somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ গন্তব্য

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



"মনের সংকীর্ণতা গাছের ছায়ার মত। দিন শেষ হওয়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে যতক্ষণ না সংকীর্ণতামুক্ত হওয়ার মত পরিস্থিতিতে কেউ পড়ে। এরকম মানুষদের কাছে অন্য সবাইকে স্বার্থপর আর সংকীর্ণ মনের মনে হয় এবং নিজেরা অহংকারী হয়। "
কথাটা বলেই মেয়েটা আমার দিকে তাকালো। আমি কিছুই বুঝলাম না। কিছুই না।
"দেখো কবির, আমাদের সম্পর্কটা এভাবে আর আগাতে পারে না। আমি জানি তুমি আমার জন্য অনেক করেছো, আমাদের সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে অনেক চেষ্টা করেছো কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমরা আসলে কেউ কারও জন্য নই। আমাদের গন্তব্য খুব সম্ভবতঃ এক নয় কবির।"
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে গেল মীরা।

আমার হাতে ধরা কফির কাপটা মনে হচ্ছিল আর তুলতে পারছি না। সমগ্র পৃথিবীর ভর যেন জমা হয়ে আছে।

মীরা আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। এরপর আমার ঘড়িটা আমার টেবিলের উপর রেখে শুধু একটা কথাই বলল,"ভাল থেকো।"

আমি কেন যেন কিছুই বলতে পারলাম না। কফির কাপ হাতে বসে ছিলাম আর তাকিয়ে ছিলাম মীরা যে চেয়ারে বসেছিল সেখানে। টেবিলে আমার আর মীরার কফির কাপ, মীরার ফেরত দেওয়া আমার ঘড়িটা এবং এক কোনায় রাখা কয়েকটা টিস্যু। ঘড়ির কাটাগুলো একটা সময়ে এসে বন্ধ হয়ে আছে। সময়টা আরও একবছর আগে ঠিক বিকেল চারটা বেজে দশ মিনিট। ঠিক যেই সময়টায় মীরা আমাকে জানিয়েছিল মনের কথা। বলেছিল সেও আমাকে ভালবাসে। ঘড়িটা সেদিন বন্ধ করে ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, "যখনি দূরে থাকব, আমার কথা মনে পড়লে এটা হাতে নিও। দেখবে আমি খুব কাছেই আছি তোমার।" কথাগুলো স্পষ্টই মনে আছে আমার। ভয়, আতংকে, উৎসাহে দুজনের হাত কাঁপছিল সেদিন।

মীরার সাথে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। এক ধরণের হীনমন্যতায় ভুগতাম আমি। তাই আর যোগাযোগ করা হয়নি ওর সাথে। আর কোন সম্পর্কেও জড়াই নি। কেমন যেন সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর একদিন শুনলাম ওর বিয়ে হয়ে গেছে। খবরটা তেমন একটা চেতনা জাগালো না আমার মধ্যে।



এক
একবছরের সম্পর্কটা খুব একটা প্রভাব ফেললো না আমার জীবনে। মাস্টার্স পাস করার পরই বেসরকারি একটা জবে ঢুকে পড়লাম আমি। মাসে মাসে টাকা যা আসত তাতে মা, আমি আর আমার ছোট ভাইয়ের ছোট সংসার বেশ ভালভাবেই চলে যেত। ছোট ভাইয়ের ইন্টারের পরেই তাদের দুজনকে ঢাকায় নিয়ে আসলাম। ঢাকা ভার্সিটির ভাল একটা সাবজেক্ট এ চান্স পেয়ে গেল ও। মগবাজারে একটা বাসায় থাকা শুরু করলাম আমরা।

বাবা খুব ছোটবেলায় আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। মামাদের সাথেই ছিলাম এতদিন। আমার দুই মামা। মা সবার ছোট। মামারা একজন ইঞ্জিনিয়ার আরেকজন সেনাবাহিনীতে আছেন। তাই আর পরিবার নিয়ে তেমন ভাবতে হয়নি কখনও। এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন।

