মহাকাশের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর কাজ হলো কোন নতুন গ্রহের ভেতর অনুসন্ধান চালানো। অন্তত জ্যাকের কাছে তা ই মনে হয়। জীবনে তিনবার তার সুযোগ হয়েছে এরকম মিশনে যাওয়ার। পি-এইট ও পি-নাইন এই গ্রহ দুটিতে অভিযান ছিল সবচেয়ে বেশি আনন্দের। মিল্কিওয়ে থেকে তিন হাজার আলোকবর্ষ দূরের এই গ্রহ দুটি ছিল অনন্য। ২৫ শতকের মাঝামাঝি এসে এসব গ্রহে যাওয়ার ব্যাপারটা এতটা জনপ্রিয় হবে সেটা আগে বোঝার উপায় ছিল না। তার উপর সময়ের সাথে গতির সূত্রগুলোর এত সুন্দর আবিষ্কার হওয়ায় মহাকাশ ভ্রমণের স্বর্ণযুগ এখন।
কথা গুলো ভাবতে ভাবতে স্পেস-O2 স্যাটেলাইটে বসে মেরামত করতে থাকল জ্যাক। এর মত বোরিং কাজ আর নেই। তবে বয়স হয়ে গেছে। বাস্তবের বয়স ২০০ ছুঁইছুঁই। তিনবার এইজ রিকভারি ট্রিটমেন্ট এবং চারবার রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নিয়েছে সে। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন এরপর ওই শরীরে এসব আর নেওয়া যাবে না। তাহলে ফুল বডি শাটডাউন হয়ে যাবে যেকোন মুহুর্তে। ফুল বডি শাটডাউন ব্যাপারটা প্রথমে জ্যাক বুঝতে পারেনি। ব্যাপারটা পরে ডাক্তাররা বুঝিয়ে দেয়। এইজ রিকভারি প্রসেসে যা করা হয় তা হলোঃ মানুষের জীবনের আয়ু যেহেতু সময়ে হিসেব করা হয় সেহেতু সেই সময়কে সময় ও গতির সূত্রের সাহায্যে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব একটা নির্দিষ্ট প্রসেসের মাধ্যমে। আর ফুল বডি শাটডাউন হলে যে বয়সটা রিকভার করা হয়েছে সেটা চলে আসবে আবার একসাথে। জ্যাক বুঝতে পেরেছে সব। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কাজে মনোযোগ দিলো সে।
জ্যাকের সাথে আছে অন্য একজন। ওর নাম মোর্স। ছেলেটার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে,চঞ্চল। জ্যাকের খুব ভক্ত এবং খুবই বিশ্বস্ত। যথেষ্ট কর্মপটু সে। আর সবকিছুতেই তার উৎসাহ। নইলে এই বয়সে স্পেসে আসাটা সবার ভাগ্যে জোটে না।
সূর্যের বিপরীত দিকে ফিরে স্যাটেলাইট মেরামতের কাজ করছে দুজন। ওদের পেছনে প্রায় ৩৬ফুট দূরে স্পেশ শিপটা থেকে নিজেদের আটকে রেখেছে। শিপটা অটোপাইলট ও অটোরোটেশন মুডে রাখা। সুতরাং অভিকর্ষণ বল না থাকলেও শিপটা যেভাবেই আছে সেভাবেই থাকবে। শিপের মধ্যে একদিনের ট্রিপে যা থাকা দরকার সবই আছে। এক্সট্রা হিসেবে আছে জ্যাকের একটা পোষা প্রাণি। পি-এইট গ্রহ থেকে নিয়ে এসেছিল। পৃথিবীর বাইরের প্রাণিদের সংগ্রহে রাখার ঝোঁক গত তিন দশক ধরে বেশ ভালই চলছে। কুকুরের বদলে এখন বাইরের গ্রহের দোপেয়ে কিছু প্রাণি বেশ জনপ্রিয় এখন। এদের খাবার বাসস্থান নিয়েও তেমন ঝামেলা নেই। তাই এসবের দিকেই মানুষ বেশি ঝুকছে। এই পোষা প্রাণি নিয়ে রাশিয়ার "ইটি ফ্রেন্ডলি পেটস" ও আমেরিকার "নেভার পেটস" প্রতিষ্ঠান দুটি বেশ ভালই ব্যবসা করছে। গ্রহ অনুসন্ধান মিশন থেকে ফিরে জ্যাক অনেক প্রাণি এই দুই সংস্থার কাছে বিক্রি করেছে কিন্তু একবার একটা প্রাণিতে তার চোখ আটকে যায়। হালকা নীল আভাযুক্ত সিলভার কালারের অক্টোপাস সদৃশ একটা প্রাণি। মাথার রঙ সবুজাভ। গভীর কালো চোখ দুটো অনেক মায়াময়। খাদ্য হিসেবে শুধু আলোই যথেষ্ট। খাদ্য গ্রহনের সময় রঙ পরিবর্তন করে সবুজ আকার ধারণ করে যে অংশে আলো পড়ে। ফটোসিন্থেসিস করার ক্ষমতা আছে প্রাণিটার। আর রাতের বেলা ডিমলাইটের মত নীল আলোয় জ্বলতে থাকে। জ্যাক ওর নাম রাখলো মাইলো।
