গ্রন্থ সমালোচনাঃ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’-মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
১.০ সূচনা
জর্জ আরওয়েল একাবার বলেছিলেন, ইতিহাস হালনাগাদ রাখা হল একটি সার্বক্ষনিক কর্ম। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, অধুনা বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চায় নিয়জিত ও উদবোধন আসন অলঙ্করনে ব্যাস্ত মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখা ইতিহাস বিষয়ক বই ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ । বইটির প্রকাশ উপলক্ষে প্রসঙ্গ কথা লিখেছেন বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক মঞ্জুরেমাওলা এবং পুনর্মুদ্রন প্রসঙ্গে লিখেছেন মোহাম্মদ হারুন উর রশিদ ।
১.১ পুস্তক পরিচয়
• ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ ভাষা শহীদ গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্তএকটি বই
• প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ১৯৮৫
• দ্বিতীয় প্রকাশঃ অক্টবর ১৯৮৯
• পুনর্মুদ্রনঃ জানুয়ারি ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমীর ‘পুনর্মুদ্রণ প্রকল্প’এর অধীনে
• প্রকাশকঃ গবেষনা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগ
• প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জাঃ কাইউম চৌধুরী।
• মুল্যঃ ৪০ টাকা
• পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৫১
১.২ মূল বক্তব্যঃ
১২ টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি মূলতঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দলিল। অধ্যায় পরম্পরা এরকমঃ
১. নাম পরিচয়
২. ইতিহাসের ছিন্নপত্র
৩. পাল সম্রাজ্যের উত্থান ও পতন
৪. সেনরাজ্য
৫. তুরষ্ক শক্তির আবির্ভাব ও সম্প্রসারণ
৬. স্বাধীন সুলতানী আমল
৭. পাঠান মুঘল দ্বন্ধ
৮. মুঘল বাদশাহী
৯. নবাবী আমল
১০. ইংরেজ রাজত্ব
১১. পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
১২. সমাজ ও সংস্কৃতি
অধ্যায় পরম্পরাই বইটির মুল বক্তব্যের নির্দেশক, প্রগৈতিহাসিক যুগ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত তার ব্যাপ্তি। শেষ দিকে বাংলার সমাজ সংস্কৃতির একটি পরিচয় লেখক যুক্ত করেছেন।
১.৩ প্রেক্ষাপট
বইটির প্রেক্ষাপট সুবিশাল এক সময়, গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশের দুই হাজার দুইশত বছরের ইতিহাস ধরা হয়েছে মাত্র দেড়শত পৃষ্ঠার মধ্যে। লেখক এ-কারণে কেবল প্রধান ঘটনাগুলির সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করেছেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান প্রণয়ন পর্যন্ত নানা চড়াই উৎরাই এই বইয়ের প্রেক্ষাপট।
মূল সুরের পাশাপাশি অন্যান্য অনুকল্প উল্লেখিত বাধার কারনে পেখম মেলতে পারেনি। কিন্তু লেখকের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আভাস সুযোগ পেলেই দেখা দিয়েছে নানা বাক্যে। প্রেক্ষাপটও সুবিন্যস্ত সে জ্ঞান আর প্রজ্ঞার কারনেই।
১.৪ গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতাঃ
