১. পূর্বকথা: হীরে ভেঙ্গে কাঁচের টুকরো
সাধারণত এরূপ অবস্থায় সারা শরীরে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমে ওঠে, গড়িয়ে পড়ে শরীর থেকে নোনা পানিÑ সদ্য ফ্রিজ থেকে বের করা পানির বোতলের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি। বুকটা ছান্দিক গতিতে ওঠানামা করে, শরীর কাঁপতে থাকে আর সাথে হৃদপিণ্ডও; মুঠিতে আবদ্ধ একটা কবুতরের বুক যেন। দৃশ্যমানতার অতীত, শুধু হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়।
প্রথম রাতটা এর আওতার বাহিরে, কারণ সেটি ছিল চব্বিশ ডিগ্রি সংকট কোণ Ñ হীরের মত উজ্জ্বল রোমান্টিক রাত। তৃতীয় রাতও এর আওতায় পড়ে না। কেননা সেটি ছিল শেষ রাত। আর সব শেষ’ই ফলাফল, সিদ্ধান্ত ও জিরিয়ে নেয়ার সাধারণ সময়।
২. এক মানিক সাত রাজার ধন: প্রথম রাত
সম্ভবত আমার বয়স এখন থেকে পাঁচ বছর বেশী হয়ে থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে থাকবো। কর্মত্রে? মনে নেই, মুখ্যও নয় আর সেটা মাথায় ছিলোও না কেননা বিষয়টাই মুখ্য ছিলো। ঠিকানা: গ্রামÑ মিরপুর, থানাÑ ফরিদগঞ্জ, জিলাÑ চাঁদপুর, তপদার বাড়ির মৌলভী কেরামত আলীর নাম কে না জানে, ধুলা-বালি থেকে আকাশ-বাতাস সবাই।
উত্তর ভিটার চালের ওপর আমগাছের ডালে পাতার ফাঁকে পাখি ডেকে ওঠে। আমার শিশুবেলায় নানু পাখির নাম বলে দিতেন ‘ইষ্টুকুটুম’। নানু বলতেন, ‘দেক! দেক! হইক কি কয়! ইষ্টুকুটুম! ইষ্টুকুটুম!’ আঙ্গুল বরাবর আমগাছের মগডালে স্থিরদৃষ্টি, অবাক হতাম। নানু বলতেন, ‘দেহিস, আইজ মেজ্জান আইবো’। প্রমাণ দেখার ফুরসত পাইনি। অন্ধকারের ভেতর আলোর জন্ম। তারপর তাতেই মৃত্যু। মাঝখানে রূপালি পর্দায় রঙিন কিছু দৃশ্য আর পলক ফেলতেই হলুদ ইষ্টকুটুম দাঁড়কাক হয়ে যায়। নানুর আঙ্গুল আর কণ্ঠনালী সাত বছর আগে মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল।
ঘরের চালের ওপর আমগাছের ডালে ইষ্টকুটুম ডেকে চলে ণে ণে। রঙ বদল করা একটা ময়না পাখিÑ আসলে জাতে ময়না প্রজাতীয়। ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকি তন্ময় হয়ে। উপচেপড়া স্মৃতিতে উথলে ওঠে শৈশব আর কৈশর। মাছের রূপালি পেট, পোকা ভরা মগডালের মিষ্টি আম, কণ্ঠতালু শুকানো পরিশ্রমে সোনালি ধান। মামা গরম চা খেতে দিয়ে বলতেন, ‘এইতো কয়ডা মুডা আর মাত্র’। আমি নিমগ্ন পাখির গানে। দখলকৃত কর্ণকুহরে প্রবেশ করার সুযোগ নেই সমস্ত বাড়ির আমোদ-ফুর্তি ও অনাবশ্যক কোলাহলের।
