ছেলেটা সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবছিল আজ বোধহয় ঈদ। কেমন একটা খুশির আমেজ। বাসায় ভাজা ইলিশ মাছের গন্ধ...উমম...
না আজ ঈদ না; আজ পহেলা বৈশাখ। পুরাতন বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমনকে বরণ করে নেওয়ার উৎসব।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছেলেটি বাইরে তাকায়। মনে হয় সমস্ত প্রকৃতিতে যেন একটা প্রাণচাঞ্চল্য। গতকাল রাতেও দেখেছে বারান্দার গ্রিল বেয়ে ওঠা অপরাজিতা গাছটি ঝিমিয়ে গেছে কেমন যেন। আর আজ সকালে উঠে সেদিকে চোখ পড়তেই যেন মন ভরে উঠলো। নতুনকে বরণ করে নিতে জানালার ওপাশের বারান্দার এই ফুলগুলি ছেলেটাকে যেন বারবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
ডাইনিং রুম থেকে মা ডেকে যাচ্ছেন,"খোকা আমরা সবাই খেতে বসেছি,হাত মুখ ধুয়ে চলে আয়। " মা ফজরের নামাজ পড়ে সেই থেকেই পান্তা ইলিশের জন্য কিছু ভর্তা করলেন, ইলিশ মাছ বেগুন ভাঁজলেন, পোড়া মরিচ এর ব্যবস্থা করে সাথে লবন এনে টেবিলে সাজিয়ে নিলেন।
ছেলেটার বাবা হাত মুখ ধুয়ে ছেলেকে ডাকলেন একবার এরপর খেতে বসে গেলেন। ছেলেটা আসার পর মা খেতে বসলেন। ছোট্ট বোন তখনও ঘুমিয়ে, দুইদিন পর দুইবছর হবে ওর।
খাওয়ার সময় মায়ের প্রশংসা করতে করতে খাওয়া শেষ করে ছেলেটি। লজ্জায় মা আস্তে করে খেতে থাকে। ছেলের হাত ধোয়া শেষ হলেই মা বলেন,"সামনের রুমে তোর বৈশাখের ফতুয়াটা রেখেছি ইস্ত্রি করে আর জিন্সের প্যান্ট।"
"আমার লক্ষ্মী মা!!" বলেই ছেলেটি ড্রেস চেঞ্জ করতে রুমে ঢোকে। মা আবারও লজ্জা পান।
ভোরে রান্নাঘরে শব্দ শুনে মা ঘুম ভেঙে উঠে উঁকি দিয়ে বুঝতে পারেন তার মেয়ে। আজকে নাকি সে নিজেই বৈশাখের ১ম রান্না নিজ হাতে করবে। গ্যাসের চুলার উপর ইলিশ মাছ ভাজছে। আর পাশেই কয়েক রকমের ভর্তা আইটেম বানাচ্ছে। গত কয়েকদিন নেট ঘেটে এসব ভর্তা আইটেম বানানো শিখেছে। আজ তাই একটা প্রাক্টিকাল হয়ে যাক। পাশে রাখা পান্তার হাড়ি থেকে পান্তা প্লেটে করে টেবিলে রাখল,ভাজা মাছ ভর্তা সব রেখে সবাইকে ঘুম থেকে তুলল। ছোট ভাইটা উঠেই মেলায় যাওয়ার আবদার করল। একটা বাঁশি কেনার খুব শখ। পাশের বাসার রিফাতের কাছে বাঁশি দেখেছে সে। আজকে সে কিনবেই। বাবা রাজি হলেন। খাওয়ার পর মেয়ের গুনগানে মুগ্ধ সবাই। আজকের এই উপলক্ষে বিকালে পুরো ফ্যামিলি মেলায় যাবে ঠিক হল। ওদিকে মেয়েটির মনে চিন্তা হচ্ছে কখন বান্ধবীদের কাছে গল্প করবে আজকের এত বড় আয়োজনের কথা। নিজের রুমে ফিরে লাল সাদা রঙের শাড়ি গুছিয়ে নিল সে।
ছেলেটা বের হয়ে যাওয়ার সময় মোবাইল ঘড়ি গুছিয়ে নেয়। মা কয়েকশ টাকা ধরিয়ে দেন হাতে। ছেলে বলে কিছু টাকা আছে তার এতেই হয়ে যাবে। বলেই বের হয়ে যায়।
"এই মামা যাবা " রিক্সা নিয়ে সোজা চলে যায় মিরপুর ১২ এর বাসস্ট্যান্ডে।
মেয়েটা শাড়ি পড়ে বের হয়। কপালে টিপ। বৈশাখি সাজ। মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবেন মেয়েটা যেন তার অনেক তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে। বাসার সামনে কিছুদূরেই মেইন রোড সেখানেই সে দাঁড়ায় বাসের অপেক্ষায়।
ছেলেটা বাসে ওঠে। উঠেই মোবাইলের মিউজিক প্লেয়ার ওপেন করে। একটা গান শুনতে শুরু করে হেডফোনে । বাস ততক্ষণে বেশ কিছুদূর চলে এসেছে।
মেয়েটা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে গানের লিস্ট দেখে নেয়। আজকের দিনের জন্য কিছু প্রিয় গান আগেই সেলেক্ট করে রাখে। বাস আসলেই সে শুনবে। এতক্ষণে বাস চলে আসে। মেয়েটা উঠে সামনের মেয়েদের সিটের একটাতে বসে। আজকে বাসে লোকজন নেই। সারা বাসে দশজনও হবে না। মেয়েটি গান শুনতে শুরু করে।
