দ্য আমেরিকান ড্রিম’ বলে একটা কথা
আছে। আমেরিকান স্বপ্ন। স্বাধীনতা,
গণতন্ত্র, সমমর্যাদা, সুযোগ, চেষ্টা এবং
উন্নতি—এই হলো আমেরিকান স্বপ্নের
মূল কথা। কঠোর পরিশ্রম, সাধনা করলে
আমেরিকায় তুমি উন্নতি করতে
পারবে। এ জন্য তোমাকে সোনার চামচ
মুখে নিয়ে জন্মাতে হবে না।
তোমাকে অভিজাত হতে হবে না। ওই
দেশে একজন শ্রমিক আর একজন
বুদ্ধিজীবীর কদর সমান। তুমি পরিশ্রম
করো, তোমার ছেলেমেয়েদের
ভালো শিক্ষা দাও, দেখবে ওরা
অনেক বড় হবে। আমেরিকা হলো
সুযোগের দেশ। ও দেশে যে কেউ
উন্নতি করতে পারে, সীমাহীন উন্নতি,
আকাশ হলো সীমা।
বাংলাদেশও এখন সুযোগের দেশ হয়ে
উঠছে। ‘বাংলাদেশি স্বপ্ন’ বলে একটা
ব্যাপার নীরবে আকার পাচ্ছে। পরিশ্রম
করো, সুযোগ যদি তোমার জীবনে এসে
যায়, তুমি যদি কাজে লাগাও, তুমিও
সীমাহীন উন্নতি করতে পারবে। তবে
আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের
একটা মৌলিক পার্থক্য আছে।
আমেরিকায় কঠোর পরিশ্রম তোমাকে
সাফল্য এনে দেবে, তবে সেই
সাধনাটা করতে হবে আইনানুগ
পদ্ধতিতে। আর বাংলাদেশ যে এখন
সুযোগের চাঁদের হাট হয়ে উঠেছে,
তার মধ্যে আছে আইনকানুন ভেঙে
ফেলা, পুকুরচুরির সুযোগও। আপনি
মানুষের জমিজমা জোর করে দখল করুন
এবং সেসব বিক্রি করতে শুরু করুন প্লট
হিসেবে। জমি দখলও করতে হবে না,
কাগজে চারকোনা দাগ এঁকে প্লট নম্বর
বসিয়ে দিন, আর বিজ্ঞাপন দিন,
আকর্ষণীয় মূল্যে প্লট বিক্রি হচ্ছে,
আপনি কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে উঠবেন
কোটি কোটি টাকার মালিক। এই
দেশে পুরোনো বাসনকোসন
ফেরিওয়ালার ছেলে ব্যাংক থেকে
আত্মসাৎ করতে পারে হাজার হাজার
কোটি টাকা। এই দেশে ক্ষমতার
ছায়াতলে আছেন, এই রকম একটা
কিংবদন্তি ছড়িয়ে দিয়েই আপনি আয়
করতে পারবেন কোটি কোটি টাকা,
পিয়ন নিয়োগ দিয়ে, কর্মচারী
নিয়োগ দিয়ে, বদলি ও নিয়োগ–
বাণিজ্য করে। ঠিকাদারি, সরবরাহ
ইত্যাদি করেও সোনার হরিণ ধরা যায়।
আপনি ভবন বানাতে লোহার বদলে
দেবেন বাঁশের ফালি, আপনি সরকারি
গম আমদানি করতে নিয়ে আসুন পচা গম,
আপনি নদীভাঙন রোধ করতে পাঁচ লাখ
বালুর বস্তার বদলে ফেলুন পাঁচ হাজার,
বড়লোক হওয়ার এক শ কোটি রাস্তা
খোলা আছে এই দেশে। আপনি বন দখল
করুন, হয়ে উঠুন বনখেকো, নদী দখল করুন,
হয়ে উঠুন নদীখেকো, জমি দখল করুন, হয়ে
উঠুন ভূমিদস্যু।
এই রকম পুকুরচুরি, নদীচুরি, সমুদ্রচুরির সুযোগ
সবাই পায় না, কিন্তু বাংলাদেশের
কোটি ঘরে আজ একটা বড় হওয়ার স্বপ্ন,
ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন, আমার সন্তান
দুধে-ভাতে থাকবে না শুধু, মাথা উঁচু
করে দাঁড়াবে, এই স্বপ্ন দানা
বেঁধেছে। সেটা এসেছে প্রধানত
ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার
