বাঙালীর ভাষাপ্রেমের কারণ ঐতিহাসিক, এ-জাতি প্রত্যক্ষ ভাবে ভাষার জন্য, ভাষার অধিকার আদায়ের জন্যে জীবন দিয়েছে, তাই যৌক্তিক কারণেই বাংলার প্রতি তাদের ভাষার প্রতি তাসের মানসিক সম্পর্কটি বেশি। তারা তাদের ঐ সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে জাতিগতভাবে গর্বিত।
আমি এসব বাংলাপ্রেমিকদের একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখবার চেষ্টা করব।
আমরা যারা খোঁজ খবর রাখি তারা জানি বাংলায় জ্ঞান চর্চা একেবারে প্রথমিক স্তরে, কোন বইপত্র বাংলায় পাওয়া যায় না। এমনকি বাংলায় ভাল বইপত্র লেখার জন্য যে রকম প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগ দরকার তাও অপ্রাপনীয়। অথচ, সবাই চিৎকার করছে ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে হবে’- বাংলার প্রতি দরদ উথলে পড়ছে কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন চলছে, এর বিপক্ষে কথা বললে সবাই আজ তেড়ে ফুঁড়ে মারতে আসবে। বিপক্ষে বলা দূরে থাক, কেউ ইংরেজীর সপক্ষে কিছু বললে, ইংরেজীতে কিছু লিখলেও তাড়া খেতে হচ্ছে, কিন্তু বাংলা ভাষাকে জ্ঞানভিত্তিক কাজের জন্য প্রস্তুত করার জন্য উদ্যোগ নেই প্রায় কারোই। মধ্যবিত্ত সমাজসম্ভুত ছাত্রগণ বাংলায় পড়তে চাইলে ইংরেজীমনষ্ক পন্ডিতগণ যদি উষ্মা প্রকাশ করেন তবে ঐ পণ্ডিতদের পিঠ বাঁচবে না এতি তার বেশ উপলব্ধি করেন ,অতঃপর মৌনতা হীরণ্ময়। তবে সত্য কথা হল এই যে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদানের জন্য অবকাঠামোগত অবস্থা বাংলার নেই। বাংলায় পড়াশোনা করে ইংরেজী পরিত্যাগ করে যদি অকাট মূর্খই থেকে যেতে হয় তবে কষ্ট করে পড়ালেখা করার ক্লেশ নেয়া কেন? এর চেয়ে পড়ালেখা না করাই ভাল।
বাংলায় পড়ার মত বই পুস্তক নেই, কিন্তু দূঃখিনী বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা - দেশপ্রেমিক বাংলা ভাষা হেতৈষীসকল বাংলা চালুর নামে লাঠালাঠি করে মাতৃভাষা জননীর সেবা করছেন ভেবে তৃপ্ত থাকেন। দুই লাইন ইংরেজি বাক্য দেখলে ক্রুব্ধ হন, কিন্তু লাঠি ছেড়ে বইপত্র লেখা, অনুবাদ করা , ভাষাচর্চার করার কথা আসলের তার লম্বমান হন বা পিঠটান দেন।এ সকল মধ্যবিত্তকূলোদ্ভব ভাষাদরিদীরা কিন্তু জীবনের প্রয়জনীয় সব ক্ষেত্রেই বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে থাকেন । কেউ অসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত- চাকুরি ব্যবসা ধান্দার ক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহার করছেন, শনৈঃশনৈঃ উন্নতিও করছেন ইংরেজীর হাত ধরে।