অতীতকে বিশ্লেষনের মাধ্যমেই আসলে ভবিষ্যতকে গঠন করা যায়। আমারা যদি আমাদের অতীতের ভুল ভ্রান্তি বুঝতে না পারি তবে সেগুলো শোধরাতেও পারবো না। আমাদের নিজেদের স্বার্থে, আমাদের উজ্জলতর ভবিষ্যতের স্বার্থেই আমাদের ইতিহাস সচেতন হতে হবে। হাবিবুর রহমান লিখিত এ বইটির গুরুত্ব এখানেই, তিনি সাধারণ বাঙালী পাঠক কে তার মূলের কথা, তার অতীতের কথা, তার ভুল, তার গর্ব,তার বিজয় তার পরাজয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের -বাঙালীর ইতিহাস খুব একটা লেখা হয় নি। লেখা হলেও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ইতিহাস কতখানি বাস্তবনিষ্ঠ আর কত কতখানি ঐতিহাসিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা খামখেয়ালিপনা বা শ্রেণীগত স্বার্থবুদ্ধি নির্ভর তা নিয়ে বিতর্ক রয়েই যায়। আর ইদানিং কালে আমাদের দেশের আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিকৃতির কথা তো সবার জানা। নানা ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস বিকৃতি, ভ্রান্তি, ইতিহাসের স্বার্থবাদী পরিবর্তন এখন প্রচলিত বিষয়। এসব ঘটনা আমাদের জাতির ঐতিহ্য, কৃষ্টির মূলে কুঠারাঘাত হানছে। এসব দিক বিবেচনায় আমাদের আলোচ্য বইটি সব ত্রুটি এড়াতে না পারলেও বেশ খানিকটা সাফল্যের মুখ দেখেছে বলে আমাদের মনে হয়। হাবিবুর রহমান যথেষ্ট সততার সাথে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন। এই উদ্যোগ পরবর্তি ইতিহাস লেখকগণের পাথেয় হয়ে থাকবে।
২.০ আনুষঙ্গিক বিষয়াবলিঃ
বইটির আনুষঙ্গিক বিষয়াবলির কাল পরপম্পরার মধ্যে নিহিত, লেখক সময়ের সাথে সাথে ইতিহাস কে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শুরুতে তিনি একটি নাম পরিচয় দিয়েছেন। তারপর প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে পাল যুগ,সেন যুগ, তুর্কি আবির্ভাব, স্বাধীন সুলতানি আমল,মুঘল ,পাঠান যুগ, ইংরেজদের আবির্ভাব হয়ে পাকিস্তান গঠন থেকে বাংলাদেশের আবির্ভাব পর্যন্ত এসেছেন। সবশেষে একটি সমাজ ও সংস্কৃতির সমীক্ষা করে বইটি শেষ করেছেন।
লক্ষ্য করা যাক তার গাঠনিক বিন্যাসঃ
২.১ নাম ও পরিচয়ঃ
১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধান লিখিত হবার পর থেকে আমাদের বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র। এ দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।এ দেশের বেশিরভাগ মানুষই বাঙ্গালী, এই বাঙ্গালীদের ও তাদের দেশের ইতিহাস খোঁজার উদ্দেশ্যেই এই বই লিখিত। এই স্বাধীন দেশের উৎস খুঁজতে আমাদের যেতে হবে খ্রীষ্টপূর্ব ২য় শতকে তখন আমরা এ দেশে সুহ্ম জনপদের সন্ধান পাই। এই জনপদ ছিল পশ্চিম বাংলার দক্ষিনাংশে, অজয় নদীর দক্ষিনে। পরবর্তিতে এ অঞ্চল দক্ষিন রাঢ় নামে পরিচিত হয়। এর উত্তরে ছিল উত্তর রাঢ়। বাংলার প্রাচীনতম জনপদ ছিল পূন্ড্র, বর্তমানে মহাস্থান নামে পরিচিত। খ্রিষ্টিয় চতুর্থ শতকে আমরা সমতটের উল্লেখ পাই। কুমিল্লা ত্রিপুরা ও নোয়াখালির কিছু অংশ নিয়ে এই সমতট। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে পাই গৌড়ের কথা যা গঠিত ছিল মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলা নিয়ে। সমসাময়িক কালে সমতটের দক্ষিনে ছিল হরিকেল। এসব জনপদ নিয়ে গঙ্গার দুই ধারা, ভাগীরথী ও পদ্মার উপত্যকাকেই বলে বঙ্গ। বঙ্গ নাম নিয়ে নানা মূনির নানা মত আছে। কেউ বলেন সুদেষ্ণার পঞ্চপুত্রের একজন বঙ্গ, কেউ বলেন এ অঞ্চলে পয়গম্বর নূহের এক পৌত্র যার নাম বংগ বশতি স্থাপন করেছিলেন বলে এ জায়গার নাম বঙ্গ। বঙ্গের এক অর্থ কার্পাশ তুলা। এমনি নানা কথা প্রচলিত। উৎস যাই হোক না কেন এই বঙ্গ থেকে জাতি, দেশ ও ভাষার নাম রাখা হয়েছে ।