উচ্চহার থেকে। পাশাপাশি আর্থিক
সচ্ছলতা থেকে। আমাদের অভিবাসী
শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স আর
আমাদের গার্মেন্টস এবং সর্বক্ষেত্রে
কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের
উন্নতির প্রয়াস বাংলাদেশকে তুলে
দিয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির
মহাসড়কে। বাংলাদেশ এগিয়ে
চলেছে। এখন আমাদের বৈদেশিক
মুদ্রার সঞ্চয় প্রায় তিন হাজার কোটি
ডলার। মানুষ মোটামুটিভাবে সবাই
খেতে পায়, সবার পায়ে জুতা-
স্যান্ডেল আছে এবং সবার
ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। এই সব ঘরে এখন
বড় হওয়ার স্বপ্ন। ছেলেমেয়ে
লেখাপড়া করবে এবং মানুষ হবে। দিন
বদলাবে। অনেক ঘরে স্বপ্ন হলো, ছেলে
বিদেশ যাবে। টিনের ঘর হবে
দোতলা-তেতলা।
মানুষ দেখছে, তার চারপাশেই তৈরি
হচ্ছে উদাহরণ। মাছের চাষ করে কেউ
ভাগ্য বদলে ফেলেছে। কেউ দারিদ্র্য
দূর করেছে ভুট্টার চাষ করে। কেউ বা
করেছে হাঁস-মুরগির খামার। ব্যবসা
করে, শিল্প-কলকারখানা গড়ে মানুষ
ভাগ্য বদলাচ্ছে। আর আছে শিক্ষা। এই
দেশে মানুষ দেখেছে, লেখাপড়া
করে যেই জুড়িগাড়ি চড়ে সেই।
লেখাপড়া করে ভাগ্যের চাকা
ঘোরাতে পেরেছেন এমন সফল মানুষের
উদাহরণ চোখের সামনে অনেক।
ছোটবেলায় খাবার জুটত না, হয়তো মা
করতেন গৃহপরিচারিকার কাজ, সেই
ছেলে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে এখন
করছেন অধ্যাপনা। হয়েছেন ডাক্তার
বা ইঞ্জিনিয়ার, হয়েছেন সরকারি
কর্মকর্তা, হয়েছেন বড় শিল্পপতি—এই
ধরনের উদাহরণ অনেকই তৈরি হয়েছে।
মানুষের মনে তৈরি হয়েছে আশা।
আশা হলো একটা ট্রেনের ইঞ্জিন, যা
অনেকগুলো বগিকে সামনে টেনে
নিয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষদের
মনেও তৈরি হয়েছে আশা। এবং এই
আশার বেশির ভাগটাই বৈষয়িক। তাই
এই দেশে শিক্ষার্থী কম, সবাই
পরীক্ষার্থী, সবাই সুফলার্থী। আমরা
আমাদের ছেলেমেয়ের স্কুলে এ জন্য
পাঠাচ্ছি না যে তারা লেখাপড়া
শিখে আলোকিত-হৃদয় মানুষ হবে।
আমাদের স্বপ্ন হলো, তারা সফল হবে
পেশাগত জীবনে, ডাক্তার-
ইঞ্জিনিয়ার হবে, জজ-ব্যারিস্টার
হবে, টাকাপয়সা আয় করবে। সে জন্যই
চলছে জিপিএ ফাইভ পাওয়ার ইঁদুর দৌড়।
একেকটা বাচ্চার পেছনে বাবা-
মায়ের কী অহর্নিশ পরিশ্রম। মা ছুটছেন
ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে একবার
স্কুলের দ্বারে, একবার কোচিং
সেন্টারের দরজায়। আমাদের যে
কোচিং–গাইডবই–প্রশ্নপত্র ফাঁসের
সমস্যা, তার সবকিছুর পেছনেই রয়েছে
এই পার্থিব বাংলাদেশি স্বপ্ন। ভাগ্য
বদলানোর উপায় হিসেবে সন্তানকে
সার্টিফিকেট অর্জন করতে দেওয়া।
বাংলাদেশি স্বপ্নের অনেক সুন্দর সুন্দর
উদাহরণ আমরা প্রকাশ করি গণমাধ্যমে।
