somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফলের নামে বিষ!

১৬ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মধু মাস জ্যৈষ্ঠ মাসে বাজারে মৌসুমি ফলের সমাহার মানুষকে যেমন প্রলুব্ধ করছে, তেমনই একই সঙ্গে আতঙ্কিত করেও তুলছে। ফলমূলে রাসায়নিকের মিশ্রণ আতঙ্কিত করে তুলছে প্রতিটি সচেতন মানুষকে। আম, জাম, লিচু, কলা, পেঁপে, আনারস, পেয়ারা কিনতে গিয়ে ক্রেতারা সংশয়ে ভুগছেন। আপেল, আঙ্গুর নাশপাতিসহ বিদেশি ফলেও মেশানো হচ্ছে নানা ধরনের রাসায়নিক। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে আম ঠিকমতো পাকার কথা নয়। আগাম বর্ষার কারণে পাকার প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও বিলম্বিত হওয়ার কথা। কিন্তু রাজধানীতে এখন পাকা আমের সমাহার। রাসায়নিক দিয়ে পাকানো এই আম ক্রেতাদের শুধু প্রতারিতই করছে না, তাদের স্বাস্থ্যহানিরও আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। প্রভিট, ইডেন, ইথরেল প্রভৃতি রাসায়নিক ব্যবহার করে আমে হলুদ রঙ ধরানো হচ্ছে। রাজধানীর আড়তে রাসায়নিক ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় গাছ থেকে আম পেড়ে তা উৎপাদন এলাকায় কৃত্রিমভাবে পাকিয়ে রাজধানী বা অন্যান্য বিক্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। লিচুসহ অন্যান্য ফলেও ব্যাপকভাবে রাসায়নিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। হাইকোর্ট এক নির্দেশনায় বাজারে রাসায়নিক মেশানো ফল বিক্রি হচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণের জন্য সরকারকে বললেও এখন পর্যন্ত সে নির্দেশনা কার্যকর হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাসায়নিক পদার্থযুক্ত ফল ধীরে ধীরে লিভার ও কিডনি অকেজো করে দিতে পারে। এসব রাসায়নিক হৃদযন্ত্র দুর্বল করে দেয়। স্মৃতিশক্তিও কমিয়ে দেয়। অস্বাভাবিকভাবে এসিডিটি বাড়ায়। ফরমালিনযুক্ত খাদ্য নিয়মিত গ্রহণ করলে পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যান্সার, এমনকি ব্লাড ক্যান্সারও হতে পারে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফল গাছে থাকা পর্যায় থেকে বিক্রি পর্যন্ত পাঁচ দফা রাসায়নিক প্রয়োগ হয়। এর ফলে এসব ফল রীতিমতো বিষে পরিণত হয়। মাঠ পর্যায়ে রাসায়নিক মিশ্রণের প্রবণতা রোধে কৃষি অধিদফতর উদ্যোগ নিলেও ফলাফল প্রায় শূন্য। রাজশাহীর বিভিন্ন বাগানে সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাগান থেকে পাড়ার পর আমে ৫ বারেরও বেশি রাসায়নিক মেশানো হয়। আম পাকার পর তা যেন পচে না যায় এজন্য নিয়মিত স্প্রে করা হচ্ছে ফরমালিন। রাতে আমের দোকান বন্ধ করার আগে ফরমালিন স্প্রে করে রাখা হচ্ছে। ফলে ভোরে ওই আমের রাসায়নিক পরীক্ষা করা হলেও ফরমালিনের উপস্থিতি ধরা পড়ছে না। তাছাড়া ক্যালসিয়াম কার্বাইড মেশানো আম উচ্চ তাপমাত্রায় রাখা হলে ক্যালসিয়াম সায়ানাইড তৈরি হতে পারে। এ বিষাক্ত আম খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। এছাড়া বিষাক্ত আম খাওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, আম পাকার আগে ও পরে কয়েক দফায় রাসায়নিক মেশানোর ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা বলেন, আমাদের দেশে ৩ পদ্ধতিতে আম পাকানো হয়। একটি ইতোফেন ও ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার। তিনি বলেন, পূর্ণ বয়সী আমে ইতোফেন ব্যবহার ক্ষতিকর নয়। তবে কম বয়সী আমে ইতোফেন ব্যবহার ক্ষতিকর। ক্যালসিয়াম কার্বাইড স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তিনি বলেন, ফল যদি প্রাকৃতিকভাবে পাকানো যায় তবে সবচেয়ে ভাল হয়। ঢাকার খামারবাড়ির ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা একেএম শামীম আল আমিন বলেছেন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার নিয়ে আমরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। কারণ, ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রয়োগের পর আম উচ্চ তাপমাত্রায় রাখা হলে ক্যালসিয়াম সায়ানাইড তৈরি হতে পারে। এ আম খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে রাজধানীতে কেমিক্যালমুক্ত আমের নামে যা বিক্রি হচ্ছে তা মোটেও কেমিক্যালমুক্ত নয়। এ বিষয়ে বিএসটিআইকে তৎপর হতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কুদরত-ই-জাহান বলেন, বাজারে যে কার্বাইড পাওয়া যায় তা-ও ভেজাল। ফলে ভেজাল কার্বাইড ব্যবহারে আম আরও বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। চাঁপাই নবাবগঞ্জ আম গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সফিকুল ইসলাম বলেন, মূলত ফড়িয়ারা আমে কেমিক্যাল মিশিয়ে থাকে। তাই মিডলম্যান বা বিক্রয় চ্যানেলের মাঝের ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। চাষি পর্যায়ে আমে রাসায়নিক মেশানোর ঘটনা তেমন দেখা যায়নি।
