কিন্তু কথা হচ্ছে, লেখকের উদ্দেশ্য আর লেখার অর্ন্তগত নিজস্ব শক্তি কি শেষ পর্যন্ত এক বিন্দুতে মিলিত থাকে? লেখা কি শেষ পর্যন্ত লেখককে ছাপিয়ে একটি নিজস্ব অবস্থানে পৌছাতে পারে কখনো? যেখানে লেখা প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় লেখকের!
ওরয়্যালের এনিমেল ফার্মের কথাই ধরা যাক। লেখক দেখাচ্ছেন, শুকোর ফার্মের শুকরেরা যারা প্রলেতারিয়েত তারা ক্ষেদিয়ে দিচ্ছে শাসক মানুষদের। কিন্তু তারাই আবার মানুষের মতো বিলাসিতা শুরু করে ( শুকরেরা মানুষের বিছানায় ঘুমায়, হুইস্কি খায়)। অন্যান্য প্রানীদের ওপর চালায় নিপীড়ন, বিরুদ্ধবাদীদের ওপর লেলিয়ে দেয় হিংস্র কুকুর, বদলে ফেলে জাতীয় সঙ্গীত, সরে আসে সবার সমধিকারের আদর্শ থেকে, এমন কী কাটাছেড়া হয় সংবিধানে। এসব দিয়ে ওরয়্যাল বোঝাতে চেয়েছিলেন-- সাম্যবাদী ধারণা একটি অবাস্তব পদ্ধতি। যার পরিণিত হবে আরো ভয়াবহ-- অযোগ্যের দমবন্ধ করা শাসন।
কিন্তু ''এনিমেল ফার্ম''-এর শেষের দিকে, শাসক শুকরের বিলাসিতার নাকাব যখন উন্মোচিত হয়ে পড়ে, তখন অন্য পশুরা অবাক হয়ে দেখে। আমরাও দেখি, বাস্তবয়নের অভাবে একটা মহৎ আদর্শ কিভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। এখানেই ওরয়্যালের উদ্দেশ্যর সাথে তার লেখা বিট্রে করে। কারণ, তার লেখা আর্দ্র হয়ে ওঠে। প্রজাতূল্য অন্যান্য শুকুর ও ফার্মের পশুপাখিরা অবাক হয়ে দেখে। এই অবাক শব্দটাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ ওরয়্যালের কলম এই ফ্যালফ্যাল করে তাকানো নীরিহ চোখগুলোর প্রতি দূর্বল। এখানেই ওরয়্যালের অলক্ষে তার লেখা একটা বিভাজন রেখা টেনে দেয়। একটা আদর্শ, আর একটা প্রয়োগ। প্রয়োগের ব্যর্থতা প্রয়োগকারীর, সমগ্রের নয়। হয়তো এই চিন্তা থেকে নব্য মার্কসবাদীরা ওরয়্যালের লেখাকে সত্তর ও আশির দশকে পূনঃমূল্যায়ন শুরু করেন।
এবার বাংলাদেশের বিক্ষাত লেখক হুমায়ুন আজাদের প্রসঙ্গে আসা যাক। যিনি তার 'নারী' গ্রন্থ দিয়ে বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলনের একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বলা যায় 'নারী' হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ যেখানে নারীকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভাষা, সমাজ, রাষ্ট্র ও দার্শনিক ভাবে। আজাদ পুথিবীর মহৎতম লেখক ও ভাবুকদের লেখা বিশ্লেষন করে দেখিয়ে দিয়েছেন নারী অধস্তনতার স্বরূপ। নারীকে কখনো সংস্কার দিয়ে, কখনো পূজনীয়া করে দেবীর আসনে বসিয়ে, কখনো ফ্রয়ডের পুরুষতান্ত্রিক মনোদৈহিক ব্যাখ্যা দিয়, সর্বোপরী নির্যাতন ও পুষতান্ত্রিকতা দিয়ে কিভাবে 'নারী' করে রাখা হয়েছে। ব্যাখ্যা করেছেন রুশো, জন স্টুয়ার্ট মিল, রাসকিন এমনকী বাঙালী দর্শনের প্রবাদপুরুষ রবীন্দ্রনাথকে। দেখিয়েছন-- তারা কিভাবে পুরুষতান্ত্রিক ধারণার দ্বারা তাড়িত ছিলেন। আজাদ তাদের কাজের মধ্যে দেখেছেন-- এক সুগভীর রাজনীতি, যা কোনো না কোনো ফর্মে নারীকে অধীন করে রাখে; তার শরীরকে অস্বীকার অথবা উদ্বুদ্ধ করে শারীরিক নিয়ন্ত্রেণ। যদিও 'নারী' গ্রন্থে পুরুষতান্ত্রিকতার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে, তথাপি নারী মুক্তির সম্মিলিত বা ফলপ্রসূ কোনো পন্থা বাতলাতে পারেন নি আজাদ। এক্ষেত্রে নারীদের প্রথার ভেতর থেকে বের হবার পরমর্শ বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার মতোই ব্যাপার। কিন্তু তারপরেও তাত্ত্বিকভাবে নারী'ই হচ্ছে বাংলায় নারীবাদীতার প্রথম প্রামাণ্য দলিল। যাতে ঘটেছে তথ্য, উপাত্ত ও বিশ্লষণের সন্নিবেশ।
আজাদ নিজেও বলেছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নারীবাদের জন্ম হয়েছে নারীর হাতে, অর্থাৎ জননীর হাতে। বাংলাদেশে নারীবাদের জননী নেই, আছে জনক (হুমায়ুন আজাদ)।
