somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফুল, পাখি, দাদা ম্যাচ, রাজহাঁস, দেবদারু গাছ আর আমাদের সম্পর্ক: একটি কবিতার বই পাঠের অভিজ্ঞতা

১৯ শে জুন, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যখন কথা বলি, প্রথমেই ভাবি অনেক সহজ করে অল্প কথায় বলব। প্রচুর বলি, ঘুরিয়ে বলি, পেঁচিয়ে বলি, সহজ আর হয় না। অন্য অনেক কিছু হয়। গদ্য প্রথম প্রথম দীর্ঘ বাক্যে লিখতাম। এখন ছোট। দীর্ঘ বাক্যে শব্দ আর তাদের সম্পর্ক ছাড়িয়ে কখনও কখনও অন্য দ্যোতনাও এসে হাজির হয়েছে, জ্ঞাতে, অজ্ঞাতে। পড়ে নিজেই উচ্ছ্বসিত হয়েছি। ছোট বাক্যে তা বড় একটা আসে না। এই যে বর্তমান শব্দ, শব্দের পরিক্রমণ, শব্দের সম্পর্ক ছাপিয়ে অন্য কিছু আসা, অন্য কোনও ভাব আসা, অন্য কোনও উচ্ছ্বাস হাজির হওয়া, অনেক অনেক দিন পর, আর একবার পেলাম আনসার আলীর কবিতায়; 'ফুল, পাখী ও অন্যান্য' কাব্যগ্রন্থে। একবার পেয়েছিলাম সেই কুমার নদীতে। ছোট্ট ডিঙি নৌকার সাথে আকবর বাদশার সম্পর্ক। একবার গাঁদা ফুলের সাথে সম্পর্ক হতে দেখেছিলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, সেন্ট মার্টিন যেতে যেতে। সেসব কথা এখন বলতে গেলে অন্য অনেক কথা বলা হবে, কিন্তু সেই সহজ ও সাবলীল সম্পর্ক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আমি যখনই কোনও বই বাসায় আনি, প্রথম কয়েকদিন বইটা পড়ি না। রাখি। কাছে কাছে রাখি। শোবার সময় মাথার কাছে, পড়ার টেবিলে, খাবার টেবিলে, এমনকি মেঝেতে সতরঞ্চি বিছিয়ে চা খেতে খেতে বইটা নাগালের মধ্যে রাখি। দেখি। নাড়ি। চাড়ি। পড়ি না। একসময় পড়ি। আনসার আলির বইটাও তাই। পড়ছিলাম না। রাখছিলাম। সেই ফাঁকে পড়ে ফেলল আমার ছয় বছরের কন্যা। পড়ে সে কিছুই বোঝেনাই। না অর্থ, না তার অন্তর্গত ভাব। সেসব তার অজানা। কিন্তু কয়েকটা শব্দ আর শব্দগুচ্ছ, তাকে বড় আনন্দ দিল। আমাকে ডেকে বলল, 'বাবা দেখ, লিখেছে, মানুষের ভিতরে থাকে মানুষ। বাইরে দেবদারু গাছ।' কী মজা, তাই না বাবা? বাবা, আমার ভিতরে কি মানুষ আছে? বাবা, আমার বাইরে কি দেবদারু গাছ?

আমি বড় চমকে যাই। আমি বড় শব্দহীন হয়ে যাই। আমি ছুটে চলে যাই আনসার আলীর কাছে। আমি দেবদারু গাছের পাতার কাছে গিয়ে বসে থাকি। তার মধ্যে সন্ধান করতে থাকি এক অচেনা মানুষের। আমি আমাকে দেবদারু গাছের মতো করে চিড়ে তার ভেতরের মানুষটার কাছাকাছি চলে যেতে চাই। যেতে গিয়ে আবিষ্কার করি, আমার করাতে সেই আগের ধার আর নাই।

আনসার আলীর বইয়ের ভূমিকা পড়ে জানতে পারি, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির যন্ত্রের শব্দের ফাঁক গলে গলে তার কাছে আসে কবিতার শব্দবন্ধ আর তাদের সম্পর্কের পরম্পরা। তারা এসে একে অপরের সাথে সম্পর্ক করতে থাকে। কিংবা সম্পর্ক করতে করতে তারা আসে। যেমন সম্পর্ক করে আমাদের শহরে একদিন এসে যায় একজন আনসার আলী আর দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি। কথাটা শোনামাত্র একজন কবি আনসার আলী আলাদা মনোযোগ পেয়ে যায়। আমার কাছেও তাই পেয়েছিল। ফলে আনসার আলীকে চিনতে আমি ভুল করে ফেলি। আর আনসার আলী আমার কাছ থেকে দূরে চলে যান। আমি স্পষ্টই বুঝি যে তিনি দূরে চলে গেলেন। তখন আমি তার নাগাল পেতে চাইলাম। দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির যন্ত্র আর যন্ত্রণা আমি বন্ধ করতে চাইলাম। আনসার আলীর বইটাতে একটা ব্রাউন পেপারের মলাট দিয়ে দিলাম। রেখে দিলাম অন্য শতেক বইয়ের ফাঁকে। আমার মেয়ে কয়েকদিন বইটা খুঁজে খুঁজে হয়রান হল। ভাবল তার মজার ছড়ার বইটা বুঝি গেল। এও আরেক সম্পর্ক। আমার ছয় বছরের মেয়ের কাছে কেন কবিতা ভালো লাগবে? পুরো কবিতা ওর ভালো লাগে না। ভালো লাগে একটা লাইন। ওর ভালো লাগে, 'এতটুকু উঠানে এতো রাজহাঁস ক্যানো?' এই কথাটি। জানি না এই কথা ওর কাছে এসে কী সম্পর্ক করে। আমি কোনওদিন তা জানতে পারব না।

