somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আরও একটি গল্প

০৫ ই আগস্ট, ২০০৬ সকাল ৮:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পূবকান্দা

"ও নগেন, এ আমারে কোনহানে আইনা ফালাইলিরে বাপ, আমার যে দম বন্ধ হইয়া যায়। ও নগেন, নগেন রে"।

ঃ এট্টু চুপ করেন দিনি, সারাদিন তারে ডাক পারেন, সে তো আহানে বাড়ি নাই। এট্টু চুপ করবার পারেন না? - বাসনত্দির গলায় বেশ ঝাঁজ।

পিঁপড়ার মা বুড়ি তার ছেলের বউ বাসনত্দির এই তীর্যক বাক্য শুনতে পান না বোধ করি, ঘরের দাওয়ায় বসে তিনি আবারও বলেন, "ও নগেন, নগেনরে, এ আমারে তুই কোনহানে আইনা ফালাইলিরে বাপ, কিছুইতো চিনি না, এটটা চিনা মুখও নাই, সারাদিন এই ঘরের মইদ্যে বইস্সা বইস্সা আমার মাজাহান তো গ্যালোরে, ও নগেন, নগেনরে"।

এরপর বাসনত্দি আর কথা বলে না। চুপচাপ শুনে যায়, নিজের কাজ করে। বুড়ি সারাদিন এরকম বকতে থাকে, কতো আর প্রতিবাদ করা যায়, দিনরাত ওই একই কথা, "এ আমারে কোনহানে আইনা ফালাইলিরে বাপ?" যেনো সাধ করে তাকে এখানে কেউ নিয়ে এসেছে। বুড়ি যেনো জানে না কেন এখানে আসা _ বাসনত্দি মনে মনে গজরায়।

এইতো মাত্র মাস পাঁচেক হলো ওরা এখানে এসেছে। জায়গাটা কোথায় বাসনত্দি ঠিক বলতে পারে না। তবে নগেনের কাছে শুনেছে কোলকাতা নাকি এখান থেকে তিন ঘন্টার পথ, রেলে যেতে হয়। অবশ্য তাতে বাসনত্দির কিছুই এসে যায় না, কোলকাতা কোনও দিন যাওয়া হবে কি না তার নেই খবর, তা কোলকাতা কোথায় সেটা জেনে তার কী হবে?

এই জায়গার খবর দিয়েছিল নিতাই মণ্ডল। ওরা অনেকদিন হয় এখানে এসেছে, বেশ জমিয়ে বসেছে বলতে হবে। স্টেশনের কাছে একটা মুদি দোকান খুলেছে। পার্টিকে চাঁদা দিয়ে-থুয়ে নিজেদের স্থানটা বেশ ভালোই পোক্ত করে ফেলেছে। আসলে টাকা থাকলেই সব হয়, নগেনের টাকা নেই, কোনও কালে ছিলও না, থাকার মধ্যে ছিল শুধু বাপ-দাদার ভিটেটা, তাও যদি পিঁপড়া কলেরায় ভুগে না মরে যেতো সেই ভিটেও দুই ভাগ হয়ে গেলে নগেনের বুঝি ভেসে যাওয়া ছাড়া গত্যনত্দর ছিল না। ভগবান যা করেন ভালোর জন্যই করেন, অনেক বছর ছেলেপুলে হতো না বলে শচীরাণীর প্রথম ছেলের নাম রাখা হলো পিঁপড়ে, সোনা ঠাকুরই বলে দিয়েছিলেন, একেবারে ফ্যাল্না গোছের নাম রাখতে হবে যাতে যমের চোখ না পড়ে। তো সেই পিঁপড়েও মরে গেলো কলেরায়। তারপর যখন নগেন হলো, তখন আর নাম নিয়ে ভাবেননি শচীরাণী, ছেলেটাকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনেই সমসত্দ শক্তি ৰয় করেছেন। তবু লোকে কিন্তু শচীরাণীকে পিঁপড়ের মা বলেই ডাকে, নগেনের মা কেউ আর বলে না। সে আরেক ইতিহাস, এখন তো পিঁপড়ের মাও কেউ বলে না, বলে পিঁপড়ের মা বুড়ি, বুড়ির বয়স এখন কতো তা কে জানে? অবশ্য এখানে আর পিঁপড়ের মা বলেও ডাকারও কেউ নেই। যে যার তালে, যে যার ধান্দায় আছে।