২.২ প্রাগৈতিহাসিক যুগঃ
আলেকজান্ডার ৩২৬ সালে ভারত জয় করতে এসে গঙ্গারিডি নামে এক রাজ্যের কথা শুনতে পান। ভারতবিদেরা গ্রীক গঙ্গারিডিকে ভাষান্তর করেন কেউ গঙ্গাহৃদি, কেউ গঙ্গা হৃদয়,কেউ গঙ্গা রাঢ় কেউবা গঙ্গাঋদ্ধি নামে। লেখক গঙ্গাঋদ্ধি গ্রহন করেছেন। গঙ্গাঋদ্ধি আমাদের দেশের ইতি হাসে না পাওয়া গেলেও গ্রীক ও মিসরিয় ইতিহাসে প্রভাবশালী রাজ্য হিসাবে এর নাম উল্লেখ করা আছে। মহাভারত ও রামায়নে বঙ্গের রাজার কথা উল্লেখ আছে।
খ্রিষ্টিয় তৃতীয় শতকে এ অঞ্চলে প্রথম রাজ্য গঠিত হয় এমন প্রমান পাওয়া গেছে। এসময় গুপ্ত রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়।চতুর্থ শতকে এখানে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ছিল। পঞ্চম শতকে অন্তর্কলহ ও হূন আক্রমনে গুপ্ত রাজ্য লয় প্রাপ্ত হয়। ষষ্ঠ শতকে এ দেশে রাজত্ব করেন শশাঙ্ক। । সপ্তম শতকে এ দেশে ভদ্র রাজবংশের উদ্ভব হয়।এ শতকের শেষদিকে এ দেশের দক্ষিন পূর্বাঞ্চলে খড়গ রাজবংশ রাজত্ব কর্ব। সমতটে রাজত্ব করেন দেব বংশিয়রা।তবে এরা ছিলেন আঞ্চলিক সামন্ত রাজা। আর্যাবর্ত বা মূল ভারতে এদের কোন প্রভাব ছিলনা।
২.৩ পাল সাম্রাজ্য
অষ্টম শতকে বহিরাক্রমন ও অন্তর্কলহ সব রাজ্যের পতন হয়। এ সময়কে বলে মাৎসন্যায়। জোর যার মূলুক তার এই ছিল এ সময়কার নিয়ম। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে গোপাল (৭৫৬-৭৮১) বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত রাজা হন। তিনিই পাল বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তার বংশধরেরা দশম শতক পর্যন্ত রাজত্ব করে লয়প্রাপ্ত হন। দশম শতকের প্রথম দিকে দক্ষিন পূর্ব বাংলায় চন্দ্র রাজারা ছিলেন।এ সময় মধ্য ভারতের চালুক্য রাজারা বার বার বাংলা আক্রমণ করেন।
২.৪ সেন সাম্রাজ্যঃ
বিজয়সেন আপন শক্তি ও প্রজ্ঞার বলে চালুক্যদের বিতাড়িত করেন। তিনি বাংলায় ঐক্য ফিরিয়ে আনেন। তার পুত্র ও পৌত্ররা চারদিকে তাদের রাজ্য বিস্তার করেন। সেন রাজত্বের অবসান ঘটে লক্ষন সেনের সময় তুর্কি আগ্রাসনের ফলে।
২.৫ তুর্কি আগ্রাসন
তুর্কি ভাগ্যান্বেষী ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি ১০ মে ১২০৫ সালে লক্ষন সেন কে পরাজিত করে বাংলার রাজত্ব দখল করেন। সামরিক ও রাজনৈতিক ভুলের জন্য আলীমর্দন তাকে হত্যা করেন। আলী মর্দন সুলতান আলাউদ্দিন নাম নেন। তিনি অত্যাচারী ছিলেন বলে তুর্কিরা তাকে হত্যা করে ইওজ তথা সুলতান গিয়াসুদ্দিন কে ক্ষমতায় আনেন । তিনি দিল্লির বিরুদ্ধে সংগ্রামে মারা যান। চতুর্দশ শতকের শেষ পর্যন্ত এ দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দিল্লির শাসনাধীন ছিল।
২.৬ স্বাধীন সুলতানী আমল