এক তরুণী, অচেনা, আমাকে ধাক্কা দিলে আমি মর্তে ফিরে আসি। পুরুষ কিংবা যুবক অস্বাভাবিক কম মনে হয় Ñ উঠানে বিচরণশীল মুরগির পাল, মাঝে দু-একটি রাতা, কখনো রাজা কখনো অসহায় তারপরও পূর্ণকারী। অপরিচিতের মত আমার অবাক দৃষ্টি চারপাশে ঘুরে। তরুণী চিৎকার করে ওঠে। সাথে সাথে কলকাকলিতে পাখির ঝাঁক ঐকতানে গেয়ে ওঠে। আগমনবার্তার এক অভিনব প্রচার।
বসন্তের রঙিন বাতাস বইতে থাকে বাড়ির ওপর দিয়ে, গাছের সবুজ নৃত্যে পাখির গান, কাঁচা মেহদীর রঙিন গন্ধে সুবাসিত মেহফিল। নির্দিষ্ট সময়ের মৌসুমি বাতাস সব বাড়ির ওপর দিয়ে, সব নিলয়, সব অলিন্দের ভিতর দিয়ে বয়ে যায়। তখন বাতাসে থাকে মাদকতা। কবুতর ছুটোছুটি করে মিলিত হওয়ার আনন্দে আর তখন মনের মাঠে সবুজ ধানেেতর পৃষ্ঠ বরাবর অনবরত ঢেউ জাগে, ঢেউ ভাঙ্গে।
আমার আগমনকান্তি দূর হয়ে গেলে আমি বেরিয়ে পড়ি। কাউকে খুঁজতে থাকি আনাচে কানাচে, এঘর সেঘর। কাকে খুঁজি? আমার চারপাশে তরুণী অসংখ্য! কত হবে? বিশ! পঁঞ্চাশ! একশ! আরো বেশীÑ গুণলেই বাড়তে থাকে! আকাশ থেকে পড়ে! মাটি ফুঁড়ে বের হয়! অচেনা! অসংখ্য! খোদা আকাশের দরজা খুলে দিয়েছেন, হুরেরাÑ বেহেস্তের বাসিন্দা, এ বিয়ে বাড়িতে নেমে এসেছে দলে দলে। চলমান সৌন্দর্য আমার পাশ দিয়ে চলে যায় আর দোলায়িত কোমর আমার সাথে সংঘর্ষ খাওয়ার আগেই আমি সরে গেলে খাড়া তীরের ঢেউভাঙ্গা শব্দে মেয়েলি কণ্ঠের হাসিরা ভেঙ্গে পড়ে।
শৈশব ও কৈশরের অভ্যস্ততায় পইপই করে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ মনে হয়, হায়! আজতো আমার বিয়ে!! কি অদ্ভুত আমার বিয়ে! আমি অবাক হলেও প্রকাশ করিনি পাছে লজ্জায় মরে যেতে হয়। অথচ আমি জানতাম বিয়ের জন্যই আমাকে ডেকে পাঠানো জরুরী ভিত্তিতে।
আমার চারপাশে গুটি কয়েক পরিচিত লোকÑ আম্মা-আব্বা, নানা-নানু, মামা-মামি, খালা-খালুজি ইত্যাদি। বিয়েটা আমাদের বাড়িও নয় কনের বাড়িও নয়, দু’জনেরই নানার বাড়ি। কেন, তা একবারও আমার মাথায় আসেনি কিংবা হতে পারে আমি আমার ভাবনাকে এমন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ দেইনি। তৃণলতা ঠোঁটে স্বপ্ন-বিভোর আমি উড়ন্ত পাখির আবহে ভেসে বেড়াচ্ছি।
বাজারে মানুষ খোঁজার মত করে আমি একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কাকে এবং কেন তা জানি না। জানি শুধু খুঁজে পেতে হবে। প্রয়োজন নেই কিন্তু আকাঙ্খা বড় কথা। গোলাপগাছের পাশ দিয়ে নানুর হাত ধরে এক তরুণী যেতে থাকলে মনে হয় আমি তাকেই খুঁজছি। যন্ত্রের মত দৌড়ে গিয়ে কোকিলার কালো পিঠের মত তার খোপার ভিতর একটা গোলাপ গুঁজে দিয়ে এলে মনে হয় এক মানিক সাত রাজার ধন। আমার নানু যরে ধনের মত খোপার সে ফুলটিকে পাহারা দিতে থাকেন। গায়ে হলুদের আগে দেহের সব আবরণ ও আভরণ পাল্টানো হলেও খোপার ফুলটা পাল্টানো হয় না বরং নানু খোপাটাও খুলতে দেন না। তখন আমি বারংবার সুসজ্জিত নৌকাটা দেখে আসি যেটা ছিল দু’তীরের সেতুব›ধ।
