অনেকদিন পর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া। উদ্দেশ্য মেয়ে দেখা। অবশ্যই রাহুলের মেয়ে দেখার কোনো ইচ্ছাই নেই। শুধু বাবা-মায়ের চাপে পড়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই যাওয়া। রাতভর থেমে থেমে বৃষ্টি। ঘুমও হয়েছে দারুন। তারউপর রাতে মায়ের হাতের রান্না করা কইমাছের ভুনা খাওয়ার পর তৃপ্তির ঘুম এমনিতেই চলে আসবে। হলোও তাই।
রাহুলের একটা স্বভাব এখনো রয়ে গেছে। গ্রামের বাড়িতে গেলেই সকাল ৬টায় তার ঘুম ভাঙবেই। সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠেই সোজা বাড়ির সামনের ব্রিজে গিয়ে বসা। এসব অনেক দিনের অভ্যাস। অনেক পুরনো অভ্যাসও। তাই বাড়ি গেলে রাহুল এসব ছাড়তে পারে না। ফিরে যায় তার হাজারও শৈশব-কৈশোরের অম্লমধুর স্মৃতিসাক্ষী এই ব্রিজটির কাছে। অনেকটা সময় নিরবে কাটায়। পরিচিত দু'য়েকজন আসে। তাদের সঙ্গে কথা বলে।
গ্রামের মেঠো পথ এখন পিচঢালা রাস্তা। প্রতিদিন শত শত সিএনজি আর অটোরিকশার আসা যাওয়া এই রাস্তাটি দিয়ে। এসব দেখতে দেখতে রাহুল ভাবে কত পরিবর্তন হয়ে গেছে গ্রামটির। আসলে পরিবর্তন তো সবচেয়ে বেশি হয়েছে রাহুলের। বছরে সর্বোচ্চ ১৫/২০ দিন বাড়িতে যায় রাহুল। বাকি সময় ঢাকায় থাকে।
ব্রিজের উপর বসে আরেক বন্ধু শরীফের সঙ্গে দেখা। কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর শরীফ চলে যায়। রাহুলও চলে যাবার প্রস্তুতি নেয়। এমন সময় একটি অটোরিকশা তার সামনে দিয়ে গিয়ে কিছুটা দুরে থামে। আবার পিছনে ফিরে আসে। রিকশা থেকে একটি মেয়ে নেমে আসে। এসে হঠাৎই রাহুলকে বলে _
কেমন আছেন?
আমি ভালো! আছি কিন্তু আপনি..........
এই আপনি বলার পর রাহুলের কণ্ঠ থেমে আসে। তার মনে পড়ে যেন অনেক দিনের পরিচিত সেই কণ্ঠ। যে কণ্ঠ কখনো সে ভুলতে পারবে না। ভুলে পারে না। প্রতিনিয়তই তাকে মনে করিয়ে দেয় সেই কন্ঠ। হ্যা রাহুল ভুল শুনেনি। এটা নন্দিতারই কন্ঠ। নন্দিতার কণ্ঠ তো তার থেকে বেশি কেউ চেনার কথা না। রাহুলের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে নন্দিতা মিশেছিল একসময়। একসময়!!! আসলে একসময় না। এখনও আছে। এখনও রাহুল মনে করে নন্দিতাকে। মাঝে মাঝে রাতের ঘুম তার কাছে হারাম হয়ে যায়, সেটা নন্দিতারই জন্য। আজ এত বছর পর আবার নন্দিতা তার সামনে। সেই হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকে নন্দিতার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিল রাহুল। কিন্তু তখনকার দিনের বেকার রাহুল পারেনি নন্দিতাকে কাছে পেতে। তাদের প্রেম দুঃখের সাগরে ভেসে ভেসে ছোট ডিঙ্গি নোকায় চলে গেছে নন্দিতা তার স্বামীর বাড়িতে। আর রাহুল মনের দুঃখে গ্রাম থেকে চলে আসে শহরে। গ্রামের কত স্মৃতি নন্দিতাকে নিয়ে। রাহুল সবকিছু মনে পড়ছে। মনের জানালা দিয়ে আচ্ছন্ন ভাবে নাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ছে সব স্মৃতি। হ্যাঁ। সবকিছুই মনে পড়ছে রাহুলের। নন্দিতার সবচেয়ে নিষেধ ছিল রাহুলের ক্রিকেট খেলা নিয়ে। কারণ নন্দিতার ধারণা ছিল ক্রিকেট খেললে রোদে রাহুল কালো হয়ে যাবে। আর রাহুলের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল ক্রিকেট খেলা। ক্রিকেট খেলা ছাড়া তো আয়-রোজগারের ব্যবস্থাও থাকতো না। রাহুল অনেকবার নন্দিতাকে বোঝয়া। যে ক্রিকেট না খেললে তো আমার পকেটে টাকা আসবে না। আমি তো ভালো ক্রিকেট খেলি। বিভিন্ন জায়গায় খ্যাপ খেলতে যাই। টেপ টেনিস ক্রিকেটে রাহুলের এলাকায় তার খুব নামডাক ছিল। নন্দিতার তাতেই মহা আপত্তি। রাহুলের পকেট খরচের যত টাকা লাগে নন্দিতাই জোগাড় করে দেবে। তবুও যেন সে রোদে পুড়ে ক্রিকেট না খেলে। নন্দিতাই বলত, তুমি তো এমনিতেই কালো, তার উপর আবার রোদে পুড়ে এইসব ব্যাট-বল খেলা আমার ভালো লাগে না। আমার সোজা কথা তুমি আর এসব খেলতে পারবে না।