ছোটমামা আমাদের বাসায় এলেন একদিন। মা'র সাথে কি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন যেন। আমি শহরের বাইরে ছিলাম অডিট এর কাজে কিছুদিন। পরে বাড়ি এসে শুনলাম আমার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে। মামার এক বন্ধুর মেয়ে। নাম শান্তা। এরপর মেয়ে দেখা হলো, ছেলে দেখা পর্ব গেল। দেখতে দেখতে গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌভাত সকল অনুষ্ঠান একে একে শেষ হলো।

মেয়েটাকে এতদিনে একবারও ঠিকভাবে দেখিনি সামনাসামনি। মা'র পছন্দ হয়েছে খুব। তার উপর ফ্যামিলিও ভাল। আমারও খারাপ লাগেনি।

মেয়ের নাম শান্তা হলেও সে ছিল আমার দেখে সবচেয়ে অশান্ত মেয়ে। প্রথমদিন থেকেই বাসার সব কাজের দায়িত্ব নিজের মাথায় তুলে নিলো। মাস্টার্সের ক্লাস চলছে তখন ওর। সকালে বাসার সবকিছু গুছিয়ে নাস্তা বানিয়ে বের হয়ে যেত। দুপুরে যেদিন আসতে দেরী হত সেদিন দুপুরের খাবারও রেখে যেত। আমার মা নতুন বউ পেয়ে সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দিত। এক বুয়া এসে ঘরের বাকি কাজ করত। ছোট ভাই হোস্টেলেই থাকত। সপ্তাহের শেষে একবার বাসায় আসত। তখন মাঝে মাঝে শান্তা বাসায় ভাল রান্না বান্না করত আবার মাঝে মাঝে আমি বাসার সবাইকে নিয়ে বাইরে খেতে যেতাম।

শান্তা ছিল আমার জীবনে দেখা অসাধারণ একজন নারী। আমার মায়ের মতই ওর ছিল সবকিছুর মধ্যে একটা ভিন্নরকম চয়েজ। আমার কেনাকাটা চয়েজ এসব একেবারেই জঘন্য ধরণের। বাজার করাটা যা পারি কিন্তু কাপড় চোপড় এর ব্যাপারে একেবারে যাচ্ছেতাই। বাসার কার কি লাগবে, কেমন জিনিস মানাবে সেটা শান্তার চেয়ে কেউ ভাল বুঝত না। বউ শাশুড়ি মিলে কোন জিনিস পছন্দ করলে সেটার ব্যাপারে না করা আমাদের দুই ভাইয়ের পক্ষে অসম্ভব ছিল। এজন্য আসলে আমাদের চিন্তাও কমে গিয়েছিল অনেক। ছোটভাইটা কোন প্রোগ্রামে গেলে ভাবির কাছে জিজ্ঞেস করে নিত কি পড়ে যাবে। আমার এসব ছাপিয়ে শুধু বারবার মনে হত জীবনটা সত্যিই সুন্দর। মোটেও ঝাপসা না, বেশ রঙিন।



দুই
সময়গুলো কিভাবে যে কেটে গেল। মাস্টার্স করে শান্তা প্রাইভেট ব্যাংকে জবে ঢুকে পড়ল। এরপর ছোট ভাইটা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে গেল। এর মধ্যেই আমাদের পৃথিবী আলোকিত করে এল একজন। ওটির সামনে টেনশনে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা অবস্থায় যখন শুনলাম খবরটা তখনকার অনুভূতি আমি কখনই ভুলব না। এরপর ওকে যখন দেখলাম তখন মনে হচ্ছিল এটা একটা মিরাকল। বাবুর দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সবকিছু ভুলে থাকা যায়।

শান্তাকে নিয়ে এরপর ওর মায়ের বাসায় গেলাম। শ্বশুরবাড়ি এর আগে এতদিন কখনই থাকা হয়নি। আদর যত্নের কোন কমতি ছিল না। অফিস করে প্রতিদিন সেই বাসায় যেতাম। ছেলেটা একেবারে ওর মায়ের মত হয়েছে। যতই দেখি ততোই অদ্ভুত লাগে। এরমধ্যে শহরের বাইরে কাজে যেতে হল। মাকে রেখে গেলাম শান্তার কাছে ওদের বাড়িতে। আমি চলে এলাম।

