে না।


বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ। আদম সুরত, মুক্তির গান, মুক্তির কথা, নারীর কথাসহ বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে মুভি বোদ্ধাদের শ্রদ্ধার আসনে স্থান করে নিয়েছেন। নাইন ইলেভেন পরবর্তী পরিস্থিতিতে মাটির ময়না মুভি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে এর বিষয়ের কারণে। মাটির ময়নার পর নির্মাণ করেছেন অন্তর্যাত্রা। কাজ করছেন ৪৭-এর দেশ বিভাগের সময়ের ওপর নির্মিতব্য নতুন মুভি নিয়ে। তিন বছরের ডেস্ক ওয়ার্ক শেষ করার পর আগামী আগস্টে শুরু হবে এর শুটিং। বড় আয়োজনের এ মুভিটি মাটির ময়নার প্রিকোয়েল/সিকোয়েল। ডিরেক্টর হিসেবে তার বেড়ে ওঠা, মুভি নির্মাণ, আগ্রহ ও অনুসন্ধান নিয়ে কথা বলেছেন যায়যায়দিনের সঙ্গে।
সাক্ষাতকার নিয়েছেন মাহবুব মোর্শেদ। ছবি তুলেছেন হাসান বিপুল

সিনেমায় আপনার শুরুর দিকটা কেমন ছিল?

আমি কাকতালীয়ই বলবো, আমার ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি। পড়েছি মাদ্রাসায়। ওখানে তো ছবি আকাই নিষিদ্ধ ছিল, সিনেমা তো তার চেয়েও বেশি। যে বয়সে মানুষ প্রচুর মুভি দেখে, সে বয়সে আমার মুভি দেখাই হয়নি। এ জন্যই হয়তো সিনেমার প্রতি আমার বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। যখন আমি মাদ্রাসা থেকে সরাসরি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে এলাম তখন কাকতালীয়ভাবে ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হলাম। এতো অল্প বয়সে ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগ হয় না কারো। সাধারণত ইউনিভার্সিটিতে ওঠে ফিল্ম সোসাইটিতে যুক্ত হয় লোকে। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারেই ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে আমার যোগাযোগ। আমি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়েছি। আমার তথাকথিত বাণিজ্যিক বা জনপ্রিয় মুভি দেখার সুযোগ হয়নি। আমার শুরুটা হয়েছে ভালো মুভি দেখার মাধ্যমে আর তা ছিল সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাস পড়ে শুরু হয়। কিন্তু আমি মুভি দেখে বিভূতিভূষণ পড়েছি। যারা মাটির ময়না দেখেছে তারা বুঝতে পারবে এটা সত্যজিৎ রায়ের প্রতি একটা টৃবিউট। মাদ্রাসায় আমাকে মুভি সম্পর্কে যে ধারণা দেয়া হয়েছে তাতে এটা যে শুধু বেশরিয়তি ব্যাপার তাই নয়, নোংরা নাচ-গান, হাবিজাবি নিয়ে তৈরি চটুল জিনিস। বুঝলাম, সিনেমা জীবনের কতো কাছাকাছি হতে পারে। এটা আমার জীবনের একটা বিরাট টার্নিং পয়েন্ট। কিছু প্রামাণ্যচিত্র দেখারও সুযোগ হলো। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ইতিহাস নিয়েও আমার আগ্রহ। যে বয়সে বই পাঠ করাটা চাপিয়ে দেয়া বিভীষিকা, সে বয়সে বই পাঠ থেকে বঞ্চিত ছিলাম বলে ইন্টারমিডিয়েট বয়স থেকে অমনিভোরাস (সর্বভুক) পাঠক হয়ে উঠেছিলাম, যা পাই তাই পড়ি।
আমি কিন্তু নির্গান ও নির্জ্ঞান। কিন্তু আমার পরিবার খুবই সাঙ্গীতিক, তাও আবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। মুক্তির গানের মূল ভোকালিস্ট মাহমুদুর রহমান বেণু আমার বড় কাকার ছেলে। এ সাঙ্গীতিক পরিবেশ আমার জন্য সৌভাগ্য। মাদ্রাসায় ছবি আকা নিষিদ্ধ ছিল বলে হয়তো আর্ট কলেজের প্রতি আমার একটা অদম্য আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে আমাকে বেশি পাওয়া যেতো আমার ডিপার্টমেন্ট অপেক্ষা আর্ট কলেজে। আমার বন্ধু-বান্ধব বেশি ছিল সেখানকার। আমি হিস্টৃতে ছিলাম। কিন্তু ঢালী আল মামুন, শিশির ভট্টাচার্য, ওয়াকিল, হাবিব, নোটনÑ এরা আমার বন্ধু ছিল। তাদের যারা শিক্ষক ছিলেন তাদের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তখন আর্ট কলেজে এতো নিয়মিত ছিলাম যে, ওখানকার অনেক ছাত্র মনে করতো আমি বোধহয় আর্ট কলেজের ছাত্র। ওখানকার অনেক ছাত্র অপেক্ষা আমি ছিলাম নিয়মিত। সেই সূত্রে কিন্তু সুলতানের প্রতি আমার আগ্রহ। ইউনিভার্সিটির ছাত্র অবস্থায় একজন চিত্রশিল্পীর ওপর মুভি বানানো আমার ধৃষ্টতা বা দুঃসাহস।

