জল, জল, চারিদিকে এত জল কেন? অহনা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। দূরে ওটা কে দাঁড়িয়ে? রাতুল? রাতুল, তুমি তো জানো আমি সাঁতার জানিনা। হাসছো কেন? আমাকে বাঁচাও রাতুল, বাঁচাও...।
ঘুমটা হঠাত ভেঙ্গে গেল অহনার। দুপুরের এসময়টা কিছুই করার থাকেনা। শুধু এসময় কেন, সারাদিনই অহনার করার মত কাজ বিশেষ কিছু নেই। গান শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। গত রবিবার বইমেলায় রাতুলকে দেখার পর থেকেই এমনটা হচ্ছে। প্রথমে চিনতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। দশ বছর সময়টা একেবারে কমতো নয়। গায়ের রঙটা অনেক ফরসা হয়েছে, মোটাও হয়েছে অনেকটাই। কিন্তু হাসিটা দেখে চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি। সেই হাসি, যেটা দেখলেই অহনার মনে হত এই হাসিটা দেখেই একটা কেন, দুটো, তিনটে জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
রাতুলের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার মূহুর্তটা এমন কিছু নাটকীয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটা যেমন হয়। কলেজের গন্ডি পেরিয়ে এত বড় ক্যাম্পাসে অহনা কিছুটা গুটিয়েই ছিল। এত নতুন মুখ। তবে প্রাণখোলা হাসি আর স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দামতায় সবার মধ্যেও রাতুল ছিল বেশ ঊজ্জ্বল। প্রথম চমকটা এসেছিল নবীনবরনের অনুষ্ঠানে। রাতুল গেয়েছিল “তিমির-অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি কে তুমি মম অঙ্গনে দাঁড়ালে একাকী…”। গান শুনে কেমন একটা কাঁটা দিয়েছিল গায়ে। ছোট থেকেই রবীন্দ্রনাথ তার সবসময়ের সঙ্গী। দুই ঘরের ছোট্ট বাসায় বা বাসার বাইরে সমস্ত প্রতিকূলতার সাথে তাকে লড়াইয়ের শক্তি দিয়েছেন এই মানুষটি। গানটাও অনেকবার শোনা। কিন্তু এমন অনুভূতি এই প্রথম। অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিল অহনাও। রাতুল খুব প্রশংসা করেছিল সে গানের। সেই থেকেই পরিচয়ের শুরু। তারপর কবে সে পরিচয়টা ঘনিষ্ঠ হল, কবে রাতুলের অনুপস্থিতিতেও অহনার প্রতিটা মূহুর্তকে আচ্ছন্ন করে রাখল রাতুল, সেসব উত্তর তাদের কারো কাছেই নেই।
অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর অহনা আর তার মা অনেকটাই তার মামার ওপর নির্ভরশীল। কখনো কখনো নির্ভরশীলতা সঙ্গে করে নিয়ে আসে একরাশ সীমাবদ্ধতা। অহনার ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। এছাড়া ঘরে-বাইরে অসংখ্য লোভী হাতের ভীড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতে অহনা নিজেকে কেমন যেন গুটিয়েই নিয়েছিল। রাতুল তাকে ওই শ্যাওলা ধরা, দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে এক ঝটকায় বের করে এনে নতুন এক আকাশ দিয়েছিল, অহনার নিজের একটা আকাশ। পায়ে পায়ে হেঁটে এ শহরকে নতুন করে চিনেছে তারা। রাতুলের সাথে পরিচয় না হলে অহনা জানতেও পারত না রোজকার চেনা এশহরটার ভিতরেও একটা ‘জাদুর শহর’ আছে যেখানে এখনো চোখের পাতায় রূপকথা জমে।
পরের কতগুলো বছর কিভাবে যেন চোখের নিমেষে কেটে গেল, ভালো মূহুর্তগুলো যেমন হয়। সেটা গ্র্যাজুয়েশনের শেষ বছর। অহনার মা ভিতরে ভিতরে অহনার বিয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। আসলে পরনির্ভরশীল বাঙ্গালী নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে এখনো বোঝা হিসেবেই দেখা হয়। এছাড়া উচ্চবংশমর্যাদাসম্পন্ন, সুচাকুরে ইমরানের মত এমন পাত্রকে হাতছাড়া করতে অহনার মা চাননি। অহনা তাও শেষ চেষ্টা করেছিল, ছুটে গিয়েছিল রাতুলের কাছে। কিন্তু রাতুলের বাস্তবটাও যে কম কঠিন ছিলনা। অসুস্থ বাবা-মা, তিনটে ছোট ছোট ভাই-বোনকে নিয়ে এমনিতেই রাতুল হিমশিম খাচ্ছিল, এরমধ্যে হঠাত করে রাতুলের বাবার কারখানার লক আউট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অহনার বিয়ের প্রস্তাব। সময় চেয়েছিল রাতুল, অল্প কিছু সময়। কিন্তু সেই সময়েরই বড্ড অভাব ছিল অহনার। মাত্র চার দিনের মধ্যেই প্রায় বিনা আয়োজনেই অহনার বিয়েটা হয়ে গেল।
বিয়ের পরই দেশের বাইরে, ফিরতে ফিরতে দশ বছর কেটে গেল। তবে বিয়ের পরপরই অহনা বুঝে গেছিল আসবাবের মতই ঘরের শোভা বাড়ানো ছাড়া ইমরানের কাছে অহনার গুরুত্ব বিশেষ নেই। দেশে ফিরে পুরনো বন্ধুদের কাছে শুনেছিল পারিবারিক ঝড় সামলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল রেজাল্ট ও বিদেশে গবেষনা করে রাতুল সম্প্রতি দেশে ফিরেছে। তারপর হঠাতই সেদিন বইমেলায় দেখা হওয়া। অনেকটা সময় পাশাপাশি হেঁটেছিল ওরা, কথা বিশেষ হয়নি। কিন্তু নৈশঃব্দেরও তো নিজস্ব ভাষা থাকে। শুধু চলে যাওয়ার সময় অহনার ফোন নম্বর নিয়ে রাতুল জানিয়েছিল কোনোদিন দুপুরে সে ফোন করবে। তারপর থেকে প্রতিটা মূহুর্ত অহনা অপেক্ষা করেছে ফোনের। ফোন আসেনি।
ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর শুয়ে শুয়ে এসব কথাই ভাবছিল অহনা। হঠাত ফোন বেজে উঠল। অহনা জানে এ ফোনটা কার। কিন্তু অহনা উঠতে পারছে না। এতগুলো বাঁধ্ন ওকে বেঁধে রেখেছে- লোকলজ্জার, সামাজিকতার, অভিমানের। কিন্তু অহনাকে যে ফোনটা ধরতেই হবে। এই বাঁধনগুলো অহনাকে ছিঁড়তেই হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:৩৯