ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্কতা ও ঈমানের দাবী
মূল: মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আল হামদ
ইন্টারনেট তথ্যজগতে একটি বিশাল আন্দোলন নিঃসন্দেহে। তবে এই তথ্যজগতটি ঈমান আখালাক এমনকী বিবেক-বুদ্ধি পরীক্ষার একটি বিশাল ময়দানও বটে। যা শুভ ও কল্যাণকর তাও এখানে পুরোরূপে উন্মুক্ত, যা অশুভ-অকল্যাণকর তাও এখানে নানা ব্যঞ্জনে উপস্থাপিত। যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে সে তার জিহবা নির্বাধভাবে ছেড়ে দিতে পারে, সে তার দৃষ্টি যেখানে ইচ্ছা সেখানেই ঘুরাতে পারে, সে তার হাত দিয়ে যা চায় তাই লিখতে পারে। তাকে নিবারণকারী কেউ নেই, তাকে ধমক দেওয়ারও কেউ নেই, না আছে কেউ থামিয়ে দেওয়ার। সে যদি উর্দ্ধে উঠতে সক্ষশ হয়, পরিণামের প্রতি দৃষ্টি দেয়, তার প্রতিপালক তাকে দেখছেন এই বিশ্বাস হৃদয়ে জাগ্রত রাখে, তবে সে সফলতার সাথে প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সামনে এগুতে সক্ষম হবে। আর যদি সে নিজের লাগাম ছেড়ে দেয়, তার খায়েশ যেদিকে তাড়িত করে সেদিকে ধাবমান হয়, ঈমান ও তাকওয়ার প্রহরী তার হৃদয় থেকে বিতারিত হয়, তাহলে আবর্জনার স্তুপে ঢুকে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়, আর এর অশম্ভাবী পরিণতি হল অপদস্ততা, সুভদ্রতার মৃত্যু, নিকৃষ্টতা ও পঙ্কিলতায় নাক ঘর্ষণ।
ইন্টারনেট ও তার ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে বেঁচে থাকার জন্য কিছু পথ-পদ্ধতী রয়েছে, নিম্নে সেগুলো ইল্লেখ করা হল।
ইন্টারনেটের সদ্ব্যবহার:
বুদ্ধিমানের কাজ হল ইন্টারনেটের সদ্ব্যবহার করা। নিজেকে অতিরঞ্জিত আকারে বিশ্বাস না করা; কেননা এ ধরনের অতিবিশ্বাস নিজেকে ফেতনায় নিপতিত করতে পারে, যার করালগ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া হয়ত অসম্ভব হয়ে উঠবে।
যদি কেউ ইন্টারনেটে কোন কিছু পেশ করতে চায়, অথবা কোন মন্তব্য ইত্যাদি করতে চায়, তাহলে উচিত হবে প্রথমে বিবেচনা করে দেখা এর দ্বারা কোন উপকার হবে কি না, তাকে সতর্ক হতে হবে এর দ্বারা যেন মুমিনদের কোন কষ্ট না দেওয়া হয়, মুমিনদের কোন ক্ষতি না হয়। অতঃপর মুমিনদের মাঝে অশ্লীলতা ছড়ানোর সকল আকার-প্রকৃতি থেকে তাকে বিরত থাকতে হবে। অহেতুক কথা-বার্তা থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। মানুষের অনুভূতি নিয়ে তামাশায় লিপ্ত হওয়া, একে অপরকে অপবাদ দেওয়ার ডালি খুলে বসা, একদলকে অন্যদলের উপর চড়াও করে দেওয়া ইত্যাদি থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
কোন মন্তব্য অথবা কারো কথা খন্ডন করতে হলে ইলমনির্ভর, আদব, সদয়ভাব ও শালীন ভাষায় করা জরুরী। কোন কিছুতে অংশ নিতে চাইলে তা যেন হয় নিজস্ব ও সরাসরি নামে। সরাসরি নিজের নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভয় হলে উচিত হবে এমন কোন বিষয় না লেখা যা অবৈধ, অশিষ্ট। যে দিন মানুষের অন্তরাত্মা ইন্মুক্ত করে সবকিছু সম্মুখে নিয়ে আসা হবে সেদিন আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হওয়ার বিষয়টি হৃদয়ে সজাক রাখতে হবে।
শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ থেকে দূরে থাকা:
বুদ্ধিমানের উচিত শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ থেকে দূরে অবস্থান করা; শয়তান মানুষকে গোমরাহ করার জন্য ফাঁদ পেতে থাকে সারাক্ষণ। সকল পথ ও পদ্ধতি সে ব্যবহার করে যায় তার কর্মসিদ্ধির উদ্দেশ্যে। শয়তান মানুষেরে চিরশত্রু, যে শত্রু মানুষকে গোমরাহ করার মাকসদ নিয়ে যাপন করে প্রতিটি মুহূর্ত। আল্লাহ তা’আলা আল কুরআনের একাধিক জায়গায় বলেছেন, “তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের স্পষ্ট শত্রু”।
বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনই তার শত্রুর প্রতি আস্থা রাখে না। ফেনতার থাবায় নিজেকে কখনো সপে দেবে না। ফেতনায় পড়বে না বলে অধিক আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়বে না, জ্ঞানে, দীন ও ইলমে সে যে পর্যায়েই থাক না কেন।
