“আলিফ, লাম, মীম....... তিনি আদম, নূহ এবং ইব্রাহিম ও ইমরানের বংশধরদের মনোনীত করলেন, যিনি আল্লাহ......।”
তিনি ইমরানের স্ত্রী নন, ইমরানের মহিলা মানে ইমরানের বংশধরদের কোন একজন, এক পবিত্রতম রমণী, সফেদ অন্তরাত্মা - হেনা দোয়া করলেন, কেউ বলে এটাই তাঁর নাম ছিল, “হে আমার প্রতিপালক.. ..।” তিনি নিজের জরায়ুকে বড় হতে দেখলেন; ধীরে ধীরে, নিষিক্ত ডিম্বানু থেকে পরিপূর্ণ প্রাণী, তারপর মানব কিংবা মানবী। তিনি ছিলেন ছেলে হওয়ার সপে কেননা এছেলে তাঁর নিজের জন্য ছিল না। কারণ তিনি নিদর্শন পেয়ে গেলেন একটা পরিপক্কশীল সন্তানের; এক মহান আলোকবর্তিকা, পথ প্রদর্শক পূর্ণাত্মাসমূহের। সম্ভবত ছেলে- তিনি ধারণা করলেন।
শাফিয়া ভাবে হেনার কথা - গাঁয়ের লোকে ডাকে শেফু - তলপেটে হাত বুলায়। নিষিক্ত ডিম্বানু বর্ধনশীল, সাত মাস। পিতৃহীন, পিতা ছিল প্রয়াত। রুগ্ন কাষ্ঠল কাঠামোতে ভর করে পেট ঝুলে আছে যেন ফুটবল বড় হচ্ছে অদৃশ্য ধীরলয়ে। অনবরত শোষনে সংকুচিত শরীর, জীর্ণ; যেহেতু কাঁচামাল গ্রহণে অনিহা, খাদ্যে অরুচি তবুও শিশুটি নিজের অংশ গ্রহণ করেই চলছে। কখনো কখনো অংশে কম হলে বিদ্রোহ করতে চায়। শেফু তলপেট চেপে ধরে বসে থাকে, তখন গৃহকত্রীর কথার ঝালরে কান ছিঁড়ে। রোজ রোজ সাবানের সাথে কালা ছাই মিশেয়ে তাকে ঠাণ্ডা পানিতে হাঁড়ির কালি দূর করতে হয়।
সম্ভবত হেনা ছিলেন ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত-সম্ভ্রান্ত। তাঁর চুলা আগুনের অভাবে ভেঙ্গে পড়েনি যেমন শেফুর হয়ে থাকে। তিনি সম্ভ্রান্ত হয়ে থাকবেন কেননা তিনি ছিলেন মনোনীত। মনোনীত ব্যক্তিগণ বুদ্ধিমান, কখনো হা-ভাতে শুদ্রের ঘরে জন্ম নেননি এবং অসম্ভবও বটে। একসময় মাতৃত্বে অপূর্ণ স্বীকৃতি তাকে আহত করত। ভিজে যেতেন নিজেরই চোখনিসৃত ধারায়।
পূর্ণতরো যৌবনের ডাকে এসেছিল বসন্ত পরিপূর্ণ স্বচ্ছলতায়। অদূরে সাড়া দিয়ে উঠেছিল একটি কোকিল অফুরন্ত পৌরুষে। সবুজ দিয়েছিল সায়, দিয়েছিল স্বীকৃতি। মিলন পুলকে জেগে উঠেছিল পুষ্পসমারোহ, বর্ণীল স্বপ্ন ও পবিত্রতম মেশকেআম্বর। রাতের জোনাকির মত দুলে ওঠে আলোকবর্তিকা, মৃদুমৃদু ঝংকারে জ্বলে ওঠে স্বপ্ন, আবার স্বল্পদৈর্ঘ্য অন্ধকার। পৌনঃপুনিক আশা, স্বপ্ন, হতাশা, বাস্তবতা। নীড় কেঁদে ফেরে অস্থির, কখনো স্থির ।