শহরের বাইরে ছিলাম প্রায় এক মাসের মত। প্রতিদিনই বাসায় খবর রাখতাম।
অফিসের কাজে ঠিক মন বসত না। শান্তা আর বাবুর কথাই ভাবতাম। অফিসের বসের সাথে নিয়মিত নানা বিষয় নিয়ে কথা বলত। এরকম একদিন কথা বলতে বলতে বের হয়ে আসল ইনি মীরার স্বামী। জনাব জাহিদুল ইসলাম। মধ্যবয়সী, বিশাল বড়লোক মানুষ এবং ভদ্রলোক। মীরার ব্যাপারে কথা বলতে গেলে প্রথমে ভাবলাম এড়িয়ে যাই। কিন্তু পড়ে ভদ্রলোকের কথায় কথায় বলে ফেললাম যে মীরাকে আমি চিনি। একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম। জানি না মীরা তার কাছে আমার কথা বলেছে কিনা। ভদ্রলোক আমাকে বাসায় দাওয়াত দিলেন। প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে রাজি হতে হলো বাধ্য হয়ে।

হঠাৎ করে মীরার স্মৃতিগুলো মাথায় ভেসে উঠল একে একে। আবার সেই হীনমন্যতা। আমি কি আসলেই সংকীর্ণ ছিলাম? আমাদের সম্পর্ক থাকার সময়ের বেশ কিছু ব্যাপারে আমি নিজের মত চলতাম। মীরাকে অনেক ব্যাপারেই আমি ছাড় দিতাম না। কোন ছেলের সাথে মিশতে দিতাম না। আমি ওকে সন্দেহ করতাম না কিন্তু ব্যাপারটা আসলে আমার ভাল লাগত না। আমিও কোন মেয়ের সাথে মিশতাম না তাই হয়ত এরকম মনে হত। অনেক চেষ্টা করতাম ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিতে কিন্তু হত না। এ নিয়ে নানা রকম ঝামেলা লেগেই থাকত। সম্পর্কের প্রথম সময়গুলো বেশ ভালই কেটেছিল কিন্তু এরপর এই সমস্যাগুলো শুরু হয়। একটা সময় মীরা ইচ্ছা করে কাজটা করত যা একসময় আমার জন্য আর মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। এভাবেই সেদিন আমাদের সম্পর্কটা শেষ হয়ে যায়। চিন্তাগুলো একের পর এক মাথায় আসতে শুরু করে। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি, "আমি এরকম না। আমি এরকম না।"



তিন
জাহিদ সাহেবের বিশাল বাড়ি। আমার কাছে বাংলো টাইপ মনে হচ্ছে। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে নিয়ে এলেন। বাসায় ঢুকে কেমন ভয় ভয় করছে।

ড্রইংরুমে ঢুকতেই হাতের ডানের দেয়ালে বিশাল একটা দেয়াল ঘড়ি চোখে পড়লো। চারকোণায় চারটা বিশাল শ্বেত পাথরের মূর্তি। সবগুলোই মেয়ের। কেউ মাথায় কেউ কোমরে কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় লাল রঙের পর্দা তার উপর সোনালী কাজ করা ঝুল। ঘরের মাঝে বিশাল একটা টেবিল, পাশে গদিওয়ালা সোফা, মেঝেতে বেশ দামী কার্পেট আর মাথার উপর বিশাল বড় একটা ঝাড়বাতি। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ সমস্ত রুম জুড়ে ছড়িয়ে আছে। আমি ঘোরের মধ্যে কোনরকম সোফায় গিয়ে বসলাম। জাহিদ সাহেব ভেতরে গেলেন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ড্রইং রুমটা ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। একটা দেয়ালে মীরা আর জাহিদ সাহেবের বিয়ের বেশ কিছু ছবি,তাদের বিভিন্ন জায়গায় টুরের ছবি,দুজনের ছোটবেলার কিছু ছবি ছোট ছোট ফ্রেমে রাখা। মীরার চেহারা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সাথেই একটা ছোট্ট বারান্দা তাতে ছোট ছোট গাছ,কিছু অর্কিড কয়েকটা ক্যাকটাস রয়েছে। মীরা যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমনি সব গুছিয়েছে।

