ছোটবেলা থেকে যে কয়েকটা কথা খুব নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু পর্যন্ত শুনেছি, তা ছিল “এইভাবে লেখাপড়া করলে আর মানুষ হতে পারবানা”। ব্যক্তি আমি লেখাপড়ার বাইরের বিষয় আর জগৎ নিয়েই বেশি উৎসাহী ছিলাম। তাই আম্মার প্রায় মাসিক এই ভবিষৎবাণীর উত্তরে একবার “আমি তো মানুষই, বলো শিক্ষিত হইতে পারবা না” বলায় পিঠে যে কিল বসেছিল, অনেকদিন আমাবশ্যার রাতে তা ফেরত এসে চিন-চিন করে ব্যাথায় জানান দিত!
সিনেমার মত ফ্ল্যাশব্যাক সেরে ফিরে এলাম ২০১৬ তে। পেপারে পড়লাম প্রথমে খাদ্যের বিষক্রিয়ায়, তারপর পরকীয়ায়, এবং সর্বশেষ “মানুষ হতে পারবেনা” এই আশংকায় এক মা তাঁর দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন! মামলায় আসল ঘটনা হয়ত এখনো প্রমাণিত না, তবে ঘটনার পেছনের ঘটনা খতিয়ে দেখার সময় হয়ে গেছে।
সবাই ক্লাসে প্রথম হতে চায়, সবাই চায় সর্বোচ্চ নম্বর। তা সে এখনো চায়, আগেও চাইত বাবা-মা রা। কিন্ত একটা সময় হয়ত শিক্ষকের আদর্শ বিষয়টা নিয়ন্ত্রন করত। শিক্ষকেরা অনেকটাই পিতৃ-মাতৃসুলভ আচরন করতেন। পড়ার বাইরে জীবনচারণ, মনুষ্যত্ব আর স্বপ্নের শিক্ষা দিতেন। তখনো স্যার-আপাদের কাছে যেয়ে পড়ার বা গৃহশিক্ষক এর রেওয়াজ ছিল। কিছু কিছু স্কুলের কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকারা তখনো তাঁর কাছে “কোচিং” না করলে নম্বর কম দিতেন, সবারই জানা। কিন্ত সেই কোচিংয়েও কেউ কেউ সাফল্যের, জীবনের গল্প শোনাতেন।
আর এখন? আমার প্রথম শ্রেণী পড়ুয়া ছেলের জন্য গৃহশিক্ষক প্রয়োজন, এই স্কুলে টিকে থাকতে হলে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকেই কোচিং আর তৃতীয় শ্রেণী হলে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের কাছে দৌড়ানো, নাহলে চলবেনা শোনা যাচ্ছে! আজকাল কি স্কুলে ক্লাসে গল্প হয়? শুনেছি ড্রইং পরীক্ষাতেও ৫০ এ ৫০ তোলার জন্য নাকি আর্ট স্কুলে যেতে হয়, নাহলে উড়ে যেতে হবে! হোক সত্য বা মিথ্যা, একজন অভিভাবক এর মাথায় “সন্তান মানুষ হবেনা, তখন কি হবে” এর যে পরিমাপক, তা হলো শুধুই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর। মানুষ কোন পর্যায়ের মানসিক চাপে গেলে, এই চিন্তা করে নিজের সন্তান হত্যা করতে পারে?
কেউ কি বুঝতে পারছে, ঘটনার অন্তরালে পুরো সিস্টেমটা ভেঙে পড়ছে? আস্তে আস্তে জীবনবোধ ধ্বংস হচ্ছে? পশ্চিমা “উন্নত” দেশে আজও নিয়ম করে লাইব্রেরিতে যেয়ে গল্পের বই পড়তে উৎসাহ দেয়া হয়। আর আমরা তো গল্পের বই পড়ার সময়-সুযোগই দিচ্ছিনা। “ফেসবুক বন্ধ করো, বই বেশি পড়ো” বলে বছরের সবচেয়ে ছোট মাসে গলা ফাঁটিয়ে লাভ কি হবে?
এমন ঘটনা আরো ঘটবে আগামীতে, যদি এই ইঁদুর দৌড় ঠিক না করা যায়। ইঁদুর যখন কুকুর হয়ে দৌড়াবে, তখন পাগল কুকুর কামড়াতেই থাকবে সমাজের গায়ে! ঠিক করার মানুষ পাওয়া যাবেনা, কারন ততদিনে “মানুষ” সব রোবট হয়ে যাবে!
এমনই কোন বৃহস্পতিবারে কি রোবট হয়ে যাব আমিও? আপাতত লম্বা সপ্তাহান্তের শুভেচ্ছা!
শুভ সপ্তাহান্ত!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:৩১