হেনা কাঁদতেন নীরব রাতের অনুজ্জ্বল চন্দ্রালোকে, আকাশের দিকে চেয়ে, প্রর্থনার ভারে ন্যূব্জ - নীড় কেন ভরে না জন্ম নেয়ার প্রথম ক্রন্দন পুলকে। বিদ্যুৎচমকে আকাশ ঝলসে উঠলে ভাবতেন ওই বুঝি ডাক এল নূরে এলাহীর তরফ থেকে। তাঁরা সচেতন ছিলেন। ছিলেন নবীর বংশ। কেউ কেউ বলেন, তিনি নবী হারুনের বংশধারা থেকে উৎসারিত। ফলত তাঁরা ধৈর্য্যের পরাকাষ্ঠায় ব্যপীত হতেন আর নীরব মধ্যযামিনীর নূরালোকে দণ্ডায়মান থাকতেন আর এগিয়ে যেতেন পরম উৎসের দিকে। সত্য ছিল এরকম: “কে আছো? আলোর গতি ধারণ কর আমাদের দিকে, কেননা তাহলে আমরা তোমাদের নিকটবর্তী হব, তোমাদের ধমনিতন্ত্রের চেয়েও নিকটতর।”
শেফু দৌড়াতে পারে না কেননা পঙ্গুত্বে অবসাদগ্রস্থ স্বামীকে তার খাওয়তে হয়। এগাঁ সেগাঁ, এবাড়ি সেবাড়ি ঝি-এর কাজ; সন্ধায় আধাসের চাল, দু’একটা টাকা আর কিছু পরিত্যাক্ত তরকারীসহ একগাদা নোংরা কথার গল্প ঘাড়ে নিয়ে স্বামীর পদতলে ফিরে আসা। পীর সাহেব বলেন, পরহেজগার রমণীর জন্য স্বামীই সব। অপরিহার্য ও অপসোনাল জৈবিক কাজটুকু হয়ে গেলে নিমিশে রাত্রি ভোর হয়ে যায়। শেফু তার নিজের গর্ভ টের পায় যখন সে ও তার স্বামী খুবই কান্ত। তার তিন মাসের ওয়াক ওয়াক না থামতেই স্বামীটা চলে যায় অনন্তে।
সময় সময়ের গর্ভে জন্মাতে জন্মাতেই একদিন হেনার ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে গেল। হেনা তখন সান্তনা দিলেন নিজেকে - মানুষ শুধু কেবল চাইতে পারে এবং তিনি ধরে নিলেন একজন বন্ধা রমণী নিজেকে। সুতরাং প্রার্থনার জায়নামাজ পূর্বতরো বলবত থাকল বরং আরো নিঃসঙ্গ হল। তবুও একসময় বার্ধক্যে উপনীত হেনা পেয়ে গেলেন আসমানী আয়াত; উজ্জ্বল নূরানী নূর। তখন তিনি দোয়া করলেন, “হে আমার প্রতিপালক, তুমি একে গ্রহণ কর। আমি একে তোমার ঘরের সেবায় দান করলাম।”
এমতাবস্থায় শেফু ভাবে, “হায় খোদা, তুমি কেন ওরে বিশ বছর আগে দিলা না?” পীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে সে অপো করে জন্ম নেয়ার প্রথম আনন্দ ক্রন্দনের জন্য। তবুও সে নিশ্চিন্ত। পীর বাড়ির মাদ্রাসা-এতিমখানা থাকতে তার আর চিন্তা কি?