আমার বড় বিপদ। আমি আনসার আলীকে মলাট দিয়েও ভুলে যেতে পারি না। শেষে মলাট খুলেই আনসার আলীকে নিয়ে বসি। 'ফুল, পাখী ও অন্যান্য' নিয়ে বসি। আবার আমার সাথে এসে সম্পর্ক করে 'অন্য'রা। সম্পর্ক করে সব্যসাচী হাজরা, বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী, সম্পর্ক করে তৌহিদ এনাম ফাউন্ডেশন, বইয়ের প্রকাশক। সম্পর্ক করল ভূমিকায় লেখা আনসার আলীর কথাগুলো। আনসার আলীর কবিতার সাথে এদের কোনও সম্পর্ক নাই। অন্তত কবিতা পড়ার সময় সে সম্পর্ক রাখতে নাই।

সব ভুলে আমি কবিতায় ঢুকলাম। কবিতা পড়লাম। আমি এক ঝটকায় পাখির কাছে, ফুলের কাছে চলে গেলাম। চলে আসলাম। তাদের কাছে আমার মনের কথা খুলে বললাম। পাখিরা বলল। আমি শুনলাম। আমি সম্পর্ক করলাম। আনসার আলীর কবিতার মতো সহজ সম্পর্ক। তোমাকে উঠানে না দেখার মানে তুমি কিশোরগঞ্জ চলে গেছ। এমনই সহজ সেই সম্পর্ক। কী অনায়াস! কী দায়িত্বহীন! কী সুন্দর! একটি কবুতরের সকালে গিয়ে দুপুরে আধার নিয়ে ফিরে না আসার মানে আজ সবুজে গোলাগুলি হয়েছে। এইসব সূতা, এইসব সম্পর্ক পুঁজি করে এগিয়ে যাই, এগিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু সূতা ছিঁড়ে আমার আর ফিরে আসা হয় না। আমি কেবল এগিয়েই যাই। সম্পর্ক করি। সহজ সমীকরণ করি। বীজগণিতের মতো সম্পর্ক করি। আমার সামনে চশমার পাওয়ার আর চশমার দামের সাথে গাণিতিক সম্পর্ক হয়ে ঝুলে থাকল দাদা ম্যাচ, ঝুলে থাকে ইনকাম ট্যাক্স। আমি তারে পারি না এড়াতে।

কোনও একদিন একজন যুবকের যুদ্ধে চলে যাবার সাথে আজকে তার আর তার পরিবারের অনাহারে থাকার কি সহজ সম্পর্কই না চিরন্তন হয়ে গেল আমাদের সবার অজান্তে। স্থায়ী হয়ে গেল। আমরা তা হতে দিলাম। আমরা এর অন্যথা হতে দিলাম না। হারান মাঝির মৃত বউয়ের পোড়ার সাথে সোনার গান্ধী মুর্তির যেমন সম্পর্ক, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির লোহালক্করের মাঝে বসে যন্ত্রের প্রবল শব্দের সাথে সাথে দম নিয়ে সজোরে কবিতার পড়ার সম্পর্কও একই। অথবা এখন আমাদের শহরে মৃত মৃত বাগানে তাজা কারনেশন ফুল ফোটার সাথে সিরাজগঞ্জের পোতাজিয়ার চরে বক্কর মিয়ার দুই হাঁটুর মধ্যে ধরা মাটির দোনায় শুকনা গাভীর ওলান থেকে টেনে বের করা দুধের চড় চড় শব্দের খুব ছোট কিন্তু গভীর একটা সম্পর্ক রয়েছে। শনিগ্রহের একবার সূর্য প্রদক্ষিণের সাথে সম্পর্ক রয়েছে বকুল ফুলের মাঝখানের গর্তে, গর্ভাধানে একফোঁটা শিশিরের নিঃশব্দে গড়িয়ে ঢুকে যাওয়ার।

আর আমরা কি না সম্পর্ক খুঁজি বিগব্যাঙের সাথে ঈশ্বরের। পৃথিবীসৃষ্টির। কিংবা হয়ত ভালো থাকা না থাকার সাথে রাজনীতির। সাম্যের। কী এমন এসে যাবে এইসব ছেঁড়া সূতার মিহি সম্পর্ক খুঁজে না পেলে? দুটি চোখ খুলে সাবলীল আর নির্মোহ ফিকিরে দেখে গেলেই তো হয়, কেমন করে শহরের মধ্যিখানে এক একটা আস্ত মানুষ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক একটা সঙ্গীহীন দীর্ঘ দেবদারু গাছ?
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×