একটা ছোট্ট খাঁচায় করে রাখলো যার উপরের পাশ কাঁচের তৈরী যাতে আলো পেতে পারে। তার উপরে একটা লাইট লাগিয়ে দিয়েছে জ্যাক। তবে যখন লাইটটা সমস্যা হয় বা জ্যাক আলোর কাছে খাঁচা রাখতে ভুলে যায়, তখন মাইলো খাঁচার ভেতর থেকে একটা হাত বড় করে বের করে দেয় কাছাকাছি যেদিকে আলো আছে সেদিক বরাবর। এর মানে বোঝা যায় প্রাণিটার লাইট বা হিট সেন্স করার ক্ষমতা আছে। তবে জ্যাক এর চিন্তার কারণ অন্য একটা ব্যাপারে। সেটা হলো সেদিন, যেদিন সে দেখল যে এই প্রাণিটা মাংসাশীও।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেল রুমের জানালা খোলা। রাতে বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল হয়ত। জানালা লাগিয়ে দিয়ে সে মাইলোর খাঁচার কাছে ফিরে দেখতে পেল বেশ কিছু পোকামাকড় জড়ো হয়েছে চারিদিকে। জানালা খোলার কারণেই হয়েছে। মশা আর ছোট ছোট মাছি কয়েকটা।
" জাস্ট লিভ ইট অ্যালোন!!!"
এটা বলে জ্যাক চিৎকার করে পোকামাকড় গুলোকে সরিয়ে দিতে গেল। তখনি ব্যাপারটা খেয়াল করলো। খাঁচার ভেতরে অনেক গুলো পোকামাকড়ের কাইটিনের খোলস পড়ে আছে এবং এখন যেসব পোকা আশেপাশে উড়ছে এদের গায়ে খুব সূক্ষ্ম এক ধরণের মাকড়শার জালের মত তন্তু বা সুতা আটকানো রয়েছে। জ্যাকের কাছে ইন্টারেস্টিং লাগলো ব্যাপারটা। সে পোকামাকড় গুলো না সরিয়ে দিয়ে বরং ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো ঘটনাটা। সে দেখতে পেল পোকাগুলো কাছে না টেনে দূরে থেকেই নিষ্প্রাণ করে ফেলছে এবং জ্যাকের একটা সময় মনে হলো ওই তন্তু গুলো চোষক এর মত কিছু একটা। খোলস ছাড়া বাকি অংশগুলো শিল্পীর মত নিপুণ ভাবে শুষে নিয়ে গেল এবং মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সব পোকামাকড় শেষ আর এদের খোসাগুলো শুধু খাঁচার আশেপাশে পড়ে আছে। জ্যাক তাজ্জব বনে গেল যেন। একটা নোটপ্যাডে টুকে নিল ইনফোগুলো। ভাবলো পরে কাজে লাগতে পারে। ব্যবসায়িক চিন্তাও মাথায় এলো কিছু।
এরপর থেকে মাইলো আলোর চেয়ে ওই পোকামাকড় গুলোর প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। জ্যাকও পোকামাকড় ধরার জন্য উপযোগী আল্ট্রাভায়োলেট একটা লাইট বসিয়ে দেয় যাতে একদিকে পোকামাকড় সহজেই আকৃষ্ট হয় আর অন্যদিকে পোকামাকড় না থাকলেও ফটোসিন্থেসিস করতেও মাইলোর সমস্যা হবে না।