নির্গমনের বেদনা প্রশমিত হলে হেনা জন্ম নেয়ার প্রথম কান্না শুনতে পেলেন। বাঁদিরা নবজাতককে পরিষ্কার কাপড় জড়িয়ে তাঁর হাতে দিলে তিনি দেখলেন, হায়! এতো মেয়ে সন্তান! “হে প্রতিপালক আমি তো তোমাকে একটা ছেলে নজরানা দিতে চেয়েছিলাম।” তিনি শুনতে পেলেন, “(তো হয়েছে কি?) আমি একেই গ্রহণ করলাম, কারণ আমি জানি আদ্যপান্ত।” আলোক পুলকে চারদিক ছেয়ে গেল সেই সময়।
যখন শেফুর সন্তান পৃথিবীর আলোকে চোখ মেলে, পৃথিবী হাসেনি, হয়তো সেদিন জোনাকিরা স্তব্ধতায় বিরাজ করে থাকবে কিংবা রাত্রি বিলম্বে ছিল ভোর হতে আর অপ্রত্যাশিত অশ্র“ মুছে নেয় নতুন পীর দম্পতি। শিশু কান্নার সাথে ঐকতানে বেজে ওঠে মৃত্যু নিসৃত কান্না। পীর দম্পতি কোলে তুলে নেন নবজাতককে। লায়লা বেড়ে ওঠে অতি আদর যতেœ মরিয়মের মত পবিত্রতম ধর্মীয় পরিবেশে। কেউ জানতে পারেনি খোদা তাকে গ্রহণ করেছেন কিনা।
পূর্ব প্রতিশ্র“তি মোতাবেক মরিয়ম মসজিদে আনিত হলে তার জন্য অবিভাবকের প্রয়োজন হল। খাদেমগণ এগিয়ে এলেন যেহেতু সবাই পূণ্য কাজের অধিকারী হতে চান। মরিয়ম ছিলেন কিশোরী; অপ্রাপ্ত বয়ষ্কা। পূর্ণ দলে বিস্তারিত হতে একজন সাহায্যকারী কে হবেন? একজন স্বইচ্ছায় নিয়ে গেলেই তো হয় না। যেহেতু দাবী করার অধিকার ছিল সবার। সুতরাং ... ... লটারিতে জাকারিয়ার নাম প্রস্তাবিত হল।
গৃহিনী বললেন, আমরাই একে পালন করি, পালন করি তাঁর নামে যিনি আমাদের দান করেছেন। আর এটিই হবে আমাদের সন্তান। এ তাঁরই অনুগ্রহ যিনি আমার গর্ভে কোন শিশু জন্মাতে দেননি। তাহলে আমাদের কেউ কারো ওপর অভিযোগ চাপানোর প্রয়োজন হবে না, হয়তো এতে আছে কোন কল্যাণ। গৃহিনী নন্দিত হলেন গৃহস্বামী কর্তৃক। তিনি তাঁকে কন্যার মত আপন করে নেন।
বতাস বইতে থাকে দণি দিক হতে, আর্দ্র, সুশীতল, সর্বদাই বসন্তের আরম্ভ। লায়লা; রহস্যময় রাত্রির অন্ধকার, প্রতিভাত হয় দিনের আলোকে প্রস্ফুটিত গোলাপ। তবুও ঝাপসা যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে পারিপার্শ্বিকের। কেননা চিন্তায় নিমগ্ন প্রতিনিয়ত। সন্দেহের উর্ধ্বলোকে কোন অপ্রমাণিত সংশয়ে ভেসে বেড়ায়। লোকে বলে সাদা কাগজ, এখনো, লেখেনি নিজের নামটা পর্যন্ত। তারপরও কি প্রশ্ন ওঠে না? কেউ কেউ তো জানে অতীত এক নিুগামী বাস্তবতা কিন্তু মুখে কিছুই ফোটে না কিংবা বের হবার আগেই ভয়জাত ঘর্ষণে জ্বলে পুড়ে ছাই। বিশেষত পাষাণের হৃদয়ও কাঁপে, ধর্মীয় ধাঁচে গড়া যে। পীর সাহেব যে একজন খাঁটি দাসানু-দাস আল্লাহ মালিকের। জাগ্রত সময়ের অধিকাংশ কেটে যায় নিজের কামরায় পুস্তকাদির আড্ডায়। পরিবেশের বদৌলতে সে চরে বেড়ায় আসমানী বানীর চরাচরে, আনন্দ-অতৃপ্ত চিত্তে খুঁজে ফেরে কোন নিগূঢ় রহস্য, অর ও বস্তু নিসর্গের পাতান্তরে। গৃহস্বামী দেখেন আর হাসেন পরিতৃপ্তির হাসি।