কিন্তু স্থান কাল পাত্র বিশেষে তাদের কি যান হয়ে যায়! বিকেলে বাড়ি ফিরে সার্টটি ছেড়ে পাঞ্জাবীটি চড়ালেই নিযেকে বাংলার সেবক মনে হয়। কলাভবনের পাশ দিয়ে হাঁটলেই মনে হয় বাংলার মাযারের মুরিদ, ইংরেজিতে কারো কোন মননশীল কর্ম তারা সহ্য করতে পারেন না। হাঁ-হাঁ করে হেঁকে উঠান, বলেন, ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করিতেই হইবেক, অত্র স্থানে, পবিত্র বাঙ্গালভূমিতে বাঙ্গালা ছাড়া কিছু লিখা যাইবে না, আমরা বহুবিধ কায়ক্লেশ, দূঃখ-দুর্দশা সহ্য করিয়া বাংলা স্বাধীন করিয়াছি- মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ইংরেজীতে নানাবিধ রচনা লিখিয়া দেশ্রূপ মাতৃদাবীর মুখের ভাষাকে কালিমালিপ্ত করিতে প্রয়াস পায়। এই জয় বাংলার যূগে আমরা সচেতন বাঙ্গালী তা হইতে দিতে পারি না।আমরা এই ভাষার উন্নতিকল্পে সোচ্চার, প্রয়োজনে আবার এ মহানগরীর রাজপথে রক্ত দিব(আমি যেটা বুঝিনা তা হল, সোচ্চার হয়ে রক্ত দিয়ে ভাষার উন্নতি কি ভাবে করা যায়?) যাহারা ইংরেজিতে কিছু করার কথা ভাবে তাহাদিগকে আমরা কোলেবরেটর কহি, তাহারা পাকিস্তানের গুপ্তচর। আমরা জীবন দিয়া সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের মাধ্যমে আমাদিগকের দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিব। কাপড় পরিতে না পারিলে বাংলা সংস্কৃতি পরিধান করিব, খাইতে না পাইলে বাংলা ভাষা চিবাইয়া খাইব’।
এমনি রকম ভাবছে সবাই,আলাদা আলাদা ভাবে সবাই ভাবছে, আমি তো বাংলার পক্ষে সচেতন। কিন্তু সচেতন হয়ে কি লাভ যদি বাংলা ভাষার জ্ঞান সম্পদ বৃদ্ধি করা না যায়? সবাই সচেতন কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। আবার কেঊ জ্ঞান চর্চার জন্য অন্য ভাষার দ্বারস্থ হলে প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। এ-এক অদ্ভুত অচলায়তন।
ভাষা একটি জাতির নানা মূখী অভিজ্ঞতার ফলিত প্রকাশ। যে জাতির অভিজ্ঞতা যত সীমিত সে জাতির ভাষাও ততটাই দূর্বল। যেমন আফ্রিকার হটেন্টটদের ভাষা এত দূর্বল ,এর প্রকাশভঙ্গী এত সীমিত যে সামান্য অনুভূতিও ভহাষায় প্রকাশ করা যায় না, তার সাথে নানা রকম অংগভঙ্গী লাগে। আর যে জাতির মানস ও বস্তুগত অভিজ্ঞতা যত সমৃদ্ধ তার ভাষাও ততটাই বেগবানো শব্দসম্ভারে ধণবাণ। যেমন ইংরেজি -ফরাসী বা জার্মান ভাষায় শব্দ সম্ভার এত টাই বিপুল যে একজন মানুষের পক্ষে সব শব্দ জানা অসম্ভব, এমন অসংখ্য শব্দ আছে যেগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ কোন মানুষ কে কখনই করতে হবে না। একজন ইংরেজিভাষী খনিবিদের কখনই নৌবিদ্যা বিষয়ক ইংরেজী শব্দরাশি সবটুকুন লাগবেনা।আবার নাবিকের লাগবে না ভূতব্ব বিষয়ক শব্দাবলী। কিন্তু ইংরেজি ভাষা ভূতত্ত্ব-নৌবিদ্য-খনি বিদ্যা সকল বিষয়ের জন্যেই পর্যাপ্ত পরিমান এ শব্দ আছে। এখানেই ঐ সকল ভাষা সমূহের শক্তি। এসন ভাষা বিজ্ঞান ও তার সকল শাখা - প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান, কলা ,মানবিক, বাণিয্য, প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি সকল ক্ষত্রের পদচারণায় ঋগ্ধ, পরিপুষ্ট।