পূর্বের কিস্তিগুলোর লিংক
মেঘ ছোঁব বলে মেঘের দেশে : পয়লা কিস্তি
মেঘ ছোঁব বলে মেঘের দেশে : নীলাচল পর্ব
মেঘ ছোঁব বলে মেঘের দেশে : নীলগিরি পর্ব
মেঘ ছোঁব বলে মেঘের দেশে : শৈলপ্রপাত পর্ব
মেঘ ছোঁব বলে মেঘের দেশে : স্বর্ণমন্দির পর্ব
আচ্ছা, বলুন তো- মানুষ বেঁচে আছে কেনো..?
সোজাসাপ্টা উত্তর, খাবারের জন্য।
ঠিক তাই, সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে যেভাবে আপনাকে খাবারের সন্ধান করতে হবে বা খেতে হবে ঠিক তেমনি ঘুমোতে যাওয়ার আগেও খেতে হবে। আর দিনের পুরো বেলায়ও কতশত খাবার চলে তার ইয়ত্তা নেই। আর এভাবে খেতে খেতেই এ খাদ্যশিল্প হয়ে উঠেছে অনন্য জ্ঞানসৃদ্ধ এক রন্ধনশিল্প।
বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন খাবার প্রচলিত। একেক জনের সাথে আবার একেক জনের খাবারের আকাশপাতাল পার্থক্য। ইদানিং তো পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া গুলোও রাধুনি বিষয়ক অনুষ্ঠানে মজেছে। প্রায় সবকটি চ্যানেলেই আপনি দেখতে পাবেন অমুকের রান্না অমুক স্টাইল, তমুকের রান্না তমুক স্টাইল। দেশি বিদেশি বাহারি পদের খাবার রান্নার আয়োজন চলে..
স্প্যানিশ প্রবাদ আছে যে, দ্যা বেলি রুলস দ্যা মাইন্ড। বাংলা ভাবার্থ পেট মনের উপর ‘ছড়ি’ ঘোড়ায়। পেট বলতে মূলত খাবার/খাদ্য বুঝাচ্ছে। সুতরাং, আপনি যেখানেই যান যেভাবেই যান, সুষম খাবার না হলেও উপাদেয় খাবার আপনাকে খেতে হবে। আর আপনি যদি ভোজনরসিক হোন, তাহলে তো কথাই নেই।
ক.
চট্টগ্রামে বাংলা ভাষার অপরাপর ভাষাভাষীর সংখ্যা এগারো। এরা সবাই নিজস্ব স্বকীয়তাই অনন্য। নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি, আচার-বিচার, ভাষাগত পরিবেশ, খাবার.. প্রত্যেকেই পৃথক পৃথকভাবে মেনে চলেন। আমরা বান্দরবানে আসার পর প্রথমেই চিন্তা করি, এখানকার স্থানীয় স্পেশাল কি খাবার আছে..? সন্ধান চলতে থাকে..। ধীরে ধীরে বেশ কিছু খাবারের সন্ধান পাই। তন্মধ্যে, বাঁশকুড়োল’কে প্রথম পছন্দ করলাম। সেইমতো আমরা অর্ডার দিলাম এবং বললাম, এ কথা প্রকাশ না করার জন্য।
২১.০৯.১৩ তারিখ। নীলগিরি, পিক-৬৯, চিম্বুক পাহাড় এবং শৈলপ্রপাত ঘুরে যখন হোটেলে ফিরে এলাম, ঘড়িতে তখন প্রায় ৩:০০ বাজে। সবাই ক্ষুধার্ত। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসামাত্র ওয়েটার ভাতের সহিত প্রথম কিস্তিতেই বাঁশকুড়োল পরিবেশন করলেন। ছোট চিংড়ি দিয়ে রান্না করা। সেই সাথে ডালচিনি, এলাচ দিয়ে বেশ একটা মাংস মাংস ভাব। টেবিলে আসতেই সুগন্ধে মাতোয়ারা অবস্থা। সেইসাথে রুই/ইলিশ। সবাই গপ্পাগপ খাচ্ছে, যেনবা দীর্ঘদিনের অভূক্ত কোন ‘খাদকদল’। আবার কারো কারো মুখে প্রশ্নের ফুলঝুরি। এইটা কি তরকারী, কিসের তরকারী ইত্যাদি ইত্যাদি। তো ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা গল্পকথার পর প্রায় শেষদিকে বললাম, এইটা বাঁশকুড়োলের তরকারী। সবাই তো শুনে থ..
এতো স্বাদ, কল্পনাই করিনি। সত্যি। অত:পর সবাই বাঁশকুড়োলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ..