তিনি ভাবেন এতো তার ঔরসজাত নয়! তিনি বার বার সুরা-নিসা খুঁজে ফেরেন। আহা! তার স্ত্রী যদি এমন জ্ঞানতাপস হতো! “আহা আমার বিবি যদি এমেয়ের মা হত! আল্লাহ তুমি কি আমাকে একটা সন্তান উপহার দিতে পারো না? কিংবা তুমি বলে দাও আমি কি একে.. .. তিনি হেসে ওঠেন মৃদুভাবে।”
লায়লা যেমন যামিনির ভিতর অবরুদ্ধ হয়ে যায়, না, সে নিজেই অবরুদ্ধ হয়ে যায় একটা স্বনির্ধারিত আবর্তনের ভিতরে - পীর বাড়ির মেয়েদের কেউ কখনো দেখতে পায় না - মরিয়ম তেমনি অবরুদ্ধ হলেন হাইকেলের মেহরাবে। আসলে তিনি অবরুদ্ধ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সকল বন্ধনের উর্ধ্বে, দেহকে অতিক্রম করে নূরানী আলোর ভিতর যা ইট-সুরকির দেয়াল ভেদ করত। পরিমিত আতঙ্কের মধ্যে তিনি আত্মসমর্পিত ছিলেন। পরমাত্মার অভ্যন্তর হতে উৎসারিত আতঙ্ক প্রণয়ের ভিতরে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল, সুতরাং তিনি একজনকে ভালবাসতে পেরেছিলেন। তাঁর সাথেই তিনি সংগোপনে একত্রিত হতেন, মিশে যেতেন। কেননা তিনি ছিলেন পূর্ণাত্মা আর পূর্ণাত্মারাই সত্যিকারের অতিদৈহিক প্রণয়ে আবদ্ধ হতে পারেন।
প্রদত্ত জীবনের হক আদায়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন মরিয়ম। তার জন্য নির্ধারিত হল মেহরাব, হাইকেলের এক কোণে। তিনি বিমূর্ত হলেন তার পরম উৎসের সন্ধানে, মশগুল থাকেন বিনীত অবয়বে প্রতিপালকের সামনে আর তখন তিনি শুনতে পেলেন, “আমি তোমার গর্ভকে সমুন্নত করেছি এবং মনোনীত করেছি সমস্ত রমণীকুলের মধ্য হতে। সুতরাং প্রশংসা জ্ঞাপন কর যামিনীর শেষাংশে।”
জাকারিয়া বাহির দিয়ে তালা দিয়ে যেতেন যদি তার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হতো। আত্মভোলা মন নীড়ের কথা প্রায়ই মনে থাকে না। চলে গেলেন অনেক দূরে হয়তোবা কোন জরুরী প্রয়োজনে। একদিন, দু’দিন, তিনদিন। কাজের ভিতর সময় প্রবেশ করে। মানুষ সময়ের বিপরীতমুখি। একে অপরের ভিতর সদা বিলায়মান। টের পাওয়া যায় না পাগলা ঘোড়ার গতির হিসাব। মনে পড়ে মেহরাবে তিনদিন খাদ্য পৌঁছেনি। প্রয়োজনীয় সবকিছু সংকুচিত হয় নিমিষে।
অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে থরথর। ছুটতে থাকেন খাবার নিয়ে বন্দীনীর দিকে। “একি এখানে যে এত খাবার!!” নিমগ্ন মরিয়ম, অবনত মস্তক প্রতিপালকের পায়ের তলে।
“তাঁর কাছ থেকে এসেছে যিনি অসীম। চাইলেই তিনি অসীম দান করতে পারেন” বললেন মরিয়ম।
“হে প্রতিপালক, আমার ঔরষে কি এমন পূর্ণাত্মা বিকশিত হতে পারে না? অথচ তুমি পরাক্রমশালী।”
“আমি তোমাকেও মনোনীত করলাম, অপো কর, ধৈর্য্যধারণ কর এবং প্রশংসা জ্ঞাপন কর।” তিনি আসমানী বানী শুনলেন।
“কিন্তু আমার স্ত্রীর জরায়ুতো সক্রিয় নয়। এবং আমরা দিন গুনছি অনন্তের অপোয়, কেননা আমরা আমাদের সময়ের শেষ প্রান্তে।”
“আমি বলি হয়ে যাও, অমনি হয়ে যায়।”
আকাশের চাঁদ পূর্ণ যৌবন পেলে তারাগুলি নিস্তেজ হল। অমানিষা দুধের মত সাদা হল। বয়ঃপ্রাপ্ত ফুলের দলমণ্ডল বিস্তারিত হয়ে অপার সৌকর্যে প্রস্ফুটিত হল। এখন যেন শুধু পরাগরেণুর অপো। সুবাসে সৌরভে দূরদূরান্তের বতাস সুরভিত হল। পবিত্রতম বাগানে প্রস্ফুটিত কামিনীর প্রশংসায় প্রজাপতি পঞ্চমুখ। আর তিনি পরিবেষ্টিত থাকলেন সবসময় দেহরীদের দ্বারা, যারা আলোক থেকে তৈরী। সুতরাং তিনি মুক্ত থাকলেন সকল প্রকার কুদৃষ্টি হতে। তিনি লায়লার মত মিশে যেতেন লাইলী আঁধারের সাথে আর সেখানে আলোকের সাথে পরিচিত হতেন।
পীর সাহেব কখনো মধ্যরাতে দেখতে পান লায়লা নেই। তিনি খোঁজেন এদিক ওদিক। নেই, কেথাও নেই। দানা বাঁধতে চায় সাপের বিষ ভিতরে ভিতরে, আবার পরিষ্কার হয় সফেদ আকাশ। তিনি সবসময় পরাজিত লায়লার নিকট, তার ভিতর থেকে উৎসারিত আলোর নিকট, আসমানী নূরের নিকট। সুতরাং নিসঙ্ক চিত্তে খোঁজেন লায়লাকে উঠানে অন্ধকারের ভিতর। লায়লা মিশে আছে আঁধারের সাথে একাত্ম হয়ে। অন্ধকার নিজেই লায়লার অঙ্গ। কে জানে রাত্রি থেকে অন্ধকারের উদ্ভব, না অন্ধকার থেকে রাত্রির। লায়লা রাত্রি হয়ে অন্ধকার আর আলোককে আবিষ্কার করতে চায়। আকাশের আলোকবিন্দগুলো পেরিয়ে উর্ধ্বলোকে উঠে যায় অন্তর্দৃষ্টি। তারপরে কি? পূর্ণতা না আকাশ? এরপর এবং তারপর সাত আকাশ এবং তারপর? চিন্তা মর্তে ফেরে না। শূন্যতার সাথে মিশে যায়। না, কোন কিছুইতো শূন্য নয়। শূন্যতো বুকের ভিতর। কিন্তু কি সে শূন্যতা? কি নেই তার? নেই তার অতীত, নেই তার ভবিষ্যত, আছে শুধু বর্তমান। মুহূর্তের বর্তমান, আলোর গতির সমান দ্রুততা থেকে হতাশার উদ্ভব, কেননা চিন্তার ত্রে সমগ্র আকাশ। পীর সাহেব ফিরে আসেন। কি মতা আছে তার লায়লাকে সন্দেহ করার, যেখানে রাতের আবর্তন বিশাল পরিধি জুড়ে। আসলে রাতই দিনকে ভাল চিনতে পারে।