তখনই কি আহমদ ছফার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা?

হ্যা। তখন সারাক্ষণ আমরা ছফাভাইয়ের কথা শুধু যে শুনেছি তাই নয়, গিলেছিও। তার বাইরের ব্যাপারটায় আমরা যতোটা না ভুলেছি তার চেয়ে বেশি তার ভেতরটা আমাদের স্পর্শ করেছে। তিনি যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শেক্সপিয়ার কোট করে যাচ্ছেন, ফাউস্ট বলে যাচ্ছেন, কালিদাস বলে যাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ বলে যাচ্ছেন, ফটোগ্রাফিক মেমোরি থেকে ইতিহাস বলে যাচ্ছেন, ভলটেয়ার রুশো থেকে শুরু করে সবকিছু, সেটা আমাদের ভেতর গেথে যাচ্ছে। লাইব্রেরি চত্বরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার মোনলোগ চলছে আর আমরা শুনে যাচ্ছি। সুলতান সম্পর্কে আগ্রহ ছফাভাইয়ের কারণেই।
আমার সঙ্গে যারা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন করতেন তাদের মধ্যে অনেকে প্রতিভাবান ছিলেন বলে মনে করি। কিন্তু কৃজে টিকে থাকার মন-মানসিকতা তাদের ছিল না। আমাদের হয়তো স্কোর কম হয়েছে কিন্তু আমরা টিকে থেকেছি।
খসরু ভাইয়ের (মোহাম্মদ খসরু) কথা বলতে হয়। তিনি তো একটা প্রতিষ্ঠান। তার পকেট থেকেই আমরা সব বেরিয়েছি।
চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে ছিলাম কিন্তু কখনোই ভাবিনি মুভি নির্মাণ করবো। যে কারণে সাহিত্যের সঙ্গে আছি, লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আছি, চিত্রকলার সঙ্গে আছি, সঙ্গীতের সঙ্গে আছি, সে কারণেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে ছিলাম। সঙ্গীতে আশির দশকে যারাই কাজ করেছেন, যারা তাত্ত্বিকভাবে বা প্র্যাকটিকালি যুক্ত ছিলেন তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি সাঙ্গীতিক পরিম-লে ততপর ছিলাম, সক্রিয় ছিলাম। সিনেমার জন্য বোধহয় এগুলো কাজে লাগে। এটা জ্যাক অফ অল ট্রেডসের মতো কাজ। চিত্রকলা, সাহিত্য সবকিছুই সামান্য জানা। এ জানার সুযোগ হয়েছিল ওই সম্পৃক্তির মাধ্যমেই। এটাই হয়তো পরে সিনেমায় আমাকে সাহায্য করেছে। যেহেতু সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ওই সামান্যের বাইরে আমার সুযোগ হয়নি, সিনেমায় এসে সেটা কাজে লেগেছে। সুলতানকে নিয়ে মুভি করতে এসে আমি তখনো ভাবিনি, আমার পেশা হবে চলচ্চিত্র নির্মাণ।