৩. বাস্তবতা: একাকী ভ্রমর, বডিগার্ড ফুল
মূলত আমি তামান্নাকে নিয়ে ভাবতাম। কবে এ বীজ ভূমিতে গেঁথে গিয়েছিল আর কবে এর অঙ্কুরণ ঘটেছিল তা টের পাইনি। আর যখন কৈশরে এসেছি তখন দেখি সেটা বাকুড় বৃরে শিকড় হয়ে আমার মাথা, বুকে, পিঠে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা মেলে দিয়ে গেঁড়ে বসে আছে। আমি নির্জনে ভোরের আঁধার থাকতে থাকতেই তার মূলে পানি ঢালতাম আর তখন পর্যন্ত তামান্না ছিল শিশু Ñ শিশু থেকে কিশোরী। বয়োঃস›িধ কালের ছেলেরা যখন তাদের পথ থেকে ছিটকে যাওয়ার মত ভুল করে তখন প্রস্পুটিয়মান ফুলের গন্ধ আমাকে পথের ওপর সম্মোহিত করে রাখতো ফলে যৌবনেও অন্যের দিকে তাকাবার সুযোগ পাইনি। যখন ভেবেছিলাম গাছটার সাথে তামান্নার পরিচয় হওয়া উচিত তখন হঠাৎ করেই সে শিশু হয়ে যেত। এভাবে শিশু ভাবতে ভাবতেই তামান্নার বিয়ে হয়ে গেল।
৪. খন্ড বিখণ্ড দর্পণে টুকরো টুকরো স্বপ্নÑ দ্বিতীয় রাত
সমস্ত বাড়ির ওপর দিয়ে একটা পাগলা হাওয়ার মাতম বয়ে যায়। খুশির মাতম। আনন্দে পুলকে উঠানের বালি চিকচিক করে। আনন্দ উদ্দামতার বাঁকে বাঁকে নানারকম অসংগতি নৃত্য করে।
হঠাৎ মনে হয় আমি কিছু হারিয়ে ফেলেছি। কেউ একটা বাকুড় গাছের শিকড়সহ অতি সহজে উৎপাটন করে দিয়েছে। অসংখ্য শিকড় ও তাদের শাখা-প্রশাখা আমাকে দেখে হাসছে। প্রত্যেক শাখা-প্রশাখায় একটা করে চোখ হাসছে মিটমিট করে শয়তানের চোখের মত।
উ™£ান্তের মত আমি ছুটে যাই ঘরের ভিতর। বাড়ির প্রতিটি চলমান এবং স্থির নারী-পুরুষ অপোয় আছে তামান্নার মুখনিসৃত ‘কবুল’ ইনাম পাওয়ার জন্য। আমি ওদের সরিয়ে দিলে দেখি, একটি সদ্যজাত ফুটফুটে শিশু তার কোলে। কিন্তু কোথা হতে এলো এ শিশু? আদর করার জন্য কোলে নেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্ত কার? আমার দৃষ্টি চঞ্চল হয়। অথচ অবিবাহিত তরুণী এবং বৃদ্ধা ছাড়া আমি আর কাউকে দেখছি না। অবাক হওয়ার পালা শুরু হলে দেখি তামান্নার কোলে শিশুটি দুধ খাচ্ছে চুকচুক করে। মায়ের দুধ! তাহলে এ শিশু তামান্নার! কিন্তু তামান্নার সন্তান হবে কেন? আমি যখন শূন্যতার পটভূমিতে অসংখ্য জোনাকী জ্বলতে দেখি তখন আমার নিকটাত্মীয়দের মুখে গভীর প্রশান্তি খেলা করে।