বাগানের বিভিন্ন গাছে আম ধাপে ধাপে পাকে। কিন্তু এভাবে ধাপে ধাপে পাকা আম পরিবহন ও ব্যবসার জন্য সুবিধাজনক নয়। এক সঙ্গে বিপুল পরিমাণ আম পাকাতে কেমিকেল প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ কম হয়। তাছাড়া কার্বাইড ক্যালসিয়াম ব্যবহারে ফলের রঙ সুন্দর হয়। ক্রেতাকে সহজেই আকৃষ্ট করা যায়। আম দীর্ঘসময় সংরক্ষণ করার জন্য ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। এছাড়া গাছে মুকুল আশার আগেই বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। আম পূর্ণ বয়সী হয়ে পাকা পর্যন্ত ৫ থেকে ৭ দফায় রাসায়নিক মেশানো হয়। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্রেতারা টকটকে রাঙা আম দেখলে সহজেই আকৃষ্ট হন। এ কারণে আম টকটকে করতে বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করেন তারা। চাঁপাই নবাবগঞ্জের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের আম ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান বলেন, একজন ব্যবসায়ী যখন রাসায়নিক দিয়ে আম রঙিন করে মার্কেটে নিয়ে যায় তখন অন্য ব্যবসায়ীর রাসায়নিক মুক্ত আম অবিক্রীত থেকে যায়। এ কারণে পরবর্তী সময়ে সে নিজেও রাসায়নিক মেশাতে বাধ্য হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে আম যত রঙিন সে আমে তত রাসায়নিক মেশানো হয়েছে- এটা নিশ্চিত। তাই হালকা সবুজাভ রয়েছে এমন অর্ধপাকা আম কেনা সবচেয়ে নিরাপদ।
আমে ফরমালিন মেশানোর পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা উবে যায়। মেশানোর কয়েক ঘণ্টা পর রাসায়নিক পরীক্ষা করলেও আমে ফরমালিনের উপস্থিতি ধরা পড়ে না। কিন্তু আমের অভ্যন্তরে ফরমালিনের ক্ষতিকর উপাদান মিশে যায়। আম বিষাক্ত হয়ে যায়। এ বিষাক্ত আম খেলে পাকস্থলিতে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের উন্নতমানের সংরক্ষণ পদ্ধতি বের করতে হবে। আমের সংরক্ষণ সময় বাড়াতে গবেষণা করতে হবে। অন্যথায় ফরমালিনের ব্যবহার রোধ করা যাবে না। ভোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বোঁটা কালো ও শুকনা দেখলে আম ও কাঁঠাল কিনবেন না। সম্প্রতি কাঁঠালেও ফরমালিন দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং প্ল্যান্ট স্থাপন করা গেলে ২-৩ সপ্তাহ আম রাখা যাবে। সেক্ষেত্রে ফরমালিন ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। এ কাজে বেসরকারি উদ্যোক্তা বা সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নত মানের প্যাকেট করে আম বাজারজাত করা গেলে নির্দিষ্ট সময় পর আম পাকবে। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে আম জীবাণু মুক্ত করে প্যাকেটবদ্ধ করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আমের চাষ পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে বলছেন। বলা হচ্ছে, মুকুল আসার আগে ছত্রাক প্রতিরোধে একবার রাসায়নিক ব্যবহার করা যেতে পারে। মুকুল পড়া বন্ধে এবং আম পরিপুষ্ট করতে ভিটামিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার এবং পোকা দমন করতে সীমিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি বাগানে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলিম উদ্দীন বলেন, মুকুল আসার পরে এবং ফোঁটার আগে একবার স্প্রে এবং আরেকবার আম মটরদানার সমান হলে কীটনাশক দেয়া যেতে পারে।
কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক স্প্রে করার ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু ম্যানেজ করার গুণে ফল চাষিরা অবাধে কীটনাশক ও রাসায়নিক স্প্রে করে চলেছে। জনস্বাস্থ্য স্বভাবতই হুমকির মুখে পড়ছে। জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে ফলমূলসহ খাদ্যপণ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে গণসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগও নিতে হবে।

সুত্র
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×