প্রস্ফুটিত শব্দমালা বোধের পুষ্টিতে জীর্ণ যেখানে বাস্তবতা বিজারক
১. জান নাই কাঠের কঠিন চেয়ারে বসি ঘন্টা ধরি ‘রিডিং ফর প্লিজার’, দ্বিপদী উপপাদ্য আর ইন্ট্রিগ্যাল ক্যালকুলাস বুঝাতে বুঝাতে সাইন্স ফেকাল্টের সিঁড়ি ভাংতে ভাংতে দিন যায়, সপ্তা যায়, মাস যায় - বছর ফুরায় না, আঠার মাসে বছর আরকি, না আরও বেশী। আচমকা একদিন ভার্সিটিচত্তরে ঠা-ঠ-দ্রিম-দ্রিম আর চোখে ভিজা রুমাল চাপি ধরি দৌড়াদৌড়ি, শেষমেষ হলের দুয়ারে তালা আর কর্তৃপরে নুটিশ: পূনর্বিজ্ঞপ্তি না দেয়া পর্যন্তভার্সিটি বন্ধ, অমুক তারিখের মধ্যে সবাইকে হল ছাড়তে হবে।
২. লোহা লক্কড়ের যন্ত্র-গতিময়তা শেষ করি ভুতুড়ে গা শিরশির করা আন্ধারের পেটের ভিতর দি একটানা আধাঘন্টা একঘুয়েমী হাঁটা হাঁটি ঘরের দুয়ারে যাই দেখে সব নিস্তব্ধ।
মা মা, দুয়ার খোলেন।
ঘুম জড়ানো চোখে, কে? উত্তর দরকার নাই, সময় কই, খটখট দুয়ার খোলনের শব্দ। কুপিটা উঁচা করি, এত রাইত করি? কেমন আছত? কোন সময় হত দিছত? .....? আদর-আহাদ-উৎকণ্ঠার শব্দগুলি তরতর করি বাইর অই আসে কণ্ঠনালীর ভিতর দি।
বালা আছি, হাঁনজের বাস উটছি।
ছেলের আগমনে মা দেটটা বছর পর ব্যাস্তসমস্ত অই কুপি হাতে ছুটাছুটি করেন। প্রতিক; নিজের দেয়া নাম, মা-বাপের দেয়া নাম আসগর আলী, মাকে খুব মনোযোগ দি দেখে। ছোডকালের কতা মনে পড়ে: লাল গাইটা যখন দশম বারের মত গাভীন অয় তার হাড্ডি গুলি গণন যাইত, শাখা-প্রশাখা কাষ্টল শুকনা গাছের মতন। চোখের কোনা দুইটা ক্ষত অনবরত পানি ঝইরত আর পেটটা ঝুলি থাকত একটা কাপড়ের গাট্টির মতন। তার ফুসফুসে বাতাস ঢুকত একশ বছরের লোঞ্জা (অচল) বুড়া মাইনষের মতন শোঁশোঁ শব্দ করি। সে জবর কাটত আর অনবরত ধুকত আর মুক দি ফেনা বাইর অইত। শেষমেষ বিয়াইবার সময় চইদ্দ বছরের গোলামীর থন রেহাই পাইল আর বাছুরের চাইর তৃতীয়াংশ তার পেটের ভিতরেই রই গেল। প্রতিকের ছয় বছর যখন তখন সেইটাই ছিল শেষ গাই।
৩. মা ছেলের আসনের খবরটা বাবার কানে পোছাই দিলেন। বাবা অনড় যদিও তার কান দুইটা খোলা। জায়নামাজে বসি আছেন গাছের গুড়ির মতন, ডাইন হাতে তসবিমালা আবর্তিত অয় - একটা ঘড়ি; সেকেন্ডে সেকেন্ডে একটা একটা করি দানা বাইর অই আসে তিন আঙ্গুলের আগার ফাঁক দি আর হৃদস্পন্দনের সমান তালে জিকির; আল্লাতু আল্লাহু নিশ্বাসের সাথে বতাসে মিশি যায়। এ ছাড়া তার আর কি করনের আছে। সবইতো আল্লা তালার লীলা খেলা, বুঝা বড় ভার।