রাহুল তখনো নন্দিতাকে লুকিয়ে লুকিয়ে চলে ক্রিকেট খেলতো। রাহুলের স্পষ্ট মনে পড়ে, একদিন বিকেল বেলা খেলা পড়েছে। আর ওই সময়ই নন্দিতার স্কুল ছুটির সময়। রাহুল লুকিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে খেলতে রওয়ানা হয়েছে। কিছুদুর যেতেই দেখা গেল, নন্দিতা তার আরও দুইজন বান্ধবীকে নিয়ে ওই রাস্তা দিয়েই আসছে। রাহুলের যে তখন কি অবস্থা। সে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। নন্দিতা তার সামনে চলে এসেছে। কোন একজন বান্ধবী বলল রাহুল ভাই কেমন আছেন। রাহুল কোন উত্তর না দিয়ে নন্দিতাকে জিজ্ঞেস করল, নন্দিতা কেমন আছো। নন্দিতা কোন কথা না বলে হুলস্থুল ভাবে কান্না শুরু করল। কিছু বলল না। কোন কথা না। রাহুল ও নন্দিতার বান্ধবীরা নন্দিতার এই অপ্রস্তুত কান্নায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কোন কথা না বলে নন্দিতা চলে গেল।
রাহুলের মনে পড়ে এইরকম অজস্র স্মৃতি।
হঠাৎ নন্দিতার দিকে ফিরে তাকালো রাহুল।
আচ্ছা নন্দিতা বোরকা পড়া কেনো। নন্দিতা কবে থেকে বোরকা পড়ে। রাহুল নিজ মনে ভাবতে থাকে।
রাহুল বলে আরে তুমি? কেমন আছ? কোথায় আছ। কতদিন পর.....আর কিছু বলতে পারে না।
নন্দিতা : ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন। কতদিন পর আপনাকে দেখলাম। তাই গাড়ি থামালাম।
রাহুল : আমি গতকাল বাড়ি এসেছি। আজ আবার চলে যাবো। তুমি কোথায় যাচ্ছো এত সকালে?
নন্দিতা : আমি যাচ্ছি স্বামীর বাড়িতে। একসপ্তাহ আগে এসেছি।
নন্দিতা স্বামীর বাড়ি বলাতে রাহুল একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। দেখলো নন্দিতার একটু কাপেনি স্বামীর বাড়ি বলতে। তবে কি নন্দিতা রাহুলকে একদমই ভুলে গেছে......
রাহুল : তো কেমন আছে তোমার স্বামী?
নন্দিতা : জ্বি ভালো
এদিকে বারবার অটো ড্রাইভার ডাকছে নন্দিতাকে। আমি বললাম দাড়াও না একটু। এখন তো যাত্রী পাবে না। অটো ড্রাইভার আর কিছু বললো না।
নন্দিতা : বিয়ে করেছেন?
রাহুল : না করেনি। মেয়ে দেখতে এসেছি। তুমি তোমার বোরখার মুখটা একটু খেলো না। তোমাকে কতদিন দেখি নাই।
নন্দিতা : নিঃসংকোচভাবে বোরখার মুখ খুলে ফেলল।
রাহুল আরও অবাক হল। কোন কিছু নন্দিতাকে একবার বলে করাতে পেরেছে তা রাহুলের জানা নেই। কয়েকবার রিকোয়েস্টের পরই সে কাজটা করেছে নন্দিতা।
রাহুল নন্দিতাকে ভালো করে দেখছে। এই ৭/৮ বছরে কেমন যেনহেয়ে গেছে নন্দিতা। চেহারায় একটু মহিলা মহিলা ভাব চলে এসেছে। তবে তার সুন্দর মিষ্টি চাহনিটা এখনও রয়েছে।
রাহুল আস্তে করে বলল, নন্দিতা তোমার চুলগুলো কি এখনও আছে।?
এইবার কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল নন্দিতা। বললো, জানি না। আল্লাহই জানেন।
নন্দিতা : আপনি মেয়ে দেখেছেন। কেমন মেয়ে জানি না। আল্লাহই জানেন।
নন্দিতা কি যেন ভাবলো, তারপর বললো ভালো থাকেন। এই বলে গিয়ে অটোতে উঠল।
আমি আটাকতে চেয়েও আর আটকালাম না নন্দিতাকে।
শুধু তার চলে যাবার দিকে চেয়ে থাকলাম।
অটোতো উঠার সময় বললাম, নন্দিতা তোমার চুলগুলোর যত্ন নিও। মনে হচ্ছে নন্দিতার কণ্ঠ ধরে আসছে। সেও বললো, বিয়ে করেন, সংসারি হন। ভ।ালো থাকেন।