এক. একটা গল্প বলি, কোন এক দেশে হঠাৎ চুরি ডাকাতি ছিনতাই বেড়ে গেল। তখন সম্পদশালীরা পড়ল মহাবিপদে। আব্বাস আলি ছিলেন তেমনই এক সম্পদশালী। এদিকে আব্বাস আলির নাওয়া-খাওয়া, ঘুম নেই এই চিন্তায় কিভাবে তার মুল্যবান সম্পদগুলো রক্ষা করবেন। গেলেন তার বিপদের বন্ধু আলীমুল সাহেব এর কাছে পরামর্শ চাইতে। তিনি সুপরামর্শ দিলেন। পরামর্শমত আব্বাস আলি খুব মজবুত করে একখানা বাড়ী করলেন, মোটা মোটা সেগুন কাঠের দরজা-জানালা লাগালেন। ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরাও বসালেন। একেবারে নিছিদ্র নিরাপত্তা। তার সমুদয় মুল্যবান সম্পদ বাড়ীর ভিতরে এনে রাখলেন। কিন্তু হায়, ঐ রাতেই আব্বাস আলির সমস্ত সম্পদ চুরি হয়ে গেল। চোরব্যাটা সামান্য পাই-পয়সাটাও রেখে গেলনা। বলে রাখি, আব্বাস আলি সম্পদশালী হলেও ছিলেন নিরেট বোকা। বাড়ীর সকল গেট-দরজা বন্ধ করে 'সদর দরজা' না লাগিয়েই তিনি ঘুমাচ্ছিলেন।
এখন আব্বাস আলির হায় হায় করা ছাড়া আর কোন উপায় রইলো না।
দুই. পর্দা, হিজাব, নিকাব, সতর ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। পাশ্চাত্যের তীব্র সমালোচনায় মুসলমানদের অভ্যন্তরে এপোলোজেটিক(দোষ স্বীকার সূচক) ব্যাখ্যাদাতাদের উদ্ভব হয়। আধুনিক বিশ্বে মুসলিম পন্ডিতদের জ্ঞানের অগভীরতাই এই ‘এপোলজি’ এর জন্য দায়ী। তারা সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে মুসলিম নারীদের বিভ্রান্ত করেছেন। আসুন দেখি সেখানে কি বলা হয়েছে-
সূরা নূরের ৩১নং আয়াতের প্রথম বাক্যাংশে বলা হয়েছে-“লা ইউবদীনা যীনাতাহুন্না” অর্থ্যা- মহিলারা যেন নিজেদের সাজ-সজ্জা ও যীনত(সৌন্দর্য্য) প্রকাশ না করে। আর দ্বিতীয় বাক্যাংশে ‘ইল্লা’ শব্দটি বলে এ নিষেধাজ্ঞায় যে সব জিনিসকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছে, তা হচ্ছে-“মা যহারা মিনহা” অর্থ্যাৎ যা কিছু আপনাআপনি প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এখানে “যা কিছু আপনাআপনি প্রকাশিত হয়ে পড়ে” বলতে এপোলোজেটিক পন্ডিতরা হাত ও পায়ের কব্জি, তালু এবং মুখমন্ডলের কথা বলেছেন। আসুন দেখি স্বর্ণযুগের মণিষীরা কী বলেছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হাসান বসরী, ইবনে সীরীন, ঈবরাহীম নাখঈ প্রমুখ, “যা কিছু আপনাআপনি প্রকাশিত হয়ে পড়ে”- এর ব্যাখ্যা করেছেন, মহিলারা সেচ্ছায় এগুলো পুরুষের সামনে প্রকাশ করতে চাইবেনা কিন্তু যদি অপরাগ অবস্থায় প্রয়োজনবশত তাদের বাইরে যেতে হয় তাহলে যা কোনক্রমেই লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়না যেমন তার শরীরে জড়ানো চাদরটি বা পোষাকটি, তার দেহের গড়ন-আকৃতি (লম্বা না বেটে, মোটা না চিকন), তার চলার ভঙ্গি। এগুলোও কোন বিকারগ্রস্থ পুরুষের মনে কুধারনা সৃষ্টি করতে পারে তবে এর কারনে ঐ অপরাগ নারীদের কোন গোনাহ হবেনা যদি তারা প্রথম শর্ত মেনে চলে অর্থ্যাৎ নিজেদের সাজ-সজ্জা ও যীনত(সৌন্দর্য্য)কে পরপুরুষ হতে গোপন রাখে।
এখানে বলে রাখি, নারীদের যীনত বা সৌন্দর্য্যের মূল কেন্দ্র কিন্তু তাদের চেহারা বা মুখমন্ডল।
তিন. এপোলোজেটিক পন্ডিতরা সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতের দ্বিতীয় বাক্যাংশের একটি সুবিধাজনক ব্যাখ্যা দিলেও সুরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াত এড়িয়ে চলেন। কেন জানেন? কারন তাদের সব গবেষণা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শেষ হয়ে যায় এই আয়াত দ্বারা। দেখুন- “হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও মুসলিম নারীদের বলে দিন – তারা যেন আপন চাদরের কিয়দংশ নিজেদের চেহারার উপর টেনে দেয়। এর দ্বারা আশা করা যায় তাদের চিনতে পারা সহজ হবে(সম্ভ্রান্ত মহিলা হিসেবে) এবং তাদেরকে উত্যক্ত করা হবেনা।”-সুরা আহযাব, আয়াত: ৫৯।
ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ও হাদীসের দ্বারা প্রমাণিত, নববী যুগে হিজাবের হুকুম এসে যাওয়ার পর মহিলারা মুখ খুলে চলতেন না, হিজাবের হুকুমের মধ্যে চেহারার পর্দাও শামিল ছিল এবং ইহরাম ছাড়া অন্যান্য সব অবস্থায় নিকাবকে মহিলাদের পোষাকের একটি অংশে পরিণত করা হয়েছিল।
প্রধান চার মাজহাবের ইমামগণের মতামতসহ সকল নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থ যেমন তাফসীরে ইবনে জারীর, তাফসীরে কাবীর, তাফসীরে বায়যাবী, তাফসীরে ইবনে কাছির, তাফসীরে মা’আরেফুল কোরআন সহ অসংখ্য ইসলামী আইনশাস্ত্রে মহিলাদের মুখমন্ডল বা চেহারার পর্দাকে আবশ্যক বলা হয়েছে।
চার. যে জিনিস যত বেশী মুল্যবান তাকে তত লুকিয়ে বা গোপন করে রাখাই যুক্তিযুক্ত। নারীদের ইজ্জত-সম্মানের যে মুল্য তাকে সুরক্ষিত ও সর্ব্বোচ্চ সতর্কাবস্তায় রাখার নিমিত্ত পর্দার বিধান। কেউই অস্বীকার করবে না, কোন ব্যক্তিকে অপরের যে বস্তুটি সর্বাপেক্ষা অধিক আকৃষ্ট করে, তা হচ্ছে তার মুখাবায়ব। আর নারীদের সৌন্দর্য্যের ‘সদর দরজা’ এটাই। তাই সারা শরীর পর্দা করে মুখাবায়ব খোলা রাখা যুক্তিবিবর্জিত বিষয়ও বটে।
আমার বোনেরা, আব্বাস আলির মত আপনারাও সকল গেট-দরজা বন্ধ করে ‘সদর দরজা’ খুলে ঘুমাচ্ছেন নাতো!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৮:৫৫