নোটপ্যাডে কিছু বিষয় জ্যাক তুলে রেখেছিল। সবমিলিয়ে সে কিছু পয়েন্ট পেল যেমন, মাইলোর বৃদ্ধি মাংসাশী হওয়ার পরে আস্তে আস্তে বেড়েছে। তার শিকার ধরা ও সম্পূর্ণ শেষ করে ফেলার সময় আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। আগে তিনগুন সময় লাগত। তার উপর মাঝে মাঝে অনেকক্ষণ ধরে পোকামাকড় না পেলে কেমন একটা অদ্ভুত হয় খাঁচার ভেতর থেকে। যান্ত্রিক শব্দ অনেকটা "ঘরঘর...সসস..." এরকম অর্থাৎ তার খিদে পেয়েছে। এরকম অবস্থায় মাইলো তার সেই সূক্ষ্ম তন্তুগুলো খাঁচা থেকে বাইরে বের করে দেয় এবং অনেক স্পষ্টভাবে দেখা যায় কেননা আকার বড় হয়ে যায়। আগে শব্দের ব্যাপারটা অনেক পরে পরে হত। এখন কম সময় ব্যবধানেই সে এধরণের শব্দ করে। এজন্য জ্যাক শুধু পোকামাকড় এর উপর ভরসা করে নেই। খাবারের উচ্ছিষ্ট মাংসের হাড়, মাছের কাঁটা এবং মাঝে মাঝে খাবার বেঁচে গেলে তাও রেখে দিত। আর খাঁচাটার আকারও জ্যাককে বাড়াতে হয়েছে আগের চেয়ে। জ্যাক বুঝতে পারে মাইলো আর আগের মত সেই মায়াবী কোন পোষা প্রাণি নেই, তার মধ্যে পরিবর্তন আসছে ধীরে ধীরে।
পৃথিবীর সময়ে এখন দুপুর দেড়টা বাজে। এমন সময় স্পেশ শিপে লাগানো ইন্টারকমে একটা অদ্ভুত শব্দ শোনে দুজন। শব্দটা ঘরঘর...সরসর...রররর...সসস...এরকম হচ্ছে। একটু পর পর থেমে থেমে আসা শব্দটা শুনে দুজনেই অবাক হয়।
- হায়। আবারও মনে হয় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে ভেতরে। এই সপ্তাহেই শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল পরে শিপটা সারানো হলো। মোর্স দেখে আসো তো কি সমস্যা হয়েছে। মাইলোর খাবার রেখে এসেছিলাম। ও আবার কিছু করলো কিনা দেখো তো। আর আমি একটু পর আসছি। ভেতরে যেয়ে সার্ভার রিস্টার্ট করে চেক করে দেখতে হবে যে সব ওকে আছে কিনা। এরপর আমি ফিরব। জ্যাক এই ভেতরে গেল।
মোর্সের কাজ শেষ। সে শিপের সাথে আটকানো তার ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে হেলমেট খুলে এরপর শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর জ্যাকের রুম ছাড়া বাকি সব চেক করলো সে।
- স্যার আমার মনে হয় শব্দটা আপনার রুম থেকে হচ্ছে। মোর্স জ্যাককে ইনফর্ম করলো।
- ওকে চেক করে দেখ। মাইলোর জন্য খাবার রেখে এসেছিলাম আমার টেবিলে। জানাও।
রুমে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে দেখলো চারিদিক ধোয়ায় ঢেকে আছে।
- স্যার ধোয়ায় রুম ছেয়ে গেছে। সম্ভবত আগুন লেগেছে কোথাও শর্ট সার্কিট হয়ে।
- আমি আসছি মোর্স। মাইলোকে খেয়াল করে সরিয়ে নাও। আমার কাজ প্রায় শেষ। দরজার কাছেই ফায়ার এক্সটিংগুইশার আছে একটা। কাজে লাগবে। ভাল করে চেক করে দিতে বললাম কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার খেয়ালই করে নি মনে হয়।
রাগ লাগছিল জ্যাক এর। একই ঘটনা আগেরবারও হয়েছে। এবার পৃথিবীতে ফিরে এর শেষটা দেখে নেবে। "বয়স হয়েছে দেখেই কি এইসব নষ্ট শিপ আমাকে দিয়ে দিবে? আমি মানব না!" মনে মনে রাগে গরগর করতে লাগল জ্যাক।
- স্যার আমি কোন উৎস খুঁজে পাচ্ছি না। আর ধোয়াটা কেমন যেন। বাষ্প জাতীয়। সামান্য আঠালো আঠালো। আর মাইলো খাঁচায় নেই স্যার।
জ্যাক মাথায় যেন শক খেলো একটা। ও যা ভাবছে সেরকম কিছু হওয়া পসিবল না।
- মোর্স তুমি যত তাড়াতাড়ি পারও বাইরে চলে আসো। আর আমার রুম লক করে দাও। কুইক!