ওহ্, আরেকটা কথা- বাঁশকুড়োলকে হেয় করার কিন্তু কোন উপায় নেই। শুধু স্বাদের জন্য নয়, ভারতীয় ডাক্তার চোংথাম নির্মলাসহ আরো বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান গবেষকের গবেষণায় এটা প্রতীয়মান যে, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেড, মিনারেল, ফাইবারসহ আরো বিবিধ খনিজ ও ভিটামিন উপাদান রয়েছে বাঁশকুড়োলে। এছাড়াও এতে ক্যান্সার প্রতিরোধক এ্যন্টিঅক্সিডেন্টসহ বিবিধ উপাদান পাওয়া গেছে। এ পুষ্টিকর খাদ্য ‘বিকল্প খাদ্য’ হিসেবে গ্রহণের জন্যও বৈজ্ঞানিকভাবে বলা হয়েছে। রির্পোটের বিস্তারিত অংশ দেখুন এখানে-
Click This Link
বাঁশকুড়োল’কে চাকমা ভাষায় বলে ‘বাচ্ছুরী’। মনিপুরি ভাষায় ‘উষয়’। এটি মূলত কঁচি বাঁশ। সকল বাঁশ আবার খাওয়া যায় না। যেগুলো খাওয়া যায়, সেসব বাঁশ গজিয়ে উঠতেই কেটে নেয়া হয় যখন দেড় কিম্বা দুই ফুট হয়ে যায়। তারপর ছাল/বাকলগুলো ছাড়িয়ে চিকন চিকন করে কেটে সিদ্ধ করা হয়। কেউ কেউ আবার আস্ত সিদ্ধ করার পর কচি কচি করে কাটে। অত:পর পছন্দ অনুযায়ী রান্না..
ঢাকায় থাকার কারণে নিজ সম্প্রদায়গত খাবারের অনুভবটা কখনোই মন থেকে সারাতে পারি না। বাঙালি খাবার প্রথাগতভাবেই তৈলভিত্তিক অপরদিকে মনিপুরিসহ বিভিন্ন আদিবাসী খাবারে রয়েছে হরেক রকমের বাহারি সবজির সমাহার। মাঝে মধ্যে তাই ঢাকায় থাকা আত্মীয়ের বাসায় চলে যায়। ওখানে গেলে একটু নিজ ধংয়ের খাবারের স্বাদ পাই।
খ.
সিজার শ্যাভেজ এর মতে, ‘ইফ ইউ রিয়েলি ওয়ান্ট টু মেক এ ফ্রেইন্ড, গো টু সামওয়ান’স হাউজ এন্ড এট উইথ হিম.. দ্যা পিপল হু গিভ ইউ দেয়ার ফুড গিভ ইউ দেয়ার হার্ট’। কিন্তু বান্দরবানে আমাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। এক সুইটি ছাড়া আমাদের আর কোনো পরিচিত বন্ধ নেই। থাকলে আমিও ঢুকে পড়তাম..। অগত্যা সেই হোটেল এর ওপরই যত অত্যাচার চালালাম।
হোটেল মালিক আমাদের মন:পুত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। মালিক বেশ ভদ্রও বটে। কখনো চাঁটগাইয়া কখনো মারমা ভাষায় কখনো বাংলায় বলছে। প্রয়োজনে তারা স্পেশাল রাধুনী হায়ার করে এনে রান্না করাবে। তাদের অনুনয় বিনয়ে আমরা শেষমেশ রাতের জন্যও একটা স্পেশাল অর্ডার দিলাম। কলা গাছের তরকারী্। বাঁশকুড়োলের মতোই ছোট মাছ দিয়ে রান্না করবে। সেই সাথে সামুদ্রিক রুপচাঁদা। আহ্, জিভে জল এসে যাচ্ছে..
অত:পর আমরা চলে এলাম স্বর্ণমন্দিরে। স্বর্ণমন্দির থেকে আবার আমরা সন্ধ্যের দিকে বান্দরবান শহরে যে যার মতো করে কেনাকাটায় মনোনিবেশ করলাম। বার্মিজ মার্কেটে গেলাম। বেশ কেনাকাটাও হলো। অয়ন ভাই অসুস্থ বোধ করায় হোটেলে ফিরে গেলেন (শেষমেশ বমিও করেছেন। সম্ভবত দীর্ঘ ক্লান্তির জন্য এমন হয়েছে)।
বাদবাকি আমরা পুনরায় চলে এলাম রাত ৯টা কিম্বা ৯:৩০মি. হবে বৈকি। ওয়েটার যথারীতি খাবার পরিবেশন করলেন। প্রথম কিস্তিতেই কলাগাছ। কেউ টের পাইনি। খাওয়া শেষে বললাম, এইটা কলা গাছের তরকারী। এবার আর কেউ থমকে যায় নি। উল্টো ফান করে বলে কি, দুপুরে বাঁশ রাতে গাছ- আর কিছু কি বাদ আছে..?
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ..
এমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে আপনিও যেতে পারেন ‘নিউ আদর্শ ভাতঘর’-এ। আমি নিশ্চিত নিরাশ হবেন না। বরং আপনিও আমার মতো গল্প বলা শুরু করবেন।
গ.