চতুর্দশ শতকের শেষদিকে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পরে। তখন বাংলার প্রভাবশালীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তুঘলক বংশের প্রতিনিধি বহরমের মৃত্যুর পর তার বর্ম-রক্ষক ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ নাম নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর কিছুদিন অভিজাত লোক বা সেনাপতিরা পরষ্পর পরষ্পরকে হত্যা করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকেন। যেমন আলী মোবারক মোখলেস কে হত্যা করে আলাউদ্দিন আলী শাহ নাম নেন। তাকে হত্যা করে ইলিয়াস সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নাম নেন। ইলিয়াস শাহ বংসপরম্পরায় স্বাধীন ভাবে দেশ শাসন করলেও হত্যা অপঘাত মৃত্যু এ বংশ কে ছাড়েনি।তার পুত্র পৌত্ররা একে অপরকে হত্যা করেছে,অথবা নিহত হয়েছেন। এই স্বাধীন সুলতানি টিকে ছিল ১৫৩৯ পর্যন্ত। এ আমলের একটি উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা হল ইবনে বতুতার আগমন। তিনি এসময়কার বাংলা সম্পর্কে মনজ্ঞ বর্ননা দিয়ে যান। নবাবি আমলে এ দেশ সমৃদ্ধ ছিল আমরা তার বিবরণ থেকে এ কথা জানতে পারি।
২.৭ পাঠান মোগল দ্বন্ধঃ
শের খান, শের শাহ নাম নিয়ে গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। তিনি পাঠান ছিলেন। দিল্লির মসনদে আসীন মোঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে উত্তর ভারতে একক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবির্তিতে শের শাহ মরা গেলে আকবর আবার দিল্লির সিংহাসন ফিরে পান ।
২.৮ মোগল বাদশাহীঃ
আকবর বঙ্গ গৌড় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী ছিলেন কিন্তু আফগান পাঠান ও কিছু হিন্দু জমিদারের প্রতিরোধের কারনে একাজ তার জন্যে সহজ হয় নি। বার ভুঁইয়া নামে পরিচিত এ জমিদারেরা এ অঞ্চলে স্বাধিনতা ঘোষণা করলে আকবর তার সেনাপতি মানসিংহের সহায়তায় এ অঞ্চল দখলে আনেন। তিনি এ অঞ্চলে প্রশাসক বা সুবাদার নিযুক্ত করেন। প্রথম সুবাদার ইসলাম খাঁ। এ অঞ্চলের জমিদারেরা সুযোগ পেলেই মূঘল শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তবে সুবাদার শসনে বাংলা অঞ্চলের প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নতি হয়।
২.৯ নবাবী আমলঃ
বাংলার নবাবি আমল বেশ ঘটনা বহুল। দিল্লির কেন্দ্রিয় ক্ষমতা আঠারো শতকের শুরুর দিকে দূর্বল হয়ে পড়লে আঞ্চলিক নবাবগণ বেশ স্বায়ত্ব শাসন পেয়ে যান। কিন্তু নানা ঔপনিবেশিক শক্তি, আভ্যন্তরিন কলহ, দস্যুতা তাদের বিপর্যস্ত রাখে। বাংলার নবাব আলিবর্দি খান কে দীর্ঘদিন মারাঠা তথা বর্গী দের বিরিদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়।তার দৌহিত্র তরুণ ও অপরিণামদর্শি ছিলেন। তার সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের উপনিবেশ স্থাপনের বীজ বপন করে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব পরাজিত ও নিহত হলে ক্ষমতা ধীরে ধীরে ইংরেজদের হাতে ছলে যেতে থাকে।
২.১০ ইংরেজ রাজত্বঃ
১৭৫৭ সাল থেকে ইংরেজেরা পরোক্ষভাবে বাংলার শাসন চালাতে থাকে। কোম্পানি মূঘল বাদশাহের কাছ থ্রকে নিজামত লাভ করে। কিন্তু কোম্পানির কর্তাদের জবাবদিহীতা ছিল ইংরেজ সরকারের কাছে। ১৭৭৩ সালে ইংলিশ পারলামেন্ট ভারতে অধিকৃত এলাকা শাসন করার জন্য একজন গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করার আইন পাশ করে। লর্ড হেস্টিংস প্রথম গভর্নর জেনারেল।। লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়ন করে এদেশের ভুসম্পত্তির উপর ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। লর্ড ওয়েলেসলির অধীনতা মূলক মিত্রতা ,ডালহৌসীর স্বত্ত্ব বিলোপ নীতি ও ১০ ১২ টি যুদ্ধের পর প্রায় পুরোটা উপমহাদেশ ইংরেজ শাসনের আওতায় আসে। ১৮৫৭ সালে গুজব কে কেন্দ্র করে ইংরেজ সেনাবাহিনীর দেশি সেপাইরা বিদ্রোহ করে।