ছেলেটার পছন্দ মেটাল গান। মাঝে মাঝে হালকা গানও শোনে। যেমন এখন সে শুনছে নিকেলব্যাক এর "ফার অ্যাওয়ে" গানটা। অদ্ভুত একটা মায়া আছে গানটার মাঝে।
মেয়েটার পছন্দ ইন্ডিয়ান পুরনো দিনের শিল্পীদের গান। শচীন দেব বর্মন,রাহুল দেব বর্মন,উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার গান। খুব হালকা গান। এখন অবশ্য তার প্রিয় একটা গান শুনছে অর্ণবের,
"মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না....।"
ছেলেটা কখনও সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি। কি একটা ঘটনা হয়ে গেছে তার সাথে কেউ জানেনা। আস্তে আস্তে সিগারেটের পোড়া অংশের মতই নিজের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে কেউ জানেনি। একটা সিগারেট হলে বাস জার্নিটা ভাল জমতো একা একা ভেবে নেয় ছেলেটা।
মেয়েটা সিগারেট মোটেও পছন্দ করে না। একদমই না। কিন্তু সিগারেটখোর কোন ছেলে দেখলেই তার জানতে ইচ্ছে করে এই সিগারেট কেন ছেলেটা খায়। শুনেছে প্রচন্ড হতাশায় সিগারেট হয় সঙ্গী। মেয়েরা তো এরকম কিছু পারে না করতে। গতবছর মেয়েটা সুইসাইড করতে চেয়েছিল। আর এখন নিজের উপর নিজেরই হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা মনে মনে ভাবে একটা সিগারেটখোরকেই জীবনসঙ্গী বানাবে। এরপর এই অভ্যাস থেকে বের করে আনবে তাকে। মেয়েটার সাহস আছে বটে।
ছেলেটার কিছু স্বপ্ন আছে। স্কাই ডাইভিং, বাউন্সি জাম্পিং করা, স্লিপনট,লিংকিন পার্ক, অল্টার ব্রিজের লাইভ কনসার্ট দেখার। ছোট্ট একটা বাড়ি করা যার উপরে বিশাল ছাতার মত টাঙিয়ে শেষ বিকেলে চায়ের কাপ হাতে একান্তে কারো সাথে গল্প করার। এছাড়া খুব শখ একটা সিনেমা বানাবে। মাঝে মাঝে লেখালিখিও করে সে।
মেয়েটার শখ বই পড়া। যখনই কোথাও যায় তখনি তার হাতে বই থাকে। চোখে চশমা,নার্ড টাইপ লুক। তবে তার একটা স্বপ্ন আছে। জনমানবহীন কোন এক বিশাল নদীর মাঝে নৌকার উপর শুয়ে তারা ভরা আকাশ দেখা। চাঁদ থাকবে না শুধু তারা। সাথে কেউ থাকলে আরও ভাল হয়।
ছেলেটার চশমা পড়া মেয়ে পছন্দ। মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া। খোলা চুলের এরকম মেয়ের দিকে তাকালে পুতুলের মত লাগে ওর। আর অবশ্যই মেয়েটার অনেক কথা বলার যোগ্যতা থাকতে হবে। যতই বয়স হবে মেয়েটা সারাদিন নানা বিষয় নিয়ে গল্প করে ছেলেটার কান ঝালাপালা করে ফেলবে; হ্যা ঠিক এরকম একটা মেয়ে তার পছন্দ।
মেয়েটা অনেক গল্প করতে পারে,চঞ্চল স্বভাবের। বাসায় ওর কথায় অতিষ্ঠ হয়ে যান মা বাবা। বান্ধবীরা ওকে নাম দিয়েছে "তোতাপাখি "। সারাদিন মুখ চলতেই থাকে।
মাঝে মাঝে নিজের ভবিষ্যৎ সঙ্গীর কথা ভেবে দুঃখ পায়। ভেবে নিয়েছে ডাক্তার বিয়ে করবে। কানে সমস্যা হলেও ঠিক করিয়ে নিতে সমস্যা হবে না তাহলে। ^_^
ছেলেটা চেয়েছিল একজন লাল সাদা শাড়ি পড়া কারও সাথে পাঞ্জাবী পড়ে ঘুরে বেড়াবে। সে যা কিছু চাইবে কিনে দিবে। লাল ও নীল রঙের ডজন খানেক চুড়ি কিনে দিবে। সেই চুড়ি হাতে ঝনঝন করে বাজবে। সেই হাতে হাত রেখে দুজনে পাড়ি দিবে অনন্ত পথ।
মেয়েটার চুড়ির শখ। ইশশ কেউ যদি তাকে চুড়ি দিত কিনে। লাল - নীল কাঁচের চুড়ি ডজনখানেক। খুব যত্ন করে আগলে রাখত সারাজীবন।
৩৬ নম্বর বাসে মেয়েদের সীটে বসে থাকা এই মেয়েটা নেমে গেল ইডেন কলেজের সামনে। একবার শুধু পেছন ফিরে তাকিয়েছিল জানালার কাছে বসা বৈশাখী ফতুয়া পড়ে ছেলেটার দিকে।
আর ছেলেটা নামলো ঢাকেশ্বরী মোড়ে। বাস থেকে নেমেই রিক্সাওয়ালাকে বলল,
"মামা যাবা,মিটফোর্ড হসপিটাল?"
ছেলেটা আর মেয়েটার এরপর কখনই দেখা হয় নি।
পহেলা বৈশাখ
১৪২২
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৭