somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাসপাতালের দিনগুলি

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাইকেল থেকে পড়ে আর্মের হাড় বা হিউমেরাস ভেঙে যাওয়ার জার্মানির কোলন শহরের এক হাসপাতালে কাটিয়েছি দীর্ঘ সতেরো দিন৷ এর মধ্যে দু'টি সার্জারির মধ্য দিয়ে যাওয়ার তেমন প্রোডাক্টিভ কোন কাজ হয়নি যদিও, তবু বেঁচে আছি; এতেই মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে শোকরিয়া, আলহামদুলিল্লাহ।

এক,
গভীর রাতে যখন ঘুম ভেঙে যায়, ঘুম আসে না আর। তখন শুরু হয় জেগে থাকার দু:খ। পৃথিবীর সব মানুষ ঘুমিয়ে আছে, অথচ আমি ঘুমাতে পারছি না৷
যখন একজন মানুষ সমাজের সবার অর্থবিত্ত দেখে চকিত হোন, অথচ তার নিজের নেই। তখন তার মধ্যে শুরু হয় বেদনা। অমর্ত্য সেন এর নাম দিয়েছেন আপেক্ষিক বঞ্চনা তত্ত্ব।
এক বিশেষ রাতে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে শেখ সাদী তার বাবার সাথে মসজিদে গেলেন, শেখ সাদী তখন ছয় বছরের শিশু৷ তখন রাতের শেষ প্রহর, মসজিদে অনেক লোক থাকলেও তাদের প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ কেউ অর্ধ জাগরণে আছেন। শেখ সাদী তার বাবাকে বললেন, বাবা তুমি আমি ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আমরাই জেগে আছি। শেখ সাদীর বাবা ছিলেন বুযুর্গ লোক। তিনি বললেন, তাহলে আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। অন্যের থেকে নিজেকে মহৎ মনে করার চেয়ে ঘুমই ভালো।
কোলন শহরের সেন্ট ফ্রানজিসকুস হসপিটালে আজ আমার তেরোতম দিন, দ্বিতীয় সার্জারির পর চতুর্থ রাত। জার্মানির হাসপাতালগুলোতে সিট ফাঁকা থাকে না, সার্জারির ক্ষেত্রেও রোগীর অবস্থা বিচারে লাইন লেগে থাকে। মূলত রাষ্ট্রকর্তৃক বাধ্যতামূলক ইন্সুরেন্স পলিসি সবার চিকিৎসা পাবার অধিকার নিশ্চিত করে।বহুদিন আমার ঠিকঠাক ঘুম হয় না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় রাতে কিংবা শুরু হয় শরীরের অস্বাভাবিক আচরণ। লেখতে গিয়ে বারবার ফিরে আসি, কিছু বই সাথে থাকলেও পড়তে পারি না। মাঝে মাঝে কান্না চলে আসে, মাঝে মাঝে অর্থহীন স্বপ্ন দেখি৷ এগুলো হয়তো ব্যাথার ওষুধ অক্সিকোডনের প্রভাব। অক্সিকোডন মরফিনের সমগোত্রীয়, যা ক্যান্সারের রোগীদের ব্যাথা উপশমেও দেওয়া হয়। দশ-বারো বছর আগে পড়েছিলাম, হুমায়ুন আহমেদ তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার দিনলিপি নিয়ে নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ নামে একটি বই লেখেছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ এই অর্থহীন স্বপ্নগুলোর কথা উল্লেখ করেছিলেন। যদিও তখন ধরতে পারিনি সত্যি, কিন্তু অক্সিকোডনের প্রভাবে কিংবা প্রচন্ড ব্যাথার দৌরাত্ম্যে বুঝেছি সেই অর্থহীনতার মানে৷
২৭ শে অক্টোবর, ২০২৩
সেন্ট ফ্রানজিসকুস হসপিটাল, কোলন, জার্মানি

দুই,
তোমার নিজের দেশের কোন জিনিসটি তোমার সবচেয়ে ভালোলাগে? অপরিচিত, তবু সপ্তাহখানেক একসাথে থাকবার কারণে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল মিশেলস নামক লোকটির সাথে।
সতেরোটিদিন পরদেশের এক অপরচিত হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাটিয়েছি৷ দু:সহ সেইসব দিন, যেন মনে করতে চাই না আর।
উত্তরে বলেছিলাম পদ্মা নদীর কথা। দেশ নামক ধারণাটি আমার মধ্যে গড়ে উঠেনি কখনও। যদিও ঢাকা শহরে জীবনের প্রায় দশটি বছর কাটিয়েছি, তবু দেশ মানে আমাদের ঝনকির দুপ, দেশ মানে পদ্মা পাড়ের মাতাল হাওয়া৷
"বাসুদেব সিদ্ধার্থকে বললেন, নীরবে মন দিয়ে শেখার বিদ্যা শিখেছি নদীর কাছ থেকে; তুমিও মন দিয়ে তা শিখবে। নদী সব জানে, নদী সব শেখাতে পারে। এরই মধ্যে নদী তুমাকে শিখিয়েছে নিম্নাভিমুখী হয়ে গভীরতায় ডুবে যাওয়া ভালো। হাজার হাজার পথিকের কাছে নদী কেবলই বাধা, মাঝি সেই বাধাকে দূর করেন। কিন্তু সেই হাজার হাজার লোকের ভীড়ে খুব কম লোকই নদীর গোপন বাণী শুনতে পেয়েছে; নদীর পবিত্র রূপটি দেখতে পেয়েছে।"
হেরমেন হেসের সিদ্ধার্থের বর্ণনায় নদীর কাছ থেকে এমন শিক্ষা পাওয়া যায়। যেন অপার অপলক মুখোমুখি বয়ে যাওয়া শুধু; জ্ঞানে, ধ্যানে শির নত করতে শেখা।
এমন এক নদী যাকে পূজো করা হয়, তাকে পাই গঙ্গা রূপে। এমনই তীব্র ছিল তার স্রোত, যে দেবী পৃথিবীর সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তাই গঙ্গাকে রাখা হলো ভগবান শিবের মাথায়। এরপর তার চুলের জটা বেয়ে ভূমিতে নেমে এলেন দেবী গঙ্গা।
বলেছি, এতো বড় জার্মান দেশ, কিন্তু পুরোটা তো তোমার নয়। তুমি হয়তো বার্লিনে যাওনি কিংবা হামবুর্গ তোমার কাছে অচেনা। জন্মস্থান হিসেবে তোমার কাছে যেমনটি আছে কোলন শহরের মাহত্ম্য, অন্যকোথাও কিংবা অন্যকিছুতে হয়তো নেই।
১লা নভেম্বর, ২০২৩
জিগেন, জার্মানি

সংযুক্তি: কয়েকটি ছবি


১) দ্বিতীয় সার্জারির পরে আমার ফিজিওথেরাপিস্ট দূর থেকে কোলনের বিখ্যাত কোলনার ডম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।


ডোমের ছবিকে মার্ক করে দিয়েছি।


২) এ যেন এক পাগল করা জোছনা।




৩) হাসপাতালের দেয়ালে থাকা একটি সাধারণ চিত্রকর্ম




৪) একটি সাধারণ সকাল





৫) হাসপাতালের ভেতরে ছোট একটি প্রার্থনালয় (গীর্জা)। জার্মানিতে গীর্জাকে কিরসে বলা হয়।



সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:১৭
১৯টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

×