গাইগুলি মরি গেল, মরি গেল তাদের বিয়ানো বাছুরগুলি। চাকরিটাও চলি গেল শেষ মেষ ডোঁড়া সাপের লেজ গুটানোর মত করি কাঁচামালের ব্যবসাটাও গুটাই গেল। প্রতিকের বাবার সবই গেল। তাই তার আর কিইবা করার আছে? তাইবা কেন? তিনি এখ্খনো দুইটা কাম নিয়মিত করেন: ফরজকাম; যার জন্য খোদাতায়ালা নারী পুরুষ পয়দা করেছেন। (শুধু পুরুষের জন্য নাকি নারী) দুনিয়ায় খোদার বান্দার আবাদ করার জন্যÑ নারী গন তোমাদের জন্য ভূমি স্বরূপ। আর অন্য কামডা: আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি শুধু কেবল আমার এবাদত করার জন্য- এর দাবী কড়ায় গণ্ডায় আদায় করন।
বাবাÑ প্রতিকের জন্মদাতা, সব বাবাদের পহেলা কাম অইল একটা ডিম্বানুর পিছে পিছে লাখ লাখ শুক্রানুকে লেলিয়ে দেওন, তার মায়ের তিন মাসের লণ দেখি খুশি অইলেন, সাতমাসের পেট দেখি নিশ্চিত অইলেন আর ডগমগ অই খুশিতে কইলেন, তুই খুব উর্বর, দেইক্ক এইবার আঙ্গো হুত অইব। আর আঁতুড় ঘরে প্রতিককে কোলে লই হাসিতে পেট ফুলাই নাকি কইলেন, হুইনছ, আঁর হুত বড় আলেম অইব, আঁরতোনো বড় আলেম। সবই এক সময়ের কতা।
মাথার সামনে পাতলা চামড়ার নিচে কচি হাড্ডির উপর, চোখে দেখা যায় না, লেখা থাকে ‘কপালে থাকলে খন্ডায় কে’। আদি পিতার ডাইন হাতের সব সন্তানের অদৃষ্টে খোদা তায়ালা লিখি দিছিলেন আদিঅন্তÑ প্রতিকের বাবা তা পড়তে পারেন নি। তোমরা চাইলে আমি তোমাদের ভাগ্যকে পরিবর্তন করিÑ ওয়াদা অইলেও প্রতিকের বাবার প্রার্থনা বাক্য আরশে আযিমায় পৌঁছায় নাই কিংবা পৌঁছাইলেও মঞ্জুর করা হয় নাই। তাই বাবার অযুত নিযুত অভিশাপ আর চারআইঙ্গুল্লা নিজের কপাল লই দেশের সবচে উচা বিদ্যাপিঠে গিয়া পড়ল। সুতরাং প্রতিকের বাবা জায়নামাজ গুটাই নিয়া কোন কতা না বলি বিছানায় যাই ঘুমাই গেলেন।
৪. মা মোড়ায় বসি প্রতিককে ভাত বাড়ি দেন। সামনে পিঁড়ি থাকলেও মা তাতে বসেন নাই। রসুই ঘর থনে মোড়া আনি বসেন। প্রতিক তার মায়ের কাষ্টল দেহে খেরের গাদার মতন উঁচা হওয়া পেটটা দেখে। প্রতিক নিশ্চিত করি কইতে পারব, দশের কোটা পুরণের জন্য তাদের সহদর নয়মাসে পদার্পণ করেছে। মা এই বোঝা দিব্যি বই বেড়ান, আর অনায়াসে গতরখাটি চলেন, আল্লার মাল আল্লায় দিছে যদিও স্বামীর সম্পদ, কার এখানে হাত দেওনের অধিকার আছে? মা অখুশি নন বাবাতো ননই। সবটাইতো পোলা, মাইয়াতো আর একটাও নাই যে খাওয়াই দাওয়াই বড় করি টাকা-পয়সা দি অন্যের ঘরে দিয়া দিতে অইব। অবশ্য বড়টা মাইয়াই ছিল অনেক আগেই, পনের বছর আগে তার তের বছর বয়স ছিল যখন তখন একজন আলেম জামাইর ঘরে উডাই দিছে। আল্লায় দিলে হেই ঘরে পাঁচ নাতি নাতকুর এমনকি গেলবার বড় নাতনীটার বিয়া অই গেছে একটা বিদেশী ছেলের লগে। চিন্তা কি? এক একটা ছেলেতো এক একটা সম্পদ, পেলে পুশে বড় করি দিলেতোÑ সবটি পড়ালেখা করব এমনতো কতা নাই, তাছাড়া মাইঝা পোলা সামনের বার ইউনিভারসিটি পাশ দিব, এর পর দুই একজন যে শিতি অইবনা তাইবা কে কইতে পারেÑ বড় অইলেতো একদিন রূজি রোজগার করবই। অভাব তখন বাপ বাপ কইরা পালাইবো না?