এবার আসি আরেক গল্পে। সুইটি আমাকে আর তন্ময়কে নিয়ে গেলেন বালাঘাটা বাজারের কোন এক দোকানে। দোকানের মালিক বড়ুয়া সম্প্রদায়ের (নাম মনে নেই)। সুইটি চাটগাইয়া ভাষায় কিছু একটা বললেন। কিছুক্ষণ পর তিনটি ছোট বাটি হাতে এলেন একজন। পরক্ষণেই বুঝা গেলো এটি একধরনের নুডলস্। কিন্তু সচরাচর আমরা যে নুডলস্ খেয়ে থাকি সেইথেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
সুইটিকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, মুন্ডি। দোকানির নিজের হাতের তৈরী। চাল গুড়ো করে বিশেষ কায়দায় তৈরী করা মুন্ডি বান্দরবানে রীতিমতো বিখ্যাত। সুন্দর পরিপাটি সাজানো দোকানটিতে আর তেমন কিছুই নেই, শুধু মুন্ডি পাওয়া যায়। দল বেঁধে লোকজন এখানে আসে শুধু মুন্ডি খেতে।
মুন্ডি মূলত বার্মিজ খাবার। বার্মিজ নুডলস্। এই নুডলসটি বিশেষ উপায়ে তৈরীকৃত স্যুপসহ আপনার সামনে পরিবেশন করবে। সেইসাথে মাছের প্রনসহ গুড়ো মরিচ ও লবণ। প্রনটি গুড়ো করা এবং সম্ভবত ছোটমাছের। আপনি পরিমান মতো-প্রয়োজন মতো নেবেন। অত:পর সেই নুডলসের সাথে একসাথে মিশিয়ে খাবেন। উহ্, সত্যিই জল এসে গেছে...। অসাধারণ এক স্বাদ পেলাম।
আর সম্ভবত সেকারণেই ফ্রেঞ্চরা বলে, এপেটাইট কামস উইথ ইটিং; দ্যা মোর ওয়ান হ্যাজ, দ্যা মোর ওয়ান উড হ্যাভ..
আমরা তিনরাত দুইদিন সবসময়েই একসাথে ছিলাম। সবকিছুতেই একসাথে গিয়েছি, থেকেছি, খেয়েছি, উপভোগ করেছি..। কিন্তু ‘মুন্ডি’র সৌভাগ্য হলো না সবার। হোটেলে ফিরে যখন এ গল্প বললাম, সবার আফসোসটা শুধু বেড়েছে বৈ কমেনি..!
ঘ.
আমি এ ভ্রমণের প্রাণ কেন্দ্রে ছিলাম। ছিলাম সঞ্চালকের মতো বিনে পয়সার ‘মাল’। মানে আবুল মাল আব্দুল মুহিত অর্থাৎ অর্থমন্ত্রী। সেই সাথে পরিকল্পনাও..
এত্তকিছুর পরও আমি একটি তথ্য সবার চক্ষুগোচর থেকে আলাদা করে বরাবর এড়িয়ে গেছি। তা হলো, ২২শে সেপ্টেম্বর আমার জন্মদিন। ইশ্, সবাইকে যদি জানাতাম তাহলে কি পরিমাণ যে উল্লম্ফন হতো...। একবার বলবো বলে ঠিক করলাম কিন্তু পরমুহুর্তেই কেন যেনো বলা হলো না। চেপে গেলাম। যাক্, ঠিকঠাকমতো ঢাকায় পৌছেঁছি ২২শে সেপ্টেম্বর ২০১৩ সকাল ৯:০০টায়। কমলাপুর থেকে আমরা যে যার মতো অফিসে দৌড়াঁলাম। আর অফিসে বসেই বেঘোর ঘুম..
বরাবরের মতোই আমি আমার জন্মদিনটাক অন্যরকমভাবে স্মরণীয় করে রাখলাম। রাখতে পেরেছি। তবে, এ ভ্রমণস্মৃতি স্থায়ী রুপ নিয়ে এখন মগজে শায়িত। আর তাই স্মৃতিচর্বনে পুনরায় বলি- বান্দরবান, তুমি অনেক সুন্দর। বেঁচে থেকো হাজারো বছর..
আমার এ ভ্রমণ কাহিনীর দীর্ঘ লটরফটর যারা প্রথম থেকে সঙ্গ দিয়েছেন বা সঙ্গে ছিলেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আরো বিশেষ ধন্যবাদ মনোযোগ বিচ্ছিন্ন না করার জন্যে আর আমার চাপাবাজি সইতে পারার জন্যে। ভালো থাকবেন।
পুনশ্চ: সদা সর্বদা যাহা মনে রাখিবেন, নেভার এ্যট মোর দ্যান ইউ ক্যান লিফট বিশেষত: ভ্রমণের ক্ষেত্রে। কারণ এ ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি (বিষয়াদি বিস্তৃত করা থেকে বিরত থাকলাম, এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী)।
পুনরায় ধন্যবাদ।