- কেন স্যার? গতবারের মত আগুন ধরে গেলে তো সমস্যা হয়ে যাবে।
- আমি যা বলছি করও। আর কোন প্রশ্ন না। আমি আসছি। ওটা আগুন নয়। জলদি করও। দেরী করও না।
জ্যাক ঘামছে। ও যেটা সন্দেহ করছে সেটা সত্যি যেন না হয় সেটা প্রার্থনা করতে করতে যত দ্রুত পারে এগিয়ে যাচ্ছে স্পেস শিপের কাছে।
- মোর্স! কাজ হয়েছে? মোর্স!!!
ঘরঘর শব্দ ছাড়া মোর্সের ওপাশ থেকে আর কোন শব্দ আসছে না।
- মোর্স!!! মোর্স!!!
ভেতরে ঢুকে জ্যাক দেখলো সমস্ত ঘর ধোয়ায় ঢেকে আছে। ধোয়া হেলমেটের কাঁচ স্পর্শ করার সাথে সাথে সে খেয়াল করলো যে কাঁচে কুয়াশার মত জমে গেছে যেমনটা ঠান্ডা পানির বোতলের বাইরের দিকে হয়।
রুমের একপাশে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া খাঁচাটা ভেসে বেড়াচ্ছে। তার পাশেই খাঁচার ভেতর মোর্সের চশমাটা আটকে আছে। জ্যাক বুঝতে পারলো মাইলোর খাবারের তালিকায় পোকামাকড়ের পর এবার নতুন আইটেম যুক্ত হলো। সেই একই শিকার পদ্ধতি। একইভাবেই শিকারকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে শরীরে শুষে নেওয়া। রেখে যাওয়া খাবার নাগাল পায় নি আর তার উপর খিদে যেহারে বেড়েছে তার জন্য মাইলো সমস্ত রুমেই তার ধোঁয়াটে জাল বিন্যাস করেছিল। আর তাতেই মোর্স আটকে যায়। এতটা দ্রুতগতিতে এতকিছু কিভাবে হল জ্যাকের মাথায় আসছে না। সামান্য সময়ের ফ্রাকশনের মধ্যেই বৃদ্ধ জ্যাকের ব্রেইনে খেলে গেল। সাথে সাথে একটা শীতল স্রোত সে তার মেরুদন্ডে ফিল করতে শুরু করলো যেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে জ্যাকের মনে আরেকটা চিন্তা দেখা দিল। নতুন খাদ্যের স্বাদ পাওয়া প্রাণিটা এই স্বাদের সন্ধানে এতটা ভয়ংকর হতে পারে জ্যাকের এই ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না। তখনই চোখে পড়লো মোর্সের স্পেস স্যুটটা অন্যপাশের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে আর গলার কাছ থেকে লাল লাল রক্তের ফোটাগুলো যেন শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মত ধীরে ধীরে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে আর ধোয়ার মত বস্তুতে আটকে যাচ্ছে। সম্বিৎ ফিরে পেল জ্যাক তখন। বুঝতে পারলো মাইলো সেই মায়াময় চোখের শান্ত শিষ্ট কোন প্রাণি নেই আর। হয়ত সে কখনই ছিল না। সে সবসময়ই হয়ত হিংস্র একটা প্রাণিই ছিল কিন্তু জ্যাক সেটা কখনও বুঝতে পারে নি।
প্রচন্ড আতংকের মধ্যে সে লক্ষ্য করলো আশপাশ থেকে ধোঁয়াটে নীলাভ বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চোষকের মত দেখতে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১০:২৩