এটি সিপাহি বিদ্রোহ বলে পরিচিত। এ বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। কিন্তু এর ফলাফল হিসেবে কোম্পানি শাসন বিলুপ্ত হয়ে ভারত সরাসরি ইংরেজ সরকারের শাসনাধীনে আসে। ১৯০৬ সালে লর্ড কার্জনের সময় বঙ্গভঙ্গ হয় ফলে পূর্ববাংলা আলাদা গুরুত্ব পায়। কিন্তু মধ্যবিত্ত হিন্দুদের আন্দোলনের ফলে ১৯১১ সালে তা রহিত হয়। ইতোমধ্যে নানা রাজনৈতিক দল গঠিত হয় ও ইংরেজ শাসন বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধে। এর অবধারিত ফলাফল হিসেবে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্ট হয়।
২.১১ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশঃ
পাকিস্তান রাষ্ট্র ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ,ঐতিহ্যগতভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখন্ড ও জনসমষ্টিনিয়ে গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম্ পাকিস্তানীরা পূর্ব বাংলার সংস্কৃতিকে সম্মান করত না।বরং ঔপনিবেশি মানসিকতা নিয়ে শোষন করার চেষ্টা করত। তারা প্রথমেই বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানে। ফলে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন হয় ও অনেকে শহীদ হন।সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীর পূর্ববাংলার রাজনৈতিক অধিকারেকেও খর্ব করা হয়। শেরেবাংলার নেতৃত্বে১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার কেও দুর্বল করা হয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করেন আইয়ুব খান।১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্থান যুদ্ধে পূর্ব বাংলা প্রায় অরক্ষিত থাকে।এর মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উত্থান হয়।১৯৬৬ সালে জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিব ৬ দফা পেশ করেন যা আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দাবী করে। নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতে থাকে। শেখ মুজিব কে মিথ্যা মামলার বলী করা হলে গণ আন্দোলন ছড়িয়ে পরে ও সামরিক সরকারের পতন হয়।১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা নির্বাচিত সরকার কে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিতে রাজি হয় না। আলোচনার নামে কালক্ষেপন করে গণহত্যার প্রস্তুতি নেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানীরা অতর্কিতে নিরীহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। নয় নাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং ১৯৭২ সালে সংবিধাণ প্রণিত হয়।
২.১২ সমাজ ও সংস্কৃতিঃ