কতো সালে আদমসুরত শুরু করেছিলেন?

শুরু করেছিলাম ১৯৮২ সালে এবং শেষ করলাম ১৯৮৯-এ। মাঝখানে ভিডিওতে একটা মুভি করেছিলাম, সোনার বেড়ি। নারী নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে ডকুমেন্টারি। তখনো অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে বিটিভির বাইরে প্রাইভেটলি ভিডিও ফরমাটে কোনো মুভি হয়নি। সুলতান বানিয়ে কিন্তু আমি রণকান্ত হয়ে রণে ভঙ্গও দিয়েছিলাম। মুভিটা শেষ করলাম সাত বছর লাগিয়ে। যা হয় ওই বয়সে, ক্যারিয়ারেরও স্বপ্ন নেই, নেম-ফেমেরও তোয়াক্কা করি না। সুলতান ভাইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণ তার বোহেমিয়ান লাইফ নয়। আমার জীবন সুলতান ভাইয়ের চেয়ে কম বোহেমিয়ান ছিল না। আজ দিনে খাবার আছে তো রাতে নেই। এখন এখানে আছি তো এই নেই, এভাবে কেটেছে। আমাদের বন্ধু-বান্ধবও ও রকম ছিল। সুলতান ভাইয়ের ওপর মুভি করার একটা কারণ ছিল আর তা হলো, তার সংস্পর্শে থাকা। নানা লোকোতসবে যেতাম। বিজয় সরকার তখন জীবিত, তার গানের অনুষ্ঠানে যেতাম। বিচিত্র সব লোকমেলায় যাওয়া হতো। গ্রামে বড় হয়েছি, কিন্তু গ্রামটাকে আমি অ্যাপৃশিয়েট করতে পারিনি গ্রামের ছেলে হিসেবে। দ্বিতীয়বার যখন সুলতানের চোখ দিয়ে গ্রাম দেখেছি তখন আমি প্রকৃত গ্রামবাংলাকে আবিষ্কার করেছি। মুভিটা হয়ে গিয়েছিল বাইপ্রডাক্ট।
মুভির শেষ পর্যায়ে ক্যাথরিনের সঙ্গে আমার পরিচয়। সুলতান মুভিটা হয়তো বোহেমিয়ানপনাতেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচয়ের পর ওই ফিল্মটা শেষ করতে আমার ওপর তাগাদা ছিল। ও মুভির শেষ পর্যায়ে যুক্ত হলো। ও জানে না কিছু। কিন্তু আমার সম্পাদক অসুস্থ ছিলেন বলে ও বললো, দেখি না কি হয়। এভাবেই ও আমার মতো কচু গাছ কাটতে কাটতে ডাকাত হয়ে গেল। আরেকটা কাকতালীয় ঘটনায় আমার জীবনে ক্যাথরিনের আবির্ভাব। সেই কাকতালীয় ঘটনার অংশ হিসেবে আমেরিকায় যাওয়া। আমেরিকায় না গেলে লিয়ার লেভিনের সঙ্গে পরিচয় হতো না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ ঘণ্টার ফুটেজ পাওয়াও যেতো না। আশির দশকে আমার বন্ধু তানভীর, মোরশেদ সবাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছিলেন। আমি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমার আলাদা দুর্বলতা ছিল, তা-ও নয়। আমি কাকতালীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের মুভি নির্মাতা।