প্রাচিন গ্রীক রোমান ভাষাও এমনি পুষ্ট উন্নত ছিল।অর্থাৎ আমরা সিদ্ধান্তে পৌছুলাম যে জাতির জাগতিক উন্নতীর সাথে ভাষার উন্নতি সম্পর্কযুক্ত। আর জাতির উন্নতি বলতে জাতির সাথে সম্পর্কযূক্ত সকল কিছুর সুসম বিকাশ বোঝায়। দশ বছরের বালকের দেহে যেমন প্রাপ্তবয়ষ্ক হাত পা থাকা অসম্ভব, তেমনি রকটি কোমোর ভাঙ্গা ,মেরুদন্ডহীন জাতি বলবান ভাষার অধিকারে হয়েছে এমনটি হওয়া সম্ভব নয়।বাংলা ভাষা দূর্বল -এ দায় বাংলা ভাষার নয়,বাঙলা ভাষাভাষী ছদ্মভাষাপ্রেমিক মানুষের। তারা ফেব্রুয়াড়ি এলে মাতম-বিলাপ করতে পারে, কিন্তু বাংলা ভাষার কায়া গঠনে এরা অপারগ।
রুটি রুজি, পয়সা কামানো চাকরি ব্যবসায়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইংরেজীর দ্বারস্থ হতে চর্চাকরতে এদের কোন সমস্যা হয় না, কিন্তু এরাই যখন বাংলা ‘সংস্কৃতি’ চর্চায় এদের ‘কন্ট্রিবিউশন’ দিতে যান ইতখন তারা কট্টর বাংলা বাদী-বাংলাপন্থি-বাংলায় উম্মাতাল।পরিতাপের বিষয়, এদের বেশিরভাগই বাংলা টি ভাল করে লিখতে পড়তে বলতে বা বুঝতে পারে না। আরো পরিতাপের বিষয় এরা তাদের ‘কন্ট্রিবিউশন’ এমন একটা ভাষায় করতে চায়যার সাথে তাদের রুটি রুজি চাকরি ব্যাবসায় জীবনাচরণ তথা সংস্কৃতির কোন সম্পর্ক নেই- অর্থাৎ কোন উৎপাদন সম্পর্ক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক নেই এই ভাষার সাথে।ফলাফলঃ দূর্বল, আরোপিত অসংলগ্ন ‘সাংস্কৃতিক কন্ট্রিবিউশন’ -এর মাধ্যমে বাংলা ভাষার পিন্ডি চটকে শ্রাদ্ধ করে বাংলা ভাষা দেবীর সেবা করা হচ্ছে। বাংলা ভাষার সেবাদাস এসব মধ্যবিত্তের চেয়ে অনেক সৎ আমার দেশের মূর্খ চাষা। তার কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত তার ভাষা, সে নিজেকে সে ভাষায়ই প্রকাশিত করে তার ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া , মির্শিদি জারি সারি দিয়ে। তার শিল্প সৃষ্টি মধ্যবিত্তের মত পঙ্কিল অসাড়জড়তা গ্রস্থ নয়। সে ইংরেজি জানেনা বোঝে না সে নিয়ে মধ্যবিত্তসুলভ ফাঁপড়বাজিও মারে না, বাংলা গেল- দেশ গেল বলে চিৎকারও করে না।
আমি মনে করি বাংলা ভাষা প্রচলনের কিছু নেই, বাংলা ভাষা আমার বাংলাদেশএ প্রচলিত আছে। দেশের ৯৫ ভাগ লোক তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম বাংলায় করে। বাকি ৫ ভাগ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত , ধাকাবাসী আঁতেলেকচুয়াল বাংলাপ্রেমী যারা স্প্রত্যহ বাংলা প্রচলনের রব তুলছেন তারাই ইংরেজি হিন্দির ‘ইউজার’, ‘কনজিউমার’। আমার দেশের চাষা-মাঝি-দোকানদার-হকার, আজিরুল-আকালু-নসিমন-হাজেরা-সলিমুদ্দি-র মত লোকেরাতাদের মুখের ভাষাতেই বাংলা প্রচলিত রেখেছে।