"আমাদের ড্রইংরুমটা আমি নিজ হাতে সাজাবো। কারন মেহমান আসলে প্রথমেই ড্রইংরুম দেখে। একটা দেয়ালে বিশাল একটা ঘড়ি থাকবে। অন্য একটা দেয়ালে থাকবে তোমার আমার, আমাদের বাবুর ছবি অনেকগুলো ছোট ছোট ফ্রেমে। সোফা থাকবে গদিওয়ালা আর মাঝে একটা কাঁচের অথবা পাথরের টেবিল থাকবে। মাথার উপর ঝাড়বাতি থাকবে। আর বারান্দায় অর্কিড এবং ক্যাকটাস গাছ রাখব কয়েকটা কিন্তু মানিপ্লান্ট রাখবো না। শুনেছি তাতে নাকি টাকা চলে যায়। আর তুমি হবে আমার বাগানের মালি।" কথাটা বলে মীরা খুব হাসি হেসেছিল। এতদিন পর মীরার কথাগুলো এত স্পষ্টভাবে মনে আছে কিভাবে জানি না। মনে হচ্ছে এইত গতকালের ঘটনা।

আমি বারান্দায় রাখা একটা মানিপ্লান্ট গাছের পাতায় হাত বোলাচ্ছিলাম। এমন সময় জাহিদ সাহেব এর কথা শুনে পেছনে ফিরলাম।

"এই যে কবির সাহেব মীরা কে নিয়ে এলাম। আপনারা কথা বলুন। আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসছি।" কবির সাহেব চলে গেলেন ভেতরে। ইচ্ছে করেই চলে গেলেন কিনা বোঝা গেল না।

মীরা দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দা থেকে ঝাড়বাতির আলোয় মিরাকে অন্যরকম লাগছে। আমি যেয়ে একটা সোফায় বসলাম। মীরা অন্যপাশের সোফায় বসলো।

"ভালোই আছো দেখা যাচ্ছে।" নিরবতা ভাঙলাম আমি।

"হ্যা ভালই আছি। তোমার কি খবর? কেমন চলছে দিনকাল?"

"এইত চলে যাচ্ছে।"

"জাহিদের কাছে শুনলাম তোমার ব্যাপারে। কংগ্রাটস তোমার বেবির জন্য। কেমন আছে দুজনে?"

"হ্যা ওরা ভাল আছে।"

"বাবুর বয়স কত হল?"

"একমাস হয়নি এখনও। তা ড্রইংরুম তো দেখছি নিজের মন মত সাজিয়ে নিয়েছো।"

"হ্যা ওকে যেভাবে বলেছি সেভাবেই ও ব্যবস্থা করেছে। এমনকি বারান্দার গাছগুলোও কোথা থেকে যেন ম্যানেজ করেছে। জানই তো আমার এরকমই পছন্দ। "

কথাটা বলে চুপ হয়ে গেল মীরা। হয়ত আগের কথা মনে পড়ে গেছে। আমিই কথা বললাম, "হ্যা খুবই সুন্দর হয়েছে। ভাল লাগছে দেখতে। জাহিদ সাহেব বেশ সৌভাগ্যবান। "

"কবির... " মীরা কথা শেষ করতে পারল না, জাহিদ সাহেব ঘরে ঢুকলেন।

"কি গপসপ হচ্ছে পুরানো বন্ধুদের? আমি এসে আবার সমস্যা করলাম না তো?" জাহিদ সাহেব হাসতে হাসতে কথা গুলো বললেন।

"আরে কি যে বলেন না ভাই। আসেন বসেন।"

জাহিদ সাহেব আমার পাশের সোফায় এসে ধপ করে বসে পড়লেন। তার পরনে স্ট্রাইপের শার্ট ও পায়জামা। আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আমার দিকে ফিরে বললেন, "আমি নাস্তা দিতে বলেছি। আর রাতে থাকবেন আমাদের বাসায়। না শুনতে পারবো না কিন্তু আগেই বলে দিলাম। জামাকাপড় এর সব ব্যবস্থা আছে। মীরা কি বলো?"

আমি না করতে যাচ্ছিলাম মীরা মাঝপথে থামিয়ে দিলো, "হ্যা অবশ্যই! এতদিন পর এসেছে। হোটেলে না উঠে এখানে থাকলে তো আরও ভাল হবে কি বলো কবির?"