কিন্তু ব্যাপারটা তো ঘটে গেছে। আপনি একটি না, বেশ কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মুভি বানিয়েছেন।

হ্যা, তা ঠিক। মাটির ময়না হয়তো প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধেরই মুভি। মুক্তিযুদ্ধ তো শুধু ওই নয় মাস নয়, এর পটভূমি ১৯৬৯, ১৯৭০ সালের। মুক্তির গান কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মুভি নয়, যুদ্ধের মুভি তো নয়ই। মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ। আমি কিন্তু এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের যে মূল বিষয় যুদ্ধ, তা নিয়ে কোনো মুভি বানাইনি। মুক্তির গান হচ্ছে যুদ্ধের সবচেয়ে প্রান্তিক বিষয়, অর্থাৎ বন্দুকের ধারে-কাছেও নয়। গান দিয়ে যুদ্ধ। যারা সাংস্কৃতিক কর্মী তাদের তো সবচেয়ে পেছনের ভূমিকা। এই আলোচিত ও অনালোকিত দিকটা আমি তুলে ধরেছি। মুক্তির কথা কি? মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্নভঙ্গ, সেটা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ করে কি হলো, সেই যে তিক্ততা, বিটারনেস। আবার নারীর কথা, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে। যাদের মুক্তিযুদ্ধে কোনো অংশগ্রহণ নেই বলে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত তাদের নিয়ে। অর্থাৎ আমরা সেন্ট্রাল বিষয়ের আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করেছি। সেটা কিন্তু অসচেতন নয়, সচেতন চেষ্টা।
অনেকে মাটির ময়নাকে ইসলাম বিষয়ক, মাদ্রাসা বিষয়ক মনে করে। মুভিটা শেষ হয়েছে নাইন-ইলেভেনের আগে। আমি জানতাম না নাইন-ইলেভেন হবে। নাইন-ইলেভেন না হলে এটা আন্তর্জাতিক কেন দেশীয় প্রাসঙ্গিকতা পেতো কি না সন্দেহ। কিন্তু হঠাৎ করে এটা নাইন-ইলেভেনের পর টপিকাল হয়ে গেল।
কেউ যদি খেয়াল করে তবে দেখবে, এটা নিজের শৈশবের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া। কামিং অফ এজ, সম্পর্ক নিয়ে সিনেমা। গ্রামবাংলার সংস্কৃতির প্রতি একটা টৃবিউট। উগ্রতা বনাম সহনশীলতার সম্পর্ক।
তেমনি অন্তর্যাত্রা, অনেকে বলে এটা প্রবাসীদের নিয়ে মুভি। যেহেতু এখন পর্যন্ত প্রবাসীদের নিয়ে কোনো মুভি হয়নি সেহেতু কেউ বলতে পারে। কিন্তু এটা প্রবাসীদের নিয়ে মুভি নয়। এটা এক ধরনের শেকড় সন্ধান, এক ধরনের আত্মপরিচয় খোজার ব্যাপার এবং সম্পর্ক নিয়ে তৈরি। মাটির ময়নার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু কোথাও হয়তো একটা গাঢ় সম্পর্ক আছে।

আমার মনে হয়েছে, এই প্রথম আপনি পুরোপুরি ফিচার ফিল্মের দিকে গেলেন। মাটির ময়না অটোবায়োগ্রাফিকাল বলে অনেকটা ডকুমেন্টারি। এর আগের মুভিগুলোও ডকুমেন্টারি। আদমসুরত থেকে মাটির ময়না পর্যন্ত আপনার কি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলিং হয়েছিল?