অথচ আজাদের উপন্যাসগুলোতে মূলত প্রধান চরিত্র পুরুষ ( ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইল, মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ, সব কিছু ভেঙে পড়ে..)। পুরুষ--যারা আবার মধ্যবয়স্ক, প্রতিষ্ঠিত : আমলা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার; তাদের সাথে জড়িয়ে থাকে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্লেবার। ধরা যাক, সেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কথা যিনি স্ত্রীসঙ্গ পছন্দ করেন না। সব কিছুতেই তার মন বিষন্ন-- দেশের রাজনীতি, আমলা বন্ধুর বৌয়ের কামতাড়না, এমনকী সুরাপানেও। সেই লোকটিকে দেখা যায় তার ছাত্রীর সাথে সর্ম্পক তৈরী করতে। সেখানে নির্লিপ্ত ভাষায় একটা উভয়পাক্ষিক আদান-প্রদানের ইঙ্গিত দেয়া হলেও, যখন পুরুষ চরিত্রটি বলে--তার খারাপ লাগে না, কোনো পিছুটান বোধ করে না সে-- তখন হোঁচট লাগে। এ ধরণের স্যাডিস্ট ক্যারেক্টার দিয়ে পুরুষতন্ত্রের আবহমান ধারার একটি নতুন রূপ তৈরী করা ও ''বুদ্ধিজীবী মার্কা'' সংকট তৈরী কা ছাড়া নতুন কী দিতে পারে? এভাবে ''নারী স্বার্থ'' বা নারীর পক্ষে কেমন করে যাবেন লেখক? নাকি সেখানে লেখকের অবচেতন কথা বলে ওঠে? তারপরেও কথা থাকে। সমস্ত কনটেক্ট তুলে আনা। যেখানে ছাত্রী মেয়েটির মানসিক অবস্থা বা দর্শন বা বোধ থাকতে পারতো, যা নিদারুণভাবে অনুপস্থিত। এমনিভাবে, আজাদের উপন্যাসে পুরুষ পুরুষতন্ত্রের মানসিকতার ফায়দা নিতে থাকে। আর নারী এক খাঁচা থেকে আরেক খাঁচায় বন্দী হোন।( সব কিছু ভেঙে পড়ে-তে অনন্যা'র অকাল মৃত্যুও আমাদের দেখতে বাধ্য করা হয়)।
অন্যদিকে ''ফলি ফালি করে কাটা চাঁদ'' আজাদের একমাত্র ব্যতিক্রম উপন্যাস, একটু নারীবাদী। যেখানে প্রধান চরিত্র শিরিন আহমেদ শেষ পর্যন্ত নিজেকে খুঁজে পান, অথবা নিজেকে নিয়ে ভাবনায় রত হোন। তবে চরিত্রটি সর্ম্পকে আজাদ পরে বলেন--
''বহু পুরুষের সাথে ঘুমানো কোনো আধুনিকতা নয়। এই উপন্যাসের যে চরিত্র, সে একজন প্রতিষ্ঠিত নারী, ব্যক্তিত্সম্পন্ন নারী। সে মনে করেছে যে মানসিক সর্ম্পক একটা গভীর আস্থার ব্যাপার। যেহেতু সে সেই আস্থা রাখতে পারেনি কাজেই সে আর স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চায়নি।''
-- ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য, পৃষ্ঠা-২৬৫
এখানে এসেই লেখকের ইন্টেনশন থেকে লেখা আলাদা হয়ে যায়। শিরিন আহমেদের চলে যাওয়ার ঘটনাটি-- উপন্যাসের ভাষা ,অন্যান্য চরিত্র বিশেষত তার স্বামীর সাথে শেষ দিকের কথপোকথন ও সর্বোপরী কনটেক্ট বিচারে অন্য ম্যাসেজ বয়ে আনে। এখানে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে থাকতে পারে।
১. শিরিন আহমেদ স্বামী সঙ্গে অতৃপ্ত ছিলেন, ভাল অপশন পেয় স্বামীর অক্ষমতা আরো প্রবল ভাবে উপলুব্ধ হওয়ায়, তিনি চলে গেছেন।
২. নিজের শরীরকে আবিস্কার করেছিলেন শিরিন।
৩. জীবনকে নিজের গ্রিপে আনার চেষ্টা করছিলেন তিনি।
ফলে, লেখক যে মর্মপীড়ার ও আস্থা ভাঙার যাতনার কথা বলেন-- তা তার লেখা তথা 'ভাষার নিজস্ব ম্যাসেজ' থেকে অনেক দূরত্ব তৈরী করে। আমি লেখাকেই গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ, লেখা অনেক সময় লেখককে ছাপিয়ে যায়, ছাপিয়ে যায় তার দর্শন... অর্থ তৈরী করে নেয় নিজের মতো করে। (এক্ষেত্রে সোনার তরী কবিতা সর্ম্পকে রবীন্দ্রনাথের নিজের সাদামাটা বিশ্লেষনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।)
আসলে ভাষাই মূখ্য। ভাষার কারণেই প্রতিষ্ঠিত নারীবাদী লেখকের উপন্যাসও হয়ে পড়তে পরে পুরুষের অবদমন ফুলফিল করার হাতিয়ার।
হয়তো অনেকেই ভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্নটা জরুরী-- লেখা কি লেখকের সাথে কন্টাডিক্ট করতে পারে (অবচেতন!)? হয়ে পড়তে পারে লেখকের প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রতিপক্ষ?
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ২:৫০