মীরার মুখে নিজের নামটা শুনে কেমন লাগলো যেন। "আরে না না এত ঝামেলা করার কি দরকার আমি অফিসেই চলে যাই। রাতে কিছু কাজ ছিল যে।"

"আরে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি বলে দিচ্ছি। আপনি থাকবেন।"

সেদিন রাতে থেকে যেতে হল আমাকে। বিকেলে নাস্তা করে ওদের সাথে গল্প করলাম। রাতে খাওয়ার পর ছাদে নিয়ে গেল জাহিদ সাহেব। ছাদের উপর গোল টেবিল রয়েছে পরপর। ছোট ছোট নানান রঙের লাইট জ্বালানো। এরকম একটায় গিয়ে বসলাম। কাজের লোক একটা বোতল রেখে গেল। আর দুইটা গ্লাস। জাহিদ সাহেব দুটো গ্লাসে ঢেলে নিলেন,

"এসবে অভ্যাস আছে নাকি?"

"জ্বি না"

"না থাকারই কথা।"

বলেই একটা গ্লাস শেষ করলেন।

"বুঝলেন কবির সাহেব এসবে অভ্যাস করুন। না করলে একসময় আপনার সবকিছু থাকবে কিন্তু মনে হয় কিছুই নেই। ঠিক তখন আপনার সঙ্গী হবে এই জিনিস। ফরেন মাল। ভাল জিনিস। টেস্ট করে দেখতে পারেন।"

আমি হা না কিছুই বললাম না। জাহিদ সাহেব বলতে শুরু করলেন।

"কবির সাহেব দেখেছেনই তো আমার সব আছে। বাড়ি গাড়ি অফিস ব্যবসা টাকা পয়সা সব সব...... কিন্তু মনে শান্তি নাইরে ভাই... কোনই শান্তি নাই।"

আরেক গ্লাস ঢাললেন। আমি বুঝছি না তাকে থামাবো না কি করবো।

"দেখেন ভাই,আমার কোন সন্তান নেই। আমি সব পেয়েছি জীবনে কিন্তু যা দরকার ছিল তা আর হলো না রে ভাই।"
বলেই পরের গ্লাসও শেষ করে ফেললেন।

আমি থামাতে গেলাম। আমাকে তুই তুই করে সরিয়ে দিলো।

"তুই কাছে আসবি না... বলে দিলাম!! আসবি না!!!"

এভাবে যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ যা মনে আসছিল সেটাই বলছিলেন। কার নাম ধরে যেন ডাক দিলেন। দুজন কাজের লোক এসে তাকে ধরলেন। আমিও ধরলাম। ধরাধরি করে বেডরুমে রেখে এলাম। মীরা কিছু বলল না। জাহিদ সাহেবকে শোয়ানোর পর ও কাছে এসে বসল। আমি চলে এলাম। আমার জন্য আলাদা রুম রাখা ছিল। সেখানে চলে এলাম। কিছুই ভাল লাগছিল না। কেমন যেন একটা হাহাকার কাজ করছে মীরার জন্য।

আমার ঘুম আসছিল না। হালকা নীল ডিম লাইটের আলোয় আমি শুয়ে ছিলাম। এমন সময় ফোন আসলো। জাহিদ সাহেবের নম্বর। ফোন রিসিভ করে শুনি মীরা ফোন দিয়েছে।

"জাহিদ সাহেবের কি খবর?"

"উনি ঘুমিয়ে গেছেন। তোমার সাথে কিছু কথা ছিল কবির। তুমি কি আসতে পারবে একটু?" কেমন অনুনয়ের সুরে বললো মীরা।

"ফোনেই কথা বলি। এখন আসাটা আমার মনে হয় ঠিক হবে না।"

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল মীরা।
"দেখো কবির জাহিদ অনেক জেদি। ও যেটা করতে চায় সেটা করবেই। ওকে বারণ করা সম্ভব না। তোমার সাথে যদি সে খারাপ কিছু করে থাকে আমি মাফ চাচ্ছি।"

"আরে না না কি বলো এগুলা।"