এক ধরনের আনলার্নিং হয়েছিল। ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ আছেন, জেমস লিহি আছেন। জেমস লিহি বৃটিশ। ফাদারের মধ্যে যেমন কানাডার কিছুই নেই, আমাদের থেকে অনেক বেশি তিনি দক্ষিণ এশিয়ান বা ইনডিয়ান তেমনি জেমস লিহির অস্থিমজ্জায় ছিল আফৃকান সিনেমা, ল্যাটিন আমেরিকান সিনেমা। তার একটা মাসব্যাপী কর্মশালা হয়েছিল ঢাকায়। সেটা আমার চোখ একদম খুলে দিয়েছিল। আমার সঙ্গে যারা ছিলেন সবারই কম-বেশি চোখ খুলে দিয়েছে। সিনেমা তাত্ত্বিকভাবে দেখা, রাজনৈতিকভাবে দেখা, শৈল্পিকভাবে দেখা, নৃতাত্ত্বিকভাবে দেখা এ মাল্টিপার্সপেক্টিভ, মাল্টিপ্লিসিটি ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। যেটার এখন চর্চা হচ্ছে সেটা আমরা ১৫-২০ বছর আগে জানার সুযোগ পেয়েছিলাম। এ ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ জাক লাঁকা বোঝালেন। সিনেমার সঙ্গে লাঁকার কি সম্পর্ক। আমি সৌভাগ্যবান নই? কোথায় একটা মাদ্রাসা পড়া গ্রামের ছেলে। এখানে ছোটখাটো মাদ্রাসায় আজান দেয়ার কথা অথবা মৌলবি হওয়ার কথা। যে দুর্ভাগা দেশে সিনেমার কোনো স্কুল নেই সে দেশে আমি সিনেমা বানাচ্ছি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পুনার স্কলারশিপও যোগাড় করেছিলাম কিন্তু এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর প্রথমেই সব ইনডিয়ান স্কলারশিপ বাতিল করে দিলেন। সঙ্গে আমারটাও গেল। সৌভাগ্যক্রমে আমি কলকাতায় গিয়ে ফাদার প্রতিষ্ঠিত সিনেমা শিক্ষা কেন্দ্রে চিত্রবাণীর এক মাসের কোর্স করেছি। ওখানে যারা এখন একাডেমিকভাবে সিনেমার বড় পন্ডিত তাদের সঙ্গে চিত্রবাণীতে কোর্স করার সুযোগ পেয়েছি।
এখন তো আমেরিকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পুরোটাই কর্পরেট। এমন কি বৃটিশ কাউন্সিলও আংশিকভাবে কর্পরেট হয়ে গেছে। শিক্ষা ব্যবসা। কিন্তু তখন তারা নানা চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক পণ্ডিত আনতো। চিত্রকলা, কবিতা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের ব্যাপক কর্মশালা করার সুযোগ হতো। কিন্তু এখনকার তরুণরা এগুলো থেকে বঞ্চিত। আশির দশক পর্যন্ত গ্যেটে ইন্সটিটিউট ক্ষীণভাবে হলেও চলচ্চিত্র শিক্ষা বা চোখ খুলে দেয়ার মতো কর্মশালাগুলোর আয়োজন করতো। এখন তাও করে না। নিবুনিবুভাবে আলিয়স ফ্রসেজ আছে। তাও খুব ক্ষীণ।