বুদ্ধিমান ব্যক্তি বরং ফেতনা থেকে অবস্থান করে বহু দূরে। ফেতনার কাছিাকাছি যাওয়া থেকে সে যথেষ্ট সতর্কথা অবলম্বন করে। এসবের পরে যদি সে কখনো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফেতনায় নিপতিত হয়, তবে তা থেতে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য আসে। আল্লাহর করুণা তার সঙ্গ দেয়। আর যদি সে নিজের উপর অতিমাত্রায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে, নিজের নখর দিয়ে নিজের গোর নির্মাণ করে চলে, তবে তার ইপর থেকে আল্লাহর করুণা সরিয়ে নেওয়া হয়। তাকে একা ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইউসুফ আলাইহিস্সালাম নিজ থেকে ফেতনায় নিপতিত হন নি, ফেতনাই বরং তার মুখোমুখি হয়েছে, আর তখন তিনি আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়েছেন। ফেতনার বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় চেয়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে আল্লাহ যদি নারীদের ষড়যন্ত্র থেকে তাকে রক্ষা না করতেন তবে তিনি জাহেলদের দলভুক্ত হয়ে যেতেন। আল্লাহর উপর তাঁর প্রচন্ড ভরসার কারণেই আল্লাহর করুণা তার সঙ্গ দিয়েছে, ফলে তিনি ভয়াবহ বিপদ থেকে রেহাই পেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সময় নিধারণ ও উদ্দেশ্য নির্ণয়:
ইন্টারনেটের ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচার একটি উপায়, সময় নির্ধারণ ও সুনির্দিষ্টভাবে কীভাবে কি কাজ করতে হবে তা নির্ণয় করে নেওয়া, উদ্দেশ্য স্থির করে নেওয়া।
এর বিপরীতে অনির্দিষ্টভাবে যদি একটির পর একটি পেইজ ওপেন করে চলে, এক সাইটের পর অপর সাইট ভিজিট করে চলে, তবে অযথা সময় নষ্ট ব্যতীত অন্য কিছু আশা করা যায় না। যদি কোন উপকার আহরণে সক্ষম হয় তবে তা হবে খুবই ক্ষীণ।
পরিণাম দর্শন:
ইন্টারনেটের ফেতনা থেকে বাঁচার জন্য বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত হবে তার কৃতকর্মের পরিণামের প্রতি দৃষ্টি রাখা। নিজেকে দমন করা, নিজের প্রবৃত্তি-খায়েশের ঘারে লাগাম লাগানো। ইবনুল জাউযি রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘হে তাকওয়ার দ্বারা সম্মানের আসনে সমাসীন ব্যক্তি, তুমি তাকওয়ার সম্মানকে গুনাহের অপদস্থতার বিনিময়ে বিক্রি করো না। যে জিনিসের প্রতি তোমার খায়েশ জন্মেছে তা বর্জন করে তোমার প্রবৃত্তির তৃষ্ণা মেটাও, যদিও তা কষ্টদায়ক হয়, জ্বালা দেয়।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘প্রবৃত্তিকে দমনের শক্তিতে এমন স্বাদ রয়েছে যা সকল স্বাদকে অতিক্রম করে যায়; তুমি কি দেখো না, যারা প্রবৃত্তিতে আরোপিত তারা কিভাবে অপদস্থ হয়; কেননা তারা পরাজিত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি প্রবৃত্তিকে দমন করে তার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো; কেননা সে শক্তিমান হওয়ার সাক্ষর রাখে, কারণ প্রবৃত্তিকে দমন করায় সে পারঙ্গমতার পরিচয় দেয়।
যৌন আবেদনময় সকল বিষয় থেকে দূরে থাকা আবশ্যক:
যৌন আবেদন সুরসুরি সৃষ্টিকারী সকল বিষয় থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে দূরে থাকতে হবে। খারাপ ও পর্নো সাইটগুলো অবশ্যই বর্জন করতে হবে। যেসব ব্লগ সাইটে ফাহেশ-অশালীন কথাবার্তা বলা হয়, যেসব প্রবন্ধে প্রবৃত্তি উসকিয়ে দেওয়ার উপাদান রয়েছে, তা বর্জন করা ঈমান ও আখালাকের দাবী। আবেদনময় চিত্র-ছবি, কামনা-বাসনা উসকিয়ে দেয় এমন ফুটেজ থেকে দূরে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ; মানুষের মন সৃষ্টিগতভাবে প্রবৃত্তির প্রতি আসক্ত, প্রবৃত্তি যেদিকে টানে সেদিকেই সে চলতে শুরু করে। মানুষের মন বারূদ অথবা প্রেট্রোলতুল্য, যা জ্বালার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। এসব বস্তু প্রজ্জ্বলনকারী বস্তু থেকে যতক্ষণ দূরে থাকে, শান্ত থাকে, জ্বালার আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকে। আর এর অন্যথা হলেই তা জ্বলে উঠে, বরং জ্বলে উঠা স্বাভাবিক।
মানুষের মনও অভিন্ন প্রকৃতির। মানুষের মন শান্ত-নিরব থাকে। তবে যখন তা উসকিয়ে দেওয়ার মত কোন কিছুর নিকটবর্তী হয়, দুষ্টপ্রবৃত্তিকে জাগিয়ে দেওয়ার মত কোন শ্রব্য, দৃশ্য, পাঠ্য অথবা সম্পর্শে আসে তখন তার ঘুমন্ত প্রবৃত্তি দানবের মত জেগে ওঠে, তার ব্যাধিগুলো আন্দোলিত হয়ে ওঠে, তার খায়েশ-আসক্তি বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত হয়ে হাজির হয়। তাই এসব প্রবৃত্তি উদ্দীপক বিষয় থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি।
চলবে....(ইনশাল্লাহ)