[এর আগের পর্বটা রয়েছে এখানে: view this link]
"আমাদের নিঃসঙ্গতা" নামের লেখাটা (অর্থাৎ, এখানকার "আমাদের নিঃসঙ্গতা-১") "আমার ব্লগে" প্রথম পোস্ট করার পর, একজন ব্লগার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আমি কি নিঃসঙ্গতা কাটাতেই (বা নিঃসঙ্গতার ভারে ভারী সময় কাটাতে?) ব্লগে এসেছি কি না! না, আমি নিঃসঙ্গতা থেকে পালিয়ে বেড়াতে বা নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে ব্লগে আসি নি ৷ বরং সত্যি বলতে কি, আমার জীবনে "কাটানোর” মত কোন সময়ই নেই - প্রায়ই মনে হয় দিনে যদি ২৪ টির চেয়ে আরো বেশী কিছু ঘন্টা বা "extra hours" থাকতো ৷ "নীরব একাকীত্ব” কখনো কখনো খুব উপভোগ্যও হতে পারে - হতে পারে খুবই productive ৷ আমি দেখেছি অনেকে "নীরব একাকীত্ব” পছন্দ করেই নাবিকের জীবন বা চা-বাগানের কর্মজীবন বেছে নেন/নিয়েছেন ৷ সেই বেছে নেয়া নিঃসঙ্গতা নিয়ে বলার কিছু নেই ৷ কিন্তু যে নিঃসঙ্গতা মানুষকে কুরে কুরে খায়, অস্থিরচিত্ত করে তোলে, যার প্রভাবে রাত যত গভীর থেকে গভীরতর হয় অস্থিরতা তত বাড়তে থাকে - মানুষ এক ওয়েব সাইট থেকে আরেক ওয়বে সাইটে ঘুরতে থাকে "একটু সঙ্গের আশায়” - হোক না তা virtual companionship ! মানব জীবনের এই দুর্বিষসহ নিঃসঙ্গতা খুবই demeaning - তা মানুষকে ভিখারীসুলভ ও vulnerable করে তোলে ৷ এরকম অবস্থার বশবর্তী হয়েই হয়তো মানুষ আবোল তাবোল বলতে ও লিখতে শুরু করে ৷
একটু সময় নিয়ে স্থির-মস্তিষ্কে আমরা ভেবে দেখতে পারি: এভাবে "খরচ হয়ে” যাবার জন্যই কি মানুষের জন্ম হয়েছে? "আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশী তাকে দেবো” - এরকম কথার আদলে আপনি বলতেই পারেন যে, "আমার জীবন আমি যেভাবে খুশী ব্যয় করবো, তাহে তোমার কি?” কিন্তু এই কথাটা কি ঠিক? না ঠিক নয়! কারণ মানুষের অস্তিত্ব রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বিচিছন্ন "এক ইউনিট” ইঁটের মত নয় - বরং মানুষ হচ্ছে একটা দেয়াল বা structureএর মাঝে সিমেন্ট দিয়ে লাগানো "একটা ইউনিট” ইঁটের মত - যেটা হঠাৎ "ছুটিয়ে নিতে চাইলে” structureএর সব কিছু এলোমেলো হয়ে যেতে পারে ৷ একজন মানুষই, একাধারে ভাই/বোন, ছেলে/মেয়ে, চাচা/ফুফু, মামা/খালা, বাবা/মা, বন্ধু/বান্ধবী, শত্রু, প্রেমিক/প্রেমিকা, স্বামী/স্ত্রী - আরো কত কি!! এভাবে ভাবলে, যখন কেউ বলবেন যে, "আমার জীবন আমি যেভাবে খুশী ব্যয় করবো, তাহে তোমার কি?” তখন তার বক্তব্যকে খুবই selfish মনে হতে পারে ৷ সেজন্যই, কোন ঔপন্যাসিকের লেখার "প্রভাবে” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের কোন মেয়ে আত্মহনন করেছেন বলে যখন অনুমান করা হয়, তখন কেউ সেই ঔপন্যাসিককে বাহবা দেন না - বরং তাকে লেখালেখিতে আরো দায়িত্বশীল হতে বলেন ৷
আমি অনেক সময়ই সময়ের, মেধার, স্মৃতিশক্তির বরকত/সাশ্রয় চেয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি - যদিও তিনটা ব্যাপারে দোয়া চাওয়ার কথা বললাম, তবু আসলে সব গিয়ে আবার একটা বিষয়েই ঠেকে - সময়! ঢাকার রাস্তায় যখন ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাফিক জ্যামে মানুষ আটকে থাকে, শত সহস্র মানুষ নিষ্ফল সময় কাটাতে থাকে, খরচ হতে থাকে লক্ষ লক্ষ টাকা মূল্যের জ্বালানী - তখন আমি ভাবতে চেষ্টা করি: এভাবেই খরচ হয়ে যাওয়ার জন্যই কি মানুষের সময় বা জীবন?