আপনার মুভি দেখে কিন্তু মনে হয় এর পেছনে দীর্ঘ একাডেমিক প্রস্তুতি আছে।

না, সে রকম কিছু ছিল না। কিন্তু আগ্রহটা ছিল। চলচ্চিত্রকে একাডেমিকভাবে শেখার, শিল্প-সাহিত্যকে একাডেমিকভাবে বোঝার একটা আগ্রহ ছিল। এখনকার তরুণরা পুরনো মুভি দেখার প্রয়োজনও বোধহয় অনুভব করে না। সময় কোথায়? কিন্তু আমরা তখন জনপ্রিয় মুভিও দেখতাম। আলমগীর কবির যখন আমাদের কোর্স নিতেন তখন ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট দেখতে বলতেন। ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ যখন শোলে নিয়ে বলতেন তখন আমরা ভাবতাম, এ কি, শোলে কেন? পরে দেখলাম, সত্যজিৎ রায়কে যখন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, আপনি শিখেছেন কোথায়? তিনি বলেছেন, জন ফোর্ডের কাছে। পুরো কাউবয় সিনেমা! তিনি বলছেন, আমি ক্রাফটটা শিখেছি ওখান থেকে। ক্রাফটটা তো বড় জিনিস। পরিচালনা তো কেউ শেখাতে পারবে না। তিনি ১৯৪৮ সালে একটা লেখা লিখেছিলেন, মুভি বানানোর প্রায় চার-পাচ বছর আগে। নাম হোয়াট ইজ রং উইথ ইনডিয়ান সিনেমা। ওখানে তিনি মেলোড্রামাটিক অভিনয়, জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন সিনেমার কথা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেই প্রত্যয় থেকেই তিনি পথের পাঁচালী তৈরি করলেন। পথের পাঁচালী থেকে বাংলাদেশ তো দূরের কথা পশ্চিমবঙ্গের সত্যজিত পরবর্তী নির্মাতারাও সেই রিয়েলিটি থেকে শিখতে পারেননি। অপেশাদার শিল্পীর কাছ থেকে কি অসাধারণ ন্যাচারাল অভিনয় আদায় করেছেন।
বিশাল প্রদীপের কাছ থেকে নিজেকে আলোকিত করার যে সুযোগ পেয়েছি সেটা কিন্তু এক ধরনের সৌভাগ্য। সচেতনভাবে যদি চাইতাম ‘আমি শিখবো’, তাহলে হতো না। সুলতান ভাইয়ের সঙ্গে সময় অপচয় করে শিখেছি। ওয়ার্কশপগুলো করেছি। এগুলো সবই কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এগুলো কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নয় যে, কালকে টেলিভিশনে নাটক বানাবো বা সিনেমার ডিরেক্টর হবো। মুভি নির্মাণের প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে হঠাত আবিষ্কার করেছি যে, আমার নেশাটা পেশা হয়ে গেছে। কখনোই ভাবিনি নির্মাতা হবো। বিনয় করে বলছি বলে নয়। এটা এ কারণে যে, চাকরি আমার দ্বারা হবে না, এটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছি, ব্যবসা হবে না বুঝে গিয়েছি। আমার দক্ষতা বা ক্ষমতা কোথায় আমি কখনোই বুঝতে পারিনি। কালকেও যদি আয়-রোজগার ও শান্তি পাওয়ার মতো কাজ পেয়ে যাই তবে সিনেমাকে আজই ত্যাগ করতে রাজি আছি। এটা খুবই একটা এক্সট্রোভার্ট মাধ্যম। এর প্রধান প্রক্রিয়াটা নাথিং কৃয়েটিভ, খুবই প্রোজেইক। মুভির চিত্রনাট্যের সময় আমি একটু আনন্দ পাই আর মুভির শেষ পর্যায়ে সম্পাদনার শেষে গিয়ে একটা কৃয়েটিভ আনন্দ পাই। কিন্তু মাঝখানেরটা একটা আর্মি রান করানোর মতো কাজ। অনেকে এনজয় করে সেটা। আমি এনজয় করি না। ক্রাউড হ্যান্ডল করা, ম্যানেজমেন্ট, অর্থ ম্যানেজমেন্ট সবকিছু মিলিয়ে। আর শুটিংয়ের সময় আমি যে আমিকে পাই সে আমি না। আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তারা জানে আমি খুব আনপ্লেজেন্ট মানুষ। আমি ডিমান্ডিং। আমি জানি, আমি যদি এখন ভালো মানুষের মতো, ‘না না ঠিক আছে, কিছু হবে না, অসুবিধা নাই, এখন করো নাই পর
১২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×