somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোথাও রয়েছে মৃত্যু, কোনো এক দূর পারাবারে / পশ্চিম সাগরে এক যেইখানে সবশেষ তারা, অবসন্ন হয়ে যায়/ ডুবে যায় ভোরের আঁধারে

১৪ ই জানুয়ারি, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ল্যাবএইড থেকে ফিরলাম। সেলিম আল দীনের আজই ব্যাংকক যাওয়ার কথা ছিল। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছানোর কথা ছিল বিকাল চারটায়। কিন্তু তার দুই ঘণ্টা আগেই তিনি চলে গেলেন। একটু আগে ল্যাবএইডের অ্যাম্বুলেন্স তাকে বারডেমের মরচুয়ারিতে নিয়ে গেল। সবাই মিলে ঠিক করলেন, বুধবার তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাহিত করা হবে। তার আগে শহীদ মিনারে নেয়া হবে সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। ল্যাবএইডে সবাই এসেছিলেন। নাটকের মানুষেরা, জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিক। সবাই কাঁদছিলেন। আমার কেন জানি কান্না আসে না। বুকটা ভারি হয়ে এলো। কোনো কথাই বলতে পারলাম না কারো সাথে। দুএকজনের হাত চেপে শক্ত করে ধরে থাকলাম শুধু। অ্যাম্বুলেন্স চলে যাবার পর চলে এলাম। গল্প শেষ হলো। সত্যিই কি গল্প শেষ হলো?
ফিরতে ফিরতে হু হু করে স্মৃতির পর স্মৃতি একের পর এক ঘুরে ফিরে আসছিল। কত কথা, কত আকুলতা। ১৯৯৪ সালের এক দুপুরে কুষ্টিয়ার গণউন্নয়ন গ্রন্থাগারে আমি ও আমার কলেজের সহপাঠি সাইমন জাকারিয়া আবিষ্কার করেছিলাম অপূর্ব এক নাটকের বই চাকা। সৈয়দ শামসুল হকের হাতে লেখা একটা মুখবন্ধ বইটির শেষ প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল। জানি না তখন সৈয়দ শামসুল হকের প্রতি মুগ্ধতাবশত নাকি নতুন ফর্মে লেখা এই নাটকের ভেতর কী আছে তা জানার জন্য চাকা পড়েছিলাম। সম্পূর্ণ নতুন এক লেখককে আবিষ্কারের আনন্দ হয়েছিল সেদিন। সাইমন জাকারিয়া সেই নাট্যকারের প্রভাবে পুরোদস্তুর নাট্যকার হয়ে গেল।
সেলিম আল দীনের হাত হদাই, কেরামতমঙ্গল, হরগজ পর্যন্ত পড়া ছিল ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালে জাহাঙ্গীনগরে এলাম। একদিন তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগও এলো। সে আরেক দুপুরের গল্প। তার সঙ্গে দেখা করতে যাবো বলে হরগজ নাটকটা আবার পড়ে নিলাম। সাইক্লোনে লন্ডভণ্ড মানিকগঞ্জের এক জনপদে মানবিক সংকট নিয়ে লেখা নাটক। স্যার নাটক না বলে আখ্যান বলতেই পছন্দ করতেন। টিএসির পরিচালক তিনি তখন। দেখা করলাম। হরগজ নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। আমার কথা তিনি শুনলেন। নিজের কথা বললেন। আমার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। ক্লাশ শুরুর আগেই তখন জাহাঙ্গীরনগরে থাকি আমি। দুএকদিন পর ডেইরি ফার্মের দিকে যাচ্ছি। পরিসংখ্যান বিল্ডিংয়ের কাছের ঢালের ওখানে যেতেই একটা শাদা গাড়ি এসে থামলো পাশে। ভেতরে সেলিম আল দীন। বললেন, উঠে পড়ো। আশ্চর্য এক সম্মোহনে উঠে পড়লাম। কোথায় যাও?