বাসনত্দির মনে পড়ে নগেন আজ তাকে নিতাই মণ্ডলের কাছে যেতে বলেছে। রেশন কার্ড করে দেওয়ার জন্য নিতাই মণ্ডল আজ বাসনত্দিকে নিয়ে যাবেন এক পার্টি-নেতার কাছে। সকালে উঠেই মনে হয়েছে বাসনত্দির কিন্তু ভেবেছে একটু বেলা হলে তারপর যাবে। নগেন তো বেরিয়ে গেছে সেই কাকভোরে, কোথায় কোন্ কারখানায় নাকি শ্রমিক নিচ্ছে, সেখানে গিয়ে লাইন দেবে। এরকম তো কদ্দিন ধরেই দিচ্ছে লাইন, কিন্তু কিসের কি, কোনও কাজ নেই। বাসনত্দি এক কাপ চা নিয়ে গিয়ে বুড়ির সামনে রেখে বলে, "আমি নিতাই খুড়োর কাছে যাইতাছি। আফনে কিন্তু ঘর থিকা বাইর ওইয়েন না। সেদিনের মতো পথ আরাইলে কেউ আপনেরে তালাশ করবার পারবি নানে এই কইয়া দিলাম।" বাসনত্দির গলাটা শেষ দিকে খুবই কর্কশ হয়ে ওঠে।

কর্কশ হওয়ার অবশ্য কারণ আছে। এই পাঁচ মাসে বুড়ি তিন বার ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। "কী, তিনি দ্যাশে যাবেন। আরে বুড়ি তোর কী দ্যাশ আর আছে নাকি? দ্যাশের পথতো পুইরা গ্যাছে। যেদিন পূবকান্দা থিকা কাকপৰী জাগার আগে নৌকায় পা রাখছি সেইদিন থিকাইতো দ্যাশের সব কিছু চিতায় তুইলা দিয়া আইছি" _ বাসনত্দি মনে মনে ভাবে, আর ওর গলার স্বর আরও কর্কশ হয়ে ওঠে।

এই সেদিনও বাসনত্দি কোথায় যেনো গিয়েছিল, এসে দ্যাখে বুড়ি নেই। বুড়ি যেনো কোথায় চলে গেছে। বাসনত্দি ভেবে পাচ্ছিলো না কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে। এখানে বাসনত্দিদের মতো দেশ ছেড়ে আসা অনেকগুলো পরিবারই আছে কিন্তু সবাইতো আর ওদের গ্রামের নয়, গ্রাম ছেড়ে পাশের গ্রামেও বা বাসনত্দির কি কখনও যাওয়া হয়েছে যে ও কাউকে চিনে রাখবে? বাপের বাড়িও তো সেই একই গাঁয়ে, এ পাড়া আর ও পাড়া। ইস্ বাসনত্দির বাবা-ভাইয়েরাও দেশ ছেড়েছে বটে, কিন্তু তারা আছে বনগাঁ না রাণীগঞ্জ বলে কোন্ একটা জায়গায়। এখনও সঠিক জানে না বাসনত্দি, নগেন বলেছে খোঁজ এনে দেবে, কিন্তু পাঁচমাস হলো কোনও খোঁজই এলো না। এসব ভেবে বাসনত্দির চোখে জল আসে, বাসনত্দি সেই জল চোখেই হাঁটতে থাকে নিতাই খুড়োর দোকানের দিকে।

নিতাই খুড়ো দোকানে ছিল না, দোকানে একটা উঠতি বয়সের ছোকরা বসে আছে। এই ছোকরাকে বাসনত্দির ভালো লাগে না, বেশি পাকা। বাসনত্দিকে দেখেই একগাল হেসে বললো, "নিতাই দা এইমাত্র হাগতে গেলো, এুনি এসে পরবে, আপনি বসুন বউদি, বসুন না"। এখানকার লোকেদের কথাবার্তা বাসনত্দির কানে কেমন যেন শোনায়, এখনও অভ্যসত্দ হয়ে উঠতে পারেনি। নগেন কিন্তু এরই মধ্যে বেশ আয়ত্বে এনে ফেলেছে ভাষাটা, কিন্তু বাসনত্দি পারেনি, ও বোধ হয় এ জন্মে আর পারবেও না। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বাসনত্দি দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে।

দেখতে দেখতে শীত এসে গেলো, কার্ত্তিক মাস চলে। ওরা এসেছিলো যখন ভরা আষাঢ় মাস। থৈ থৈ জল চারদিকে। জলের ওপরও তখনও ভাসেনি শাপলা, সেতো সেই শ্রাবণের শেষাশেষি। আহারে এই কার্ত্তিক মাসে "নাইল দিয়া ইলিশ মাছের ঝোল" কি যে স্বাদের ছিল, দেশ ছাড়ার সঙ্গে এরকম অনেক স্বাদের খাবারও ওই দেশে ফেলে এসেছে। বাসনত্দির মনের ভেতর রাগ হয় খুব, কী দরকার ছিল এখানে আসার? থাকলেই হতো মাটি কামড়ে পড়ে পূবকান্দায়। ছেলেপেলে তো হয়নি, আর হবে কি না তাও জানে না। ওখানেই মরে-পুড়ে গেলে হতো না?

