somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের মনিপুরি কবিতা # হাফিজ রশিদ খান

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১০:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মনিপুরি ভাষায় 'ওগ্রি হাংগেল' আর বাংলায় গীতিকবিতা একই অর্থময়তার দ্যোতক। পৃথিবীর আদি মানবগোষ্ঠিগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মতো মনিপুরিদের কাছেও গীতিকবিতা ছিল হৃদয় ও চেতনাবৃত্তি প্রকাশের প্রাথমিক বাহন। মনিপুরি রাজারা সিংহাসন আরোহণের সময় ওগ্রি হাংগেল পরিবেশনের মাধ্যমে সূর্যের পুজো দিতেন। সূর্য ছিল তাদের আরাধ্য দেবতা। রাজপুরুষরা চাইতেন সূর্যের মতোই চিরসমুজ্জ্বল আর প্রভাময় থাকতে। 'ওগ্রি হাংগেল' লিখিত নয়, মুখে-মুখে রচিত সাহিত্য। কথা ও সুরের মায়াজালে মনিপুরি লোকায়ত সমাজে এখনো এর জের আছে।

বাংলাদেশে মনিপুরিরা বসতি স্থাপন করে প্রায় ২০০ বছর আগে। ১৮১৯-১৮২৬ সাল পর্যন্ত স্থায়ী মনিপুর-বার্মা যুদ্ধের সময় বর্মীদের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়ে মনিপুরিদের একটা অংশ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথানত সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জে এদের বসবাস রয়েছে।

বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণের আগে মনিপুরিদের সাধারণ পরিচিতি ছিল 'মেইতেই' এবং আদিভূমির (বর্তমান ভারতের মনিপুর রাজ্য) নাম ছিল 'মেইতেই লেইপাক'। আঠারো শতকে মনিপুররাজ পামহৈবার (দরিদ্রদরদি বলে যার আরেক নাম গরিবে নেওয়াজ) সময় মহাভারতের একটি কাহিনীর সূত্রে এর নতুন নাম হয় 'মনিপুর' আর আদিবাসীরা 'মনিপুরি'।

গত শতাব্দির সত্তর দশকের মধ্যপর্বে বাংলাদেশে মনিপুরি সাহিত্যের চর্চা শুরু। দীপান্বিতা, মৈরা, শজিবু, ইপোম, ওগ্রি প্রভৃতি সাহিত্যপত্র ও ছোট কাগজের প্রকাশনায় এ চর্চার ধারা এখন অনেক বেগবান, সংহত। মনিপুরি তরুণদের অনেকেই মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলায়ও সাহিত্যচর্চা করছেন।




এ কে শেরাম

অন্ধকার

অন্ধকারে ভয় খুব -
হৃদয়হীন জল্লাদ ও প্রেতাত্মাকেও অতো নয় ;
দৃষ্টিভঙ্গির পেচানো অন্ধকার
কৌশলের অন্ধকার
চেতনা ও মননের অন্ধকার -

সহজ চলাচলেও ব্যাপ্ত হয়ে আছে আজ !

এ মিলিত তিমির ঘনীভূতরুপে
ভয়ানক বিভীষিকা আনে চারপাশে ;
তুচ্ছ কচুরিপানাও এই অন্ধকারে
ফোস করে-ওঠা যেনো ভীতির দেবতাঃ 'লাই' !




শেরাম নিরঞ্জন

আত্মপ্রতিকৃতি


নতুন-নতুন পথে ছুটছে আমার
চেতনার দূর্বার স্কুটার -
আর বাস্তবে মানুষ আমি এক গ্লানিময়
নত হয়ে
চলি ভয়ার্ত, বিবশ !

পৃথিবীটা পুতিগন্ধময় -
চিনেছি ভালোই ঘৃণিত সমাজ
এই হৃদয়হীন স্বজনদেরও ;

আর নিজের বলয়ে
ওতপ্রোতভাবে জড়িত এ আমাকে তো
চিনেছি সকলের আগেই !