আমরা পাঠ করি অদম্য মেধাবীদের
সাফল্যের কাহিনি। আমরা দেখি,
মাগুরার ছেলে সাকিব আল হাসান
আসেন সাভারের বিকেএসপিতে,
তিনি হয়ে ওঠেন পৃথিবীর এক নম্বর
অলরাউন্ডার। দেখতে পাই মুস্তাফিজুর
রহমানকে। সাতক্ষীরা থেকে আসেন
ঢাকায়, প্রতিভা আর অনুশীলন তাঁকে
সুযোগ দেয় জাতীয় দলে, তিনি হয়ে
ওঠেন পৃথিবীর বোলিং সেনসেশন।
দ্য বাংলাদেশি ড্রিমের একটা
উদাহরণ সম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি হিরো
আলমের ক্ষেত্রে। কালের কণ্ঠের খবর
অনুসারে, আশরাফুল আলম নামের এই
তরুণের বাড়ি বগুড়ার এরুলিয়া
ইউনিয়নের এরুলিয়া গ্রামে।
ছোটবেলায় অভাবের তাড়নায় নিজ
বাবা-মায়ের সংসার ছেড়ে তাঁকে
আশ্রয় নিতে হয় একই গ্রামের আবদুর
রাজ্জাকের বাড়িতে। ক্লাস সেভেন
পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। তারপর সিডি
বিক্রির ব্যবসা করতেন। সেখান থেকে
তিনি শুরু করেন ডিশের ব্যবসা।
ভালোই চলছে তাঁর আয়-রোজগার। এরপর
তাঁর শখ হয় নিজে মডেল হবেন। বাংলা
সিনেমার মিউজিক ভিডিও তৈরি
করেন তিনি, নিজেই নায়কের
ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সঙ্গে মডেল
কন্যারা অংশ নেন সেই ভিডিওতে।
সেসব তিনি দেখাতেন তাঁর নিজের
গ্রামের ডিশেরই লাইনে। কিন্তু এখন
তো সামাজিক মাধ্যমের যুগ। আছে
ফেসবুক, আছে ইউটিউব। সেসব ছড়িয়ে
পড়ে ইন্টারনেটে।
প্রচলিত অর্থে আশরাফুল আলম
নায়কোচিত প্রতিভার অধিকারী নন।
তিনি দেখতে উত্তমকুমারের মতনও নন,
শাকিব খানের মতনও নন। কিন্তু বাংলা
ছবির প্রচলিত মুদ্রাগুলো নিয়ে তিনি
দাঁড়িয়েছেন ক্যামেরার সামনে।
ফেসবুকে এই ভিডিওগুলো ভাইরাল হতে
থাকে। প্রথমে শোনা যায় হাসির
হররা। কিন্তু তারপরেই একদল ফেসবুকার
তৈরি করেন পাল্টা মত। তাঁরা বলেন,
নায়ক হতে গেলে ফরসা হতে হবে,
লম্বা হতে হবে, শীলিত হতে হবে—কে
আপনাদের এই ধারণা দিয়েছে? এই মত ও
পাল্টা মতের ধাক্কায় এখন জাতীয়
গণমাধ্যমও তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছে,
পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে—কে এই
হিরো আলম। শুনতে পাচ্ছি, তাঁকে
ঢাকায় আনা হয়েছে, বিভিন্ন
টেলিভিশন তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠানও
করছে।
অর্থাৎ কিনা বগুড়ার গ্রামের আশরাফুল
আলম এখন হিরো আলম হয়ে উঠেছেন।
তাঁকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
হাসাহাসির ফাঁক গলে তিনি হয়ে
উঠছেন একধরনের সেলিব্রেটি।
পুঁজিবাদের বিকাশের এই কালে এই
রকমটা হওয়ারই কথা। সে ব্যাখ্যা
নিশ্চয়ই সমাজবিজ্ঞানীরা দিতে
পারবেন। আবার এটাকে দেখা যায়
‘বাংলাদেশি ড্রিম’ হিসেবেও।
হিরো আলম কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে
আলোচিত-সমালোচিত হবেন বলে ওই