প্রতিবার পবিত্রতার দ্বারপ্রান্তে এলে মরিয়ম যেতেন কুয়োর পাড়ে। পবিত্র হতেন তিনি। তারপর আবার মেহরাব। হঠাৎ তাঁর সামনে অপরূপ যৌবনের জীবন্ত ভাষ্কর্য্য। অতিসন্নিকটে পুরুষের চোখে চোখ লেগে যাওয়ার প্রথম অপরিচিত শিহরণে উদ্বেলিত মরিয়ম। ভয়জাত কম্পনে কেঁপে ওঠেন তিনি।
“তাঁর কসম, আল্লাহকে স্মরণ করুন এবং তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করুন।”
“আমি রূহ। আমি তাঁরই আশ্রয়ে সমর্পিত। তাঁর প থেকেই আমার আগমন। সুসংবাদ গ্রহণ করুন, যে আপনার গর্ভে অবস্থান নিয়েছে। তিনি হবেন আল্লাহর আয়াত ধারণকারী এবং সত্যায়নকারী তার অগ্রগামী ও অনুগামীদের।”
“হায়! আমাকে তো কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি!”
“তিনি আপনাকে এবং আপনার সন্তানকে সমুন্নত করেছেন সকল অপবিত্রতা হতে.. .. কেননা তিনি পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ।”
মরিয়ম অবরুদ্ধ হলেন পুনরায় মেহরাবে, যেমন অবরুদ্ধ হয় লায়লা। কেননা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত লায়লার পেট চক্ষুগোচর হয় লোকালয়ের। এ যেন এক কিংবদন্তি। গাঁয়ের ভিতর নানা কথার ঝড় ওঠে, যেন সবাই জানে আদ্যপান্ত। “সবশেষে পীর বাড়ির মেয়েও.. .. । শেষ পর্যন্ত পীরসাহেবই.. ..।” পীরসাহেব আজকাল মসজিদে নামাজ পড়তে যান না। তিনি বিশ্বাসের পাল্লায় মাপেন মরিয়মের কথা। আহা! তাকে যদি কেউ সব রহস্য বলে দিত! মানুষের কি দোষ। গর্ভধারনের সকল উপসর্গই প্রকাশিত সবার চোখে। হেকিম সাহেব দেখেন, ঔষধ দেন, তিনি ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক হেকিম। দশ গ্রাম তাঁর নামে উজ্জ্বল। অথচ এখানে তার ব্যর্থতা।
এমনই এক পরিস্থিতিতে মরিয়ম দোয়া করলেন, “রাকারী, তুমিই বলে দাও আমি এখন কি করব।”
“ কেউ জিজ্ঞেস করলে বল, আমি এখন রোজাদার।”
মরিয়ম রাত্রির ভিতর লায়লার মত ধৈর্য ধারণ করলেন এবং অপোয় থাকলেন পরিনতির। মরিয়ম মেহরাব ছেড়ে পালিয়ে গেলেন লোক চুর অন্তরালে। তিনি তাঁর প্রতিপালকের দায়িত্বে সমর্পিত হলেন। খেজুর বৃরে নীচে তার নির্গম বেদনার সূচনা হল।
প্রচণ্ড ব্যথায় লায়লা কাতরাতে থাকলে প্রথমবারের মত পীর বাড়ির মেয়ে শহরের হাসপাতালে আশ্রয় নেয়।
এরপর নিকটবর্তি একটা দিনে সূর্য অন্ধকার ভেদ করে উঠলে শিশু মসিহ ঈসা তার মায়ের পবিত্রতা ঘোষনা করল আর একটা রক্তিম মাংসপিণ্ড চাক্ষুস দেখিয়ে দেয়, লায়লা পবিত্রতম, পবিত্রতার প্রতিক।