"আর ওর অভ্যাসটা আগে ছিল না। গত দুইমাস থেকে এরকম করছে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কবির কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। কোন সন্তানের মুখ দেখতে পারি নি।"

একটু থামলো মীরা। আমার মনে হল মীরা কাঁদছে।

"কবির আমি আসলে জীবনে অনেক বড় ভুল করেছি। আমাকে মাফ করে দিও। ভুলের ফল পেয়ে যাচ্ছি এখনও।"

মীরা কাঁদছে। আমি ওকে কি বলব বুঝলাম না। ভাল লাগছিল না কিছু। কিছুক্ষণ পর ও বললো,
"কবির রাখি, ভাল থেকো।"

সেদিন রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারিনি। পরদিন সকালে খুব ভোরে আমি চলে আসি। জাহিদ সাহেবের ঘুম ভাঙেনি। মীরা অনেকবার বলার পরও থাকলাম না। পরে নাস্তা করতে হলো এবং ড্রাইভার গাড়িতে করে অফিসে পৌছে দিল। জাহিদ সাহেব পরে অনেক রাগ করেছিলেন কিন্তু আর ওই বাসায় যাই নি। এর কিছুদিন পর ঢাকায় ফিরে আসি।



চার
ঢাকায় শান্তা ও আমার ছেলেকে দেখে আমার মন ভাল হয়ে যায়। মগবাজারের বাসায় নিয়ে আসতে চাচ্ছিলাম কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ির চাপে আনতে পারলাম না।

এরপরের দিনগুলো কিভাবে কিভাবে যেন শেষ হয়ে গেল। ছেলেটা বড় হয়ে গেল। শান্তা ওর জবটা ছেড়ে দিল ছেলেকে মানুষ করতে। অনেকবার বলার পরও সে আমার কথা শোনেনি। মা মারা গেলেন। মা মারা যাওয়ার কয়েকদিন মাঝরাতে উঠে মায়ের রুমে বসে শান্তাকে কাঁদতে দেখতাম। মাঝে মাঝে ভুল করে অফিস থেকে ফেরার পথে মায়ের পছন্দের কিছু কিনে নিয়ে বাসায় যাওয়ার পর খেয়াল হত মা নেই। যেই মানুষটা খুব গুরুত্বপূর্ণ,চলে যাওয়ার আগে তার অস্তিত্ব কখনই আমরা টের পাই না।

ছোট ভাইটা বাইরেই বিয়ে করল প্রবাসী বাঙালি। ছেলেটা ভার্সিটির পার্ট শেষ করে প্রাইভেট ফার্মে ঢুকলো। মগবাজার থেকে ধানমন্ডিতে নিয়ে এল আমাদের। আমারও চাকরির বয়স শেষ হয়ে এল। আমার ছেলে ওর মায়ের মতই সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে। নিজের পছন্দেই বিয়ে করলো। কলিগের কাজিন। মেয়েটা খুব মিষ্টি আর চটপটে। মেয়েটার সাথে মাঝে মাঝে মীরার সাথে মিল খুঁজে পাই। মীরার কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। মীরার বাসা থেকে আসার পর ওর সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই। ধীরে ধীরে কিভাবে যেন আমি আর শান্তা বুড়িয়ে গেলাম।

একটা নিয়মের মধ্যে আমাদের প্রতি দিন কাটতে থাকলো। আমাদের দুজনের কাজ এখন সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে বাইরে হাঁটতে বের হওয়া,এসে নাস্তা করে চা হাতে পেপার পড়া, নিউজ দেখা, দুপুরে খাওয়া গোসল বিকালে ছাদে ঘুরোঘুরি করা রাতে শান্তার হিন্দি সিরিয়াল দেখা আর আমার সাথে গল্প করা। এরপর শুয়ে পড়া। ছেলে আর ছেলেবউ দুজনেই খুব ব্যস্ত। আমাদের সময় দেওয়ার সময় নেই। সময় দেওয়ার বা কি দরকার। জীবনে যা ভাবিনি তা এখন আছে আমার। আমি একজন সৌভাগ্যবান পুরুষ। জীবনের এই পর্যন্ত এসে আমার এটাই উপলব্ধি।