প্রতিক খায় শাকভাত আর ভাজিডিম মাখি মাখি খায়Ñ জীবনের জন্য খাওন। শুধু বাঁচনের জন্য খাওন, গায়গোড়ানে (শারীরিকভাবে) বড় অওনের জন্য খাওন। বড় অওনের জন্য অনেক কষ্ট, হিমালয় পরিমাণ কষ্ট প্রতিক ভাতের সাথে মিশাই খায়, বাপের সর্বস্ব খায়, মায়ের শরীরের নোনা ঘাম খায়, শুধু সেই খায় না আটজনে খায়, বাবা-মা নিজেরাও খায়, এক বেলা খায় তো দুই বেলা না খাই থায় আর গায়গোডানে বড় অয়। ভাঙ্গা ঘড়ির জন্য সময় বসি থাকে না, দিনে একবেলা খাওন সময়কে পার করনের জন্য খাওন, এখন হয়তো সময় খারাপÑ সবারই একসময় সময় খারাপ যায়, দিনের পর বাইত আর রাইতের পর দিন আরকি তারপর এক সময় ভাল সময় আসেই। জীবনের পটভূমিতে সময় এখানে ব্যক্তিগত; প্রত্যেকেরই উঁচা নিচা আলাদা রাস্তা বক্ররেখার মতন। প্রতিক হিসাব মিলাইতে চায়, বিজগণিতের ইকোয়েশনের মতন মিলেনা বরং মাথার ভিতর আঁকা বাঁকা রাগ যেন টগবগাই উৎরাই উঠে।
৫. রসুই ঘরের পিছে বাড়ির কুত্তিটা পাঁচটা ছাও বিয়ায়। চোখ নাই একটুখানি একটুখানি কুত্তার ছাও। মার গন্ধ পাইলেই কিঁউকিঁউ করি উঠে, মা কাছে আসে দুধের আকাল বোটাগুলি ছাওগুলির মুখের ভিতর পুরি দেয়। ছাওগুলি যা পায় খায়। দিন যায় রাত যায়, ছাওগুলির পেট বড় অয় চোখ ফুটে, মাইগুলি ঝুলি পড়ে কুত্তিটা দুধের স্বল্পতা টের পায়। বাচ্চাগুলি পিছে পিছে ঘুরে আর কিঁউ কিঁউ করে। কুত্তিটা খাবার চায়, অনেক খাবার, তার পেটের সাথে আরো পাঁচটা পেট, এই পেটগুলি তাকে ভরতে অইব। মানুষের মতন কুত্তাতো আর বাচ্চা নিয়া ভাবে না। ছাও বিয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যোগানোই তার একমাত্র কাজ। সবকিছু কুত্তিকেই ভাবতে অয়।
কুত্তিটা আইজ কাইল মাইনষের রসুই ঘরের পিছে ঘুর ঘুর করে। সুযোগ পাইলে ঘরের ভিতর ঢুকি যায় এইটার অইটার পাতিল উল্টায়, কারণ তার অনেক খাবার চাই। দেখলে কেউ ঝাটাপিটা করি তাড়াই দেয় কেউবা ফেনটা খাইতে দেয়। কুত্তার ছাওগুলি ধীরে ধীরে বড় অয়। মানুষের বাচ্চারা অগো নিয়া খেলে লাথি মারে হাতের লাঠি দি পিটায় লাথি পিটানি খাই খাই বড় অয়। কুত্তার বাচ্চাগুলিরে একদিন মানুষরা বাড়ির থনে পিটাই বাইর করি দেয়। ততদিনে তাদের মায়ের প্রয়োজন মিটি যায়। রাস্তাঘাটে তারা বয়স প্রাপ্ত অয়।
৬.