সনাতন হামোম

তুমি


তুমি সুন্দর ঝরিনি তাই বৃষ্টি হয়ে
ঝড়ো বাতাসের মতো বইনি তোমার পাশ ঘেসে
পুজোর সময় তোমার হাতের আলোকিত বর্তিকায়
নাচের বিনম্র তালে
টেনেছ ভাটির স্রোতের মতন -
পাশে বৃষ্টিভেজা কাকের দুর্দশা দেখে
মন কেদেছিল, তবু
চাহনির মর্তবা বুঝবো বলে ফিরেও চাইনি
ওই বেচারার দিকে ;

রাসপূর্ণিমার মেলায় অমন অভিমানী চোখ
হলুদাভ ফনেকে আবৃত অধোদেশ
উত্কন্ঠিত এলোচুল
গলায় সোনার হার -

অজান্তে দিয়েছে কন্ঠে বুনোস্বভাবের এই গান !




কন্থৌজম সুরঞ্জিত

জোনাক চোখের ভোর

দাদিমার
স্মৃতিগল্পের ভেতর আকাঁবাঁকা পথে
ধীরে-ধীরে প্রসারিত
এইসব খুব দরদিয়া অক্টোপাস;

সময়ের বেপোয়ারা গতি
যখন গোগ্রাসে খেয়ে নিচ্ছে ওদের শরীর নিরাই-নিভৃতে,
জোনাকের নম্র আলো সান্ত্বনার বকুল ঝরানো সম্ভাষণ আনে
সে-সময়
আরো একটু সটান হয়ে
ঘুমোবার চেষ্টা করতেই
কে আমাকে জাগায় রাতের রিকশায়
ঝুলে থাকা
অতন্দ্র হারিকেনের মতো!

ভোরের প্রভায় তা তা থৈ থৈ করা
লতায় জড়ানো কুঁড়িটির মতো
ওড়িশি নৃত্যরত রাত_

চোখে যার সকালের মলিন কাজল!





থোঙাম সনজয়

বাজার দেবী

যুদ্ধে-যুদ্ধে ভরা এ জীবনে অবশেষে জানলামঃ
অবিশ্বাসের এ ঘোর লড়াইয়ে তুমিও আমার শত্রু -
বুকের বা-পাশে মনে হয়
পেন্ডুলামের মতোই দুলছে বেদনা ;

এভাবে বাচবো কতদিন খাচাবন্দি পশুর সমান !

তপ্ত কড়াইয়ে খৈ-এর আর কীবা পরিণতি
জ্বলন্ত চুলোয় কিছুক্ষণ লাল হওয়া ছাড়া ?

যখন সে কিনেছে আমাকে - করেছে মুক্তির পথও রুদ্ধ
তখন কী আর করণীয়
বাজার দেবীর নিজস্ব গোলাম হয়ে যাওয়া ছাড়া !






পারী চিংথাম

কুকুর


আজকের দিনটা দেখছি খুব বেদনামথিত
কেমন নির্বাক হয়ে গেছি, অন্ধ হয়ে যাচ্ছি..

তবু চিটে-যাওয়া স্বপ্ননারীর কাহিনী
দেখতে পাচ্ছি এ দীর্ঘশ্বাসেও !

কথা দিয়েছি যদিও গতকালই শেষ
তবু আজকেও আবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ;

ভাবিঃ চোখটাকে তুষ্ট করি একবার
পরক্ষণে নিবৃত্তির কঠিন জ্বলুনি দিয়ে
নেড়েছি ওদের..

এখন আমার আর ফাস ছাড়া গতি নেই কোনো..





হাফিজ রশিদ খান সম্পাদিত 'অরণ্যের সুবাসিত ফুলঃ আদিবাসী কবিতার নির্বাচিত সংকলন' গ্রন্থ থেকে। প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারী ২০০৯, প্রকাশকঃ পাঠসূত্র, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১০:০১
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×