যেদিন শান্তা আমাদের ছেড়ে চলে যায় সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সারাদিন। দুপুরের পরই শান্তার খুব বুকে ব্যথা করতে থাকে। সন্ধ্যায় হসপিটালে নিয়ে যাই। ঠিক রাত দশটায় ও মারা যায়। আমার জীবনটা যে এত সুন্দর করে গুছিয়ে তুলেছিল,জীবনটা রঙিন করে সাজিয়েছিল সেই মানুষটা আর নেই। ওকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না। শান্তা যে নেই সেটা এরপর কিছুদিন আমার মনেই হয়নি। মনে হয় ও আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন হাঁটতে বের হতাম মাঝে মাঝে পেছন ফিরতাম হয়ত শান্তাও আসছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পেপারের একটা নিউজ বলার জন্য সারা বাসা খুঁজতাম ওকে। রাতে বিরক্তিকর হিন্দি সিরিয়ালগুলো কেন যেন আর বিরক্ত লাগত না। ঘুমাতে যাওয়ার সময় লাইট নিভানোর জন্য কেউকে খুঁজে না পেয়ে নিজেই বন্ধ করে দিতাম। এই নিয়মে নিজেকে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিলাম। মেনে নিলাম শান্তাকে আর কখনই ফিরে পাব না।

এরপর বাসায় সবকিছুই কেমন যেন অর্থহীন মনে হতে থাকলো। চোখে ছানি পড়ে গিয়েছিল। অপারেশন করলাম। হাত পায়ে কোন কারণ ছাড়াই দিন নেই রাত নেই ব্যথা করত। পেপার পড়তে গেলে মাথা ধরে যেত। ডাক্তার বললেন চিনি কম খেতে, আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়লো।

অর্থহীন জীবন এর আনন্দের দিন ছিল যেদিন আমার নাতনী হল। আমার ছেলে যেদিন হয়েছিল সেদিনের কথা মনে পড়লো। কি আনন্দের দিন না কাটিয়েছি। নাতনীর মুখটা অবিকল শান্তার মত দেখতে। কথাটা বলতেই আমার ছেলে আর ছেলেবউর কি হাসি। এই নাতনীও বড় হল। দুজনে মিলে গল্প করতাম। ছবির বই পড়ে গল্প করতাম দুজন। আমার সাথে তার খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। যদিও মাঝে মাঝে ছেলেবউ এসে আমার সাথে শুধু শুধু রাগ করত। ছেলেটাও কেমন যেন হয়ে গেছে। চাকুরীবাকরির খারাপ অবস্থা চলছে কিনা তাও আমার সাথে সরাসরি বলে না। কিছু হলেই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করত। একটা সময় মনে হলো এই পরিবারের সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় মানুষটা হয়ে গেছি আমি।

পরের ঘটনা গুলো বলার মত কিছু নেই। তবে মীরার সাথে আমার আবার দেখা হবে কখনও ভাবিনি। সময়, যে পরিস্থিতিতে দেখা হয়েছিল সেটা সত্যিই অবাক করার মত। ওর মুখেই শুনেছিলাম ওর জীবনের গল্প। একটা ছেলে দত্তক নিতে হয়েছিল ওদের। সবই ভালই চলছিল। ছেলে বড় হলো,দায়িত্ববান হলো। জাহিদ সাহেব কার এক্সিডেন্ট করলেন। নিজের পুত্রবধূ দেখে যেতে পারেন নি। পরিবারটাকে এত কষ্ট করে গুছিয়ে নিয়ে আসার পর মীরাকেও বাস্তবতার কাছে হার মানতে হলো।

সবকথা বলে মীরা কাঁদতে শুরু করলো। আমি আস্তে করে ওর হাতটা ধরলাম। ও একটু কেঁপে উঠলো। হাত ধরে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,

"তুমি ভুল ছিলে মীরা। আমাদের গন্তব্য কখনও ভিন্ন ছিল না। "

বিকেলের দিকে বৃদ্ধাশ্রমের ভেতরের পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসে থাকা আমাদের কথা কেউ শুনেছিল কিনা জানি না। সুন্দর একটা স্নিগ্ধ বাতাস হচ্ছে। বহুদিনের পুরনো হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে যেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১১:২২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×