অই একটি ছাড়া আর কোন ভাষা জানার সুযোগ তাদের নেই। বাংলা একটি জীবন্ত ভাষা, এটি মানুষের মুখে-মুখে কথিত হয়। এরা যদি ঐ ৫ ভাগের মত সংস্কৃতিবাণ না হয়, সে দায় তাদের নয়, ঐশিক্ষিত জ্ঞানবান ধণবান ৫ভাগ লোক বাংলা ভাষায় জ্ঞানের বিকাশ ঘটায় নি, জাতীয়উন্নতিকল্পে তাদের পুঁজি প্রয়োগ করেনি।ঐ ৫ ভাগ মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত তথা বুর্জোয়া আমার দেশের সংখ্যাধিক জঙ্গণের সংস্কৃতিবান হবার অন্তরায়।
যারা ইংরেজি ভাষার উপর খড়্গহস্ত, যারা ইংরেজিতে কোন লেখা দেখলেই তাকে নির্বাসিত, নিগ্রিহিত, ভাগাড়ে ফেলার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যান তাদের বুঝতে হবে যে বাংলা ভাষার শত্রু ইংরেজি বা হিন্দি এসব কোন ভাষা নয়। এর শত্রু হল তথাকথিত শিক্ষিত সংস্কৃত কিন্তু ঔপনিবাশিক -মধ্যবিত্ত মানসিকতায় আকীর্ণ বাংলা চর্চাকারীগণ। একটি ভাষা তখনই শক্তিষালী হবে যখন ঐ ভাষাভাষী জাতির মধ্যেজ্ঞান বিজ্ঞান সমাজবিদ্যা অর্থনীতি শিল্প সাহিত্য প্রযুক্তি প্রভৃতির চাহিদা দেখা দেয়। আর প্রয়োজনিয়তা দেখা দিলেই তার চর্চা হয়। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব হয়েছিল বলেই এডাম স্মিথ তার ওয়েলথ অব নেশন্স লিখেছিলেন,জার্মানিতে পুঁজির বিকাশ হয়েছিল বলেই মার্ক্স তার ক্যাপিটাল লেখেন, ভলত্যার-রুশো-এন্সাইক্লোপিডিস্ট স্কলারদের জন্ম হয়েছিল বলেই ফরাসী বিপ্লব হয়েছিল।মৌলিক উৎপাদন পদ্ধতি,উৎপাদনের উপকরণ ও সম্পর্ক এবং তাদের বিন্যাসের প্রগতিশীল বিকাশের সাথেই ভাষার উন্নতি নির্ভরশীল। আমার দেশের মৌলিক উৎপাদন কৃষি, মৌলিক সমাজ সাংগঠনিক একক গ্রাম,অর্থনৈতিক স্তরবিন্যাসে ৯২ ভাগ দরিদ্র প্রলেতারিয়া, সামাজিক স্তরবিন্যাসে অধিকাংশ নিম্নবর্গের মানুষ। এদের উৎপাদনের উপকরণ, পদ্ধতি ও সম্পর্কের সাথে সন্নিহিত ভাষা প্রচলিত বাংলা। যে ‘দূর্বল’ বাংলা প্রচলিত তা এদেশের ৯২ ভাগ মানুষের চাহিদা পূরণে সক্ষম।যতদিন না নতুন চাহিদা তৈরী হচ্ছে; যতদিন না আমাদের উৎপাদনের উপকরণ, পদ্ধতি ও সম্পর্কের পরিবর্তন হচ্ছে, হোক সে শিল্পায়ন, সমাজবিপ্লব, বা অন্য যেকোন ভাবে; নতুন সামাজিক, রাজনৈতি, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, নৃতাত্ত্বিক চাহিদা তৈরী হচ্ছে ততদিন আমাদের শিক্ষিত সমাজ এখনকার মতই বাংলায় জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে বাংলাকে একটি শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড় করানো থেকে বিরত থাকবে। এবং ততদিন এ সমাজে যারা ইংরেজি চর্চা করতে চায় তাদের তথা ইংরেজি -জর্মন ভাষাকে গালমন্দ করার, পরিত্যাগ করার কিছু নেই। এসব চর্চার মাধ্যমে আমার দেশের একটা অংশ অন্ততঃ শিক্ষিত হতে পারছে। আর বকধার্মিকদের ‘বাংলা প্রচলনের’ চেষ্টাও হাস্যকর।