মিউজিক ভিডিও বানাননি। এটা তাঁর
প্যাশন, স্বপ্ন, ভালো লাগা। তাঁর
ডিশের লাইন আছে, তাই তিনি
মিউজিক ভিডিও বানাতে এগিয়ে
এসেছেন, বানিয়েছেন, নিজ গ্রামে
দেখিয়েছেনও। এখন তো প্রচারের জন্য
জাতীয় গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল
হয়ে থাকতে হয় না। ইন্টারনেট তাঁকে
প্রচার দিয়েছে।
একটা জিনিস বোধ হয় এইখানটায় বুঝে
নেওয়ার দরকার আছে। মুস্তাফিজুর
রহমান কিন্তু পৃথিবীর সেরা
বোলারদের একজন হওয়ার জন্য খেলতে
নামেননি। খেলতে তাঁর ভালো লাগত
বলে তিনি খেলতে নেমেছিলেন।
হ্যাঁ, তিনি পরিশ্রম করেছেন। ৪০
কিলোমিটার মোটরবাইকের পেছনে
বসে রোজ ছুটে গিয়ে সাতক্ষীরায়
সুন্দরবন ক্রিকেট একাডেমিতে
নিয়মিত অনুশীলন করেছেন। প্রতিভা
ছিল, তা তাঁকে নিয়ে গেছে
আন্তর্জাতিক পরিসরে।
এখন দরকার হবে সাসটেইন করা। টিকে
থাকা। ‘স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল
ক্ষণকালের ছন্দ, উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে
গেল এই তারি আনন্দ’—এ যেন না হয়।
আমরা তো এই রকম অনেক দেখেছি,
হঠাৎ আবির্ভূত হিরোরা আজকে
আলোচিত, কালকেই তাঁদের আর
কোনো চিহ্ন থাকে না। আমাদের
‘তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ ধরনের
প্রতিযোগিতার শিল্পীরা, যাঁরা
মহাহইচই ফেলে দিয়েছিলেন, তাঁদের
বেশির ভাগেরই তো কোনো খবর আমরা
আর রাখি না। এই ধরনের সাফল্য টিকবে
না, যদি না প্রতিভা, সাধনা, অনুশীলন,
শিক্ষা আর সুযোগের সমন্বয় না ঘটে।
অল্প শিক্ষা, অল্প পরিশ্রম, অল্প দিনে
পাওয়া সাফল্য স্থায়ী হয় না।
রবীন্দ্রনাথের একটা সুন্দর গান আছে।
‘জোনাকি কী সুখে ওই ডানা দুটো
মেলেছ।’ তাতে তিনি বলছেন, ‘তুমি
নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই
বলে কি কম আনন্দ। তুমি আপন জীবন পূর্ণ
করে আপন আলো জ্বেলেছ।’ সবাইকে
তো চাঁদ-সূর্য-তারকা হতে হবে না।
জোনাকি নিজের সাধ্যমতো মনের
আনন্দে আলো দেবে। সে তখন ছোট
হয়েও আর ছোট থাকবে না।
সেটাই আসল কথা। আমরা যদি নিজের
সাধ্যমতো আলো দিই, ভালো কাজ
করি, নিজের জীবনটুকুই যাপন করে যাই,
সেটাই বা কম কী।
তবে আমেরিকান ড্রিমের মতোই ঘরে
ঘরে যে বাংলাদেশি স্বপ্ন দেখতে
পাচ্ছি, সেটাকে আমাদের স্বাগত
জানাতেই হবে। শুধু সেই স্বপ্নপূরণের জন্য
আমরা যেন অন্ধকারের পথে না হাঁটি।
সেটাও আসলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সুশাসন, আইনের শাসন নিশ্চিত হলে ১৬
কোটি প্রাণে জ্বলে ওঠা
বাংলাদেশি স্বপ্ন কেবল আলোকের
পথেই নিজেকে বিকশিত করতে
চাইবে, অন্ধকারের ফাঁকফোকর খুঁজবে
না।
বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি তার ১৬
কোটি নাগরিকের স্বপ্নের উপযোগী
হয়ে উঠুক।
প্রথম আলো থেকে নেওয়া