আমদের বাংলা অঞ্চলের সমাজ কৃষিভিত্তিক। সমাজে বর্ণ বৈষম্য প্রধান বৈশিষ্ট। এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও আশ্রাফ-আতরাফ ভাগ ছিল। অতীতে হিন্দুরা এ অঞ্চলের প্রধান জনগোষ্ঠী ছিল। পরে বৌদ্ধ ও জৈন রা এলেও তারাই প্রধান জনসমষ্টি। মুসলিম বিজয়ের পর এর সাম্যের বাণীতে আগ্রহী হয়ে অনেক নিম্নবর্গের হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করে।ইংরেজ আমলে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহনেরও ক্ষণস্থায়ী লক্ষন দেখা যায়। সামাজিক শ্রম বন্টনও শ্রেণীভিত্তিক ছিল সর্বদা। নারীরা এদেশে অধিকাংশ সময়েই শোষিত। প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন হিসেবে আছে নানা হিন্দু-বৌদ্ধ স্থাপনা। মুসলিম বিজয়ের পর বিশেষ করে মুঘল আমলে এদেশে স্থাপত্যের নতুন মাত্রা যোগ হয়। বাংলা ভাষা ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভুত, প্রকৃত ভাষার একটি শাখা। প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন ‘চর্যাগীতি’। এছাড়া আছে ‘মঙ্গল কাব্য’। উনবিংশ শতকে আমাদের সাহিত্য ও মনের জগতে রেনেসাঁর কাল । ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পান। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া বাউল,আমাদের সংগীত। এ অঞ্চলের জাতিগত সামষ্টিক চেতনা বেশ দূর্বল।
২.১৩ সমালোচনাঃ
লেখকের বক্তব্য অনুসারেই ২২ শত বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে কেবল ছুঁয়েই গেছেন তিনি প্রথম ১১ টি অধ্যায়ে। আগ্রহ উদ্দীপক বইটির বৃহত্তম শেষ অধ্যায়। লেখক সেখানে ২য় মুদ্রনের সুযোগ নিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতির একটি খসড়াচিত্র তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত খন্ডিত ইতিহাস । সমাজচিত্র ছাড়া ইতিহাস লিখন মূল ইতিহাসের আভাস মাত্র। প্রাজ্ঞ লেখক এ বিষয়টি বুঝতে পেরে সুযোগ পাওয়া মাত্র তা ব্যবহার করেছেন।
এত বিশাল সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস এত ছোট পরিসরে লিখতে গেলে কেবল নাম উল্লেখ, সময় কাল ও ঘটনাপ্রবাহের সংক্ষিপ্তসার বলা ছাড়া কোন উপায় থাকে না । এ পরিসরে কোন অনুকল্প গঠন ও অনুসরণ সম্ভব নয়। আলোচ্য বইটির লেখক ও তা পারেব নি। তবে লক্ষ্য করা যায়, প্রথমতঃ ইতিহাস গঠনে তিনি সর্বদাই জাতীয়তাবাদী কাঠামো ব্যবহার করেছেন , একটি জাতি তথা বাঙালীর ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস বলাই তার উদ্দেশ্য। সে লক্ষ্যেই তিনি মূল ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে বাংলার ইতিহাস বিচ্ছিন্ন করে দেখার চেষ্টা করেছেন।
দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যায় প্রায়ই নিজের মতামত ও ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছেন, তা ফলে প্রচলিত ইতিহাসের পাশাপাশি একটি নতুন মত সৃষ্ট হয়েছে। যেমন গঙ্গরিডই, গঙ্গাহৃদয় ইত্যাদি আমরা আগ্র জানলেও গঙ্গাঋদ্ধি নামটি তারই দেয়া।
তৃতীয়তঃ সমাজ ও সংস্কৃতির ব্যাখ্যায় তিনি প্রগতিশীল সংস্কারমুক্ত মন ব্যবহার করেছেন।
ক্ষুদ্র পরিসরে বিশাল ইতিহাস রচনার যাবতিয় অসুবিধা সত্ত্বেও লেখকের বৈশিষ্ট সমুহ বেশ উজ্জ্বল।
৩.০ উপসংহার
বাঙ্গালীর দৈন্য নিয়ে আজ আমরা আমাদের ভাগ্যকে দোষ দেই, কিন্তু আমরা চিরকাল এমন দৈন্য দশায় ছিলাম না। যুগে যুগে ইতিহাস আমাদের সমৃদ্ধির পরিচয় দেয়। সে মহান ইতিহাসের খসড়াচিত্র নির্মানের চেষ্টা করেছেন লেখক এ বইটিতে । আমাদের বাঙ্গালীদের জানতে হবে কোথায় আমাদের মূল। সে মূল খোঁজার জন্য এ বইটি অপরিহার্য।