ডেইরি ফার্ম।
আমার সঙ্গে ঢাকা চলো।
স্যার আমি তো ঢাকা যাবো না। প্রস্তুতি নেই।
চলো। আমার কথায় না বলো না।
চললাম তার সাথে। মাসুম রেজাদের সাবলাইমে গেলাম প্রথম দিন। ওখানে বসে স্যার নাটক লিখতেন। সেই শুরু। সেই শীতের পর কয়েকটা বছর... কত শীত গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত বসন্ত গেল। অনেক কথা, অনেক পথ। একটা সময় প্রতিদিন দেখা হতো। তিন চার পাঁচ বছর কেটে গেল। সেলিম আল দীন আমার কাছে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা লেখক। শিক্ষক।
স্যার একদিন দুপুর বেলা আমার হলে এসে হাজির। হলে পুরো তোলপাড়। সেলিম আল দীন কেন এখানে? স্যার উপস্থিত সবাইকে বললেন আমাকে নিতে এসেছেন। বাইরে গাড়ি নিয়ে বসে আছে কুদ্দুস ভাই। আমি বললাম, স্যার কাউকে দিয়ে খবর দিলেই তো হতো। স্যার বললেন, দেরি হবে তো তাই নিজেই এলাম। ভাল লাগছে না। বৃষ্টি হবে। চল মানিকগঞ্জ যাই। ওখানে একটা ভাল মিষ্টির দোকান আছে। মিষ্টি খেয়ে আসি। গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে উঠেও আমার অস্বস্থি যাচ্ছিল না। স্যার বললেন, কি ব্যাপার? আমরা তো বন্ধু। বন্ধুই তো না কি?
আকাশে মেঘ ছিল। মানিকগঞ্জের রাস্তায় অসংখ্যা সোনালু বা সোনাঝুরি গাছে ফুল ফুটেছিল। সোনালু স্যারের খুব প্রিয় ফুল ছিল। দেখতে দেখতে চললাম। নয়ারহাটেই বৃষ্টি আমাদের সঙ্গী হয়েছে। গাড়ির প্লেয়ারে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান বাজছে। সব সময় রবীন্দ্রনাথের গানই বাজতো। রবীন্দ্রনাথকে স্যার ভীষণ পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কিছু বললে একদম সহ্য করতে পারতেন না। নিজের যুক্তির ব্যাপারে তিনি ছিলেন একরোখা। তার মত পাল্টানো যেত শুধু রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিতে পারলে।
একবার বন্ধের সময় আমি উদ্যোগ নিলাম জীবনানন্দ সম্পর্কে স্যারের মত পরিবর্তনের জন্য। একটা রাত কবিতা পড়তে পড়তে আর তর্কে তর্কে কেটে গেল। জীবনানন্দের মর্মে মর্মে যতটুকু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একে একে বের করতে থাকলাম আমি। সব শেষে ট্রামকার্ড হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা জীবনানন্দের ছয় ছয়টি কবিতা তার সামনে মেলে ধরলাম। স্যার মানতে বাধ্য হলেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি অনেক বড় করে বলতেন। বলতেন, রবীন্দ্র ভুবন।
স্যারের খুব ইচ্ছা ছিল রবীন্দ্রনাথের সমান আয়ু পাবেন। আশি বছর। খুব সামান্য এক চাওয়া। সে চাওয়াটা পূর্ণ হলো না। তিনি বাংলাদেশে শান্তিনিকেতনের মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে চেয়েছিলেন। তাও হলো না। স্যার কিছু রাবীন্দ্রিক রিচ্যুয়ালের অনুরক্ত ছিলেন। তার অনেক কিছুই হলো না। ১৯৪৯ (১৯৪৮) সালের ১৮ আগস্ট থেকে ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি। ষাটেই চলে গেলেন।
নিমজ্জন লেখার পুরো সময়টা তার পাশে থেকে দেখেছি কিভাবে অমানবিক এক পরিশ্রমে তিনি লিখছেন। একরোখা লেখক ছিলেন। মৃত্যুভীতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল নিমজ্জন লেখার শুরু থেকে। তাই নিমজ্জন হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর পুরান। জগতের প্রায় সমস্ত মৃত্যুর কথা সেখানে আছে। শুধু নাই সেলিম আল দীনের মৃত্যুর কথা। নাকি আছে? আবার ওল্টাতে হবে তার রচনাবলীর পাতা।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৩:৫৪
২০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×