আমি তৎণাত পাগল হয়ে যাই। ছুটে যাই ভিড় ঠেলে তামান্নার দিকে। পারিপার্শ্বিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে তামান্নার কোল পরখ করতে গিয়ে হাত দিয়ে ফেলি তার পেটে। তখন কেউ একজন অপরিচিতা জানিয়ে দেয় তামান্নার জরায়ুর বয়স তিন মাস। কি আশ্চর্য! তখনই হাজার টিকটিকি হাজার কণ্ঠে ঠিকঠিক করে ওঠে! ওরা আমাকে একটুও অবিশ্বাস করতে দেয়নি; ‘ঠিক ঠিক’ ধ্বনিগুলোর প্রতিধ্বনি হতে থাকে অনবরত, মিশে যেতে থাকে আকাশে, বাতাসে, মাটিতে। তখন যেন আমার মস্তিস্ক আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে। পাগড়ি মাথা থেকে ফেলে দিয়ে দৌড়াতে থাকলে অসংখ্য তরুণী আমাকে বন্ধি করে ফেলে দু’দিক থেকে মুঠিবন্ধনে। আর আমার পরিচিত জনেরা ঠাণ্ডা মাথায় আমাকে ভূগোল পড়াতে থাকে। পড়াতে থাকে সাগর, মহাসাগর, আকাশ, মাটি।
নানু বললেন, না ভাই, তুই আর অমত করিস না। রাজি অই যা। এই মানুষগুলোর চোহে মুহে কালি মাহাইস না।
আম্মা বললেন, আঙ্গো মাইয়া, আঙ্গো মান-ইজ্জত, আমরা যদি না বাচাই....।
মামি বললেন, মাইয়াডা ভালাই, এই বয়সে..., আর তুই তো হছন্দ করস।
আমার কপালের দু’পাশে একজোড়া শিং ফুঁড়ে ওঠার জন্য যখন অসহ্য ব্যথা নিয়ে সংগ্রামরত তখন আমি দৌড়ে বাড়ির বাহিরে চলে গেলাম।
৫. কায়মনোবাক্যে মা চাও আমি সাড়া দেব
এলাহি বক্স মৌলভী সাহেবের বাড়ি, গ্রাম: দশঘরিয়া, থানা: চাটখিল, জিলা: নোয়াখালি। উঠানে একটা চেয়ারে বসে আছি। পাশে মুরুব্বিগন উপবিষ্ট। চারদিকে মহাবিষ্টতা। চোখের ওপর প্রগাঢ় চিন্তার বলিরেখা।
বিড়াল পায়খানা করে পর্দাবেড়ার আড়ালে বালির ওপর। ইতিউতি দৃষ্টিপাত, গোপনীয়তার বহিপ্রকাশ। দেখে ফেললেই তো মহাভারত অশুদ্ধ। নোংরা ব্যাপার দেখা মানেই পাপ। ঢেকে ফেলতে পারলে মানরা। বিড়ালটা ঢেকে দিয়ে যায় তার কৃতকর্মের সমস্ত দুর্গন্ধ।
উঠানের ওপর নামতে থাকে ট্রাকের পেট থেকে নামিদামী ফার্নিচার, সাতাশ ইঞ্চি টিভি, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশন, ওয়াশিং মেশিন, জমির দলিল, লাখ টাকার চেক। আমার চোখে খেলতে থাকে চড়–ই পাখির নীড়ের স্বপ্ন। কিন্তু সেটা তখনো ছিল না অবিমিশ্র। বর্ণালীর কালো রেখার মত সত্যাসত্যের প্রবল আকাঙ্খাগুলো কেটে দিয়ে যায়, ভাগ করে দিয়ে যায়।
আমার ভাবনা ধানেেতর দোলায়ীত শিষের সাথে মিশে যেতে থাকে। ঢেউগুলোর কোন নিজস্ব স্বপ্ন থাকে না। থাকে না স্থায়ীত্ব। বাতাসের তোড়ে গড়ে ওঠে এবং শেষে ভেঙ্গে পড়ে। ধানগাছের ফাঁকে ফাঁকে মিশে যেতে থাকে আমার শৈশব ও কৈশরের স্মৃতিসমূহ। আমার তখন খেলতে ভাল লাগে প্রজাপতি ও ঘাসফড়িংদের সাথে।