১ জন মানুষের ১ ঘন্টা সময় = ১ man-hour ৷ আবার ১০ জন মানুষের ১ ঘন্টা সময় = ১ x ১০ = ১০ man-hour ৷ এভাবে হিসাবের একক ধরলে, কর্মমুখর সপ্তাহের ৫ দিনে এই ঢাকা শহরেই প্রতিদিন হয়তো ১ কোটি man-hour অপচয় হয় ৷ ঢাকা ছাড়াও অন্তত আরো দু’টো শহর - চট্রগ্রাম ও সিলেটের অবস্থাও খুব শোচনীয় ৷ এছাড়া জ্বালানীসহ অন্যান্য অনেক কিছুর অনুৎপাদনশীল ব্যয় বা অপচয় তো রইলোই ৷ যান-জটের ভিতর বসে আপনি আপনার সময় কাটাতে গান শোনেন, বই পড়েন, ভুট্টার খৈ (পপ-কর্ন) চিবান, অথবা অর্থহীনভাবে যন্ত্রযানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন - অথচ এই কাজগুলোর কোনটির জন্যই আপনি রাস্তায় নামনে নি - এগুলো কেবলই "কিছু করার জন্য করা” কাজ ৷ আপনি অস্থির চিত্তে ভাবতে থাকেন, ঐ দুর্বিষহ অবস্থার অবসান হবে কখন, আর আপনি সেই গন্তব্য বা কাজে গিয়ে পৌঁছাতে পারবেন, যে জন্য আপনি পথে নেমেছেন ৷ ব্লগর ব্লগর করে জীবনের অত্যন্ত মূল্যবান সময় বা সোজা কথায় বলতে গেলে, জীবনের "জীবনটুকু” অপচয় করার সাথে কোথাও যেন ট্রাফিক জ্যামে বসে নিস্ফল সময় ও সম্পদ অপচয়ের অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে ৷ এখানেও, অর্থাৎ ব্লগেও, আমরা যে কাজগুলো করি (লেখালেখি, ব্লগর ব্লগর যাই বলুন না কেন) সেগুলোও যেন "ট্রাফিক জ্যামে” বসে কেবলই "করার জন্য করা" কিছু কাজের মত - কিছুতেই এগুলো "জীবন কাটিয়ে" দেয়ার মত কাজ হতে পারে না ৷ আর কারো জীবন যদি কেবল এগুলো-কেন্দ্রিকই হয়, তবে ব্যাপারটা ঐ সম্ভাবনার মতই ভয়ঙ্কর যে, কেউ ট্রাফিক জ্যামে বসে থেকে দিনের কজের সময়টুকু "খরচ” করাকেই উপভোগ করেন এবং রোজ জীবনের সময়টুকু গন্তব্যে বা কর্মস্থলে না গিয়ে পথেই কাটিয়ে দিতে পছন্দ করেন ৷
আমাদের, ব্যাপারটা নিয়ে খুব seriously চিন্তা করা উচিত - কারণ, আমরা অনেককেই প্রায় সারাদিন reckless ও restless ব্লগিং-এ মেতে থাকতে দেখি ৷ বিষয়টা আরো ভয়ঙ্কর এই জন্য যে, ব্লগারদের অধিকাংশই তরুণ - আর তাই এরাই হচ্ছেন জনসংখ্যার সবচেয়ে কর্মক্ষম, সম্ভাবনাময়, সক্ষম, প্রাণপূর্ণ ও মেধাবী অংশ; আর বলাই বাহুল্য যে, আমাদের গরীব দেশের এরাই সবচেয়ে বেশী "সুবিধাভোগী” [অন্তর্জাল ব্যবহারকারী] ক্ষুদ্র সেই জনসমষ্টি, যাদের দিকে সমাজ, দেশ বা জাতিগঠনের প্রত্যাশা নিয়ে সবাই তাকিয়ে থাকেন ৷ কিন্তু "যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়” যদি নিষ্ফল বাক-যুদ্ধেই কেটে যায়, তবে সত্যিকার জীবন-যুদ্ধের গুরুভার কি তারা বহন করতে পারবেন? আর কিছু বিবেচনায় না আনলেও, কেবল "বস্তুবাদী" উন্নতি, GDP ইত্যাদি বিবেচনা করলেও, তারুণ্যের এই গতি/প্রকৃতি কি সুস্থ, গঠনমূলক বা ইতিবাচক??
[চলবে ইনশা'আল্লাহ্ .......]
জ্ঞাতব্য: এই লেখাটি আগে এই ব্লগে এবং অন্যত্রও প্রকাশিত হয়েছিল।