আসগর আলী পাতিল হাতে মিঝিবাড়িত যায়; জেডি, মায় কইছে চাইরসের চাইল দিতেন। জেডি চাইল মাপি দেয়; ষোল পট চাইল মাপি দেয়। দিতে দিতে কয়, বাছা, কাইল এটটু আইছ, ক্যান?
আইচ্ছা। আসগর আলী বাড়ি আসে।
বান্দর লাফাই লাফাই গাছ উঠে। সুপারীর পিড় ভাঙ্গে। এক গাছের থন আরক গাছে যায়। লাফাই লাফাই লম্বা লম্বা গাছের মাথায় উঠে। ভারে সুপারি গাছ নুই পড়ে। জেডি নিচে খাড়াই আল্লা করে। সুপারি গাছের মাজা ভাঙ্গি পুকুরে পড়ে। দর্শকরা দেখে আর হাসে। কয়, দেক! দেক! খাডি বান্দর!! গাউছ্যা বান্দর!!! বান্দর তাদের সাথে হাসে। বত্রিশ দাঁত দেখাই হাসে। বান্দরের স্বপ্ন এইভাবে গাছে গাছে লুটাপুটি খায়। সাতটা বান্দর এইভাবে সিরিয়াল খোঁজে।
৭. ‘মাইঝা বিবি ও মাইঝা বিবি, ছোড বিবি নি মরি যায়।’
‘কি কন্গো নুজ্জানের মা, আঁই না হেতেনরে বেয়াইন্না বালাছালা দেখি আইছি।’
‘কিগো দইন ঘরের বিবি, আন্নেকি ভুলি গেছেন নি? আইজ নি ছোড বিবিরি ডেলিভারী। নুজজানের মা আন্নে যাই সোলেমানের মারে ডাকি আনেন।’ নুজজানের মা সোলেমানের মারে ডাকি আনতে পাশের বাড়িতে যায়।
‘মাগো মা, বেডি কি বিয়াইতো হারে, অউগগার দুধ ছাড়তে না ছাড়তে আরুগ্গা বিয়ায়। নয়টা বিয়ইল, অন হেতির খাদ হুওে না।’
‘দূর! কি যাতা কন। দইন ঘরের বিবি, আন্নের মুকে কোন লাগাম নাই। আল্লার মাল আল্লায় দিছে, ইয়্যানো কি কারো কোন হাত আছে?’
‘থু! আল্লার মাল আল্লায় দেয়! কই আল্লায় তো আঁরে দুইটার বেশী দিতে হারেনো। শুধু আয়াইলেই অয় না খাওনো দিতে অয়।’
নুজ্জানের মা দৌড়াই আসে, ‘ছোড বিবির মাইয়া অইছে। টুকটুইক্যা লাল একখান মুক।’
‘ঠেলা বুঝেন, শেষ কাডাইল্লা মাইয়া।’
৮. প্রতিকের খাওন বন্ধ অই যায়। জোর করিও যেন ভাত গলাদি ঢুকাইতে পারে না। মায়ের পেটের আড়াপাকা ভ্র“নটা যেন তার গলার মইধ্যে ঢুকি আছে। প্রতিক গলায় হাত বুলাই দেখে, না নিচে নামে না।