"না এই খানে আর থাকা চলে না। বাড়িটা আর সামনের পালানটা বিক্রি কইরা যা দুই পয়সা পাওয়া যায় তাই লইয়া চলো বাইর ওই। কয়দিন পরেতো এই বাড়ি এমনিই দখল ওইয়া যাবেনে, তহন কী করবা?" নগেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আপন মনেই যেনো এসব কথা বলতো। বাসনত্দি কোনও উত্তর দিতো না কথার, কী বা উত্তর দেবে। ওর মনে হতো, বুড়ি শাশুড়ি আর ক'দিন বাঁচবেন, তারপর তো দু'টি মাত্র পেট, কী দরকার ভিটে ছেড়ে যাওয়ার। কিন্তু কে শোনে কার কথা, বাবন মেম্বরের কাছে ঘটি-বাটি বিক্রি করে নৌকোয় উঠে তবে নগেনের শানত্দি। পথে আসতে আসতে নগেনের সে কি কান্না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। বুড়ি শাশুড়িটা সেই নৌকোয় বসেই শুরম্ন করেছিলেন, "ও নগেন, কী ওইলো তোর? ও নগেন, তুই কান্দস ক্যান বাপ? ও ভগবান, দ্যাহো আমার বুইড়া ছাওয়ালে কান্দে" _ দাঁতহীন মুখে বুড়ির হাসিটা তখন বড্ড কুৎসিত দেখাচ্ছিলো বাসনত্দির চোখে।

ওদের সূর্য উঠেছিল প্রায় ফরিদপুর শহরের কাছে এসে। সেখান থেকে বাসে করে বেনাপোল, তারপর ট্রেণ, সেই যে ট্রেন থেকে নেমে এইখানে ওরা ঢুকেছে আর কোথাও বের হওয়া হয়নি। বুড়ি তো প্রতিমুহূর্তে হেঁদিয়ে মরছে, "ও নগেন, আমার পাও দুইখান যে ভাইঙ্গা নিয়া যায় রে, এট্টু চলবার-ফিরবরাও তো জাগা নাইরে নগেন, ও নগেন"। নগেন যখন থাকে তখন মাঝে মাঝে মাকে ধমক দেয়, "তুমি থামবা মা, আমি বাঁচি না আমার জ্বালায়, তুমি এখন চলবার-ফিরবার জাগা চাও, কতো কষ্টে এই একচালা পাইছি জানো? নিতাই খুড়ো না থাকলে যে কী ওইতো, ভগবান জানে। ঘর-বাড়ি বেইচা যা সাথে আনছিলাম তাতো ফুরাইলো বইলা, তারপর খাবানে কি হেই চিনত্দায় বলে আমি মরি, আর তুমি আছো তোমারে নিয়া"_ নগেন মাথায় হাত দিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে।

" ও নগেন, থাকলাম তো কয়দিন, এ্যাহন চল না বাড়ি ফিরা যাই। এহেনে আমার বালো লাগে না, কোনও হানে যাবার পারি না, কাউরে বুলাইয়া একখান কথা কবো কি কিছু পুচ্ করবো তারও জো নাই। ও নগেন আমারে তুই দিয়া আয়রে বাপ, এহেনে আমার মন টেহে না"।

পিঁপড়ার মা বুড়িকে বাড়ি বিক্রি করে এখানে পাকাপাকি চলে আসার কথা জানানো হয়নি। কয়েক বছর হলো পিঁপড়ার মা'র মাথায় একটু গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতেন, সন্ধ্যের দিকে বাড়ি ফিরে কিছু মুখে দিয়েই ঘুম। সংসারের কোনও কাজেই তার মন ছিল না। একাত্তরে পিঁপড়ার বাবা মারা যায়, নগেনের বয়স তখন বছর বারো হবে। তারপর এই বাড়ি আর ছেলেকে বড় করেছেন পিঁপড়ার মা মানুষকে গাছ-গাছালির শেকড়-বাকড়ের জড়িবুটি দিয়ে। তাও নগদ পয়সায় নয়, কখনও কলাটা, মুলোটা, কখনও বা সের খানেক চাউল কেউ যদি দিয়ে গেছে তবে তাই নিয়েই নিদান দিয়েছেন পিঁপড়ার মা। আচানক নিজেই একদিন পাগল হয়ে গেলেন, সারাদিন শুধু বলতেন, "ও পিঁপড়ার বাপ আপনে যাইয়েন না, আর সবাই যাক, আপনের যাওয়ার কী কাম? আমাগো ফালাইয়া যাইবেন আপনার পরানডা পুড়বে না?" কখনও কখনও বলতেন, "এ্যাদে তোরা ওই ফেউচ্চাডারে এট্টু খ্যাদা দেহি, ফেউচ্চায় কয় গৃহসত্দের ঘর পুড়ুক আমি ছাই খাই"_ বলেই জোরে চেঁচিয়ে উঠতেন পিঁপড়ার মা। একাত্তরে মিলিটারিরা হিন্দু পাড়ার একটি বাড়িও রাখেনি, সব জ্বালিয়ে দিয়েছিল, পিঁপড়ার মা'র মাথা খারাপ হওয়ার পর এই খবর সবারই জানা হয়ে গিয়েছিল, নইলে পাড়ার ছেলেমেয়েদের তো কারোই এসব কথা জানা ছিল না। অল্প দিনের মধ্যেই পিঁপড়ার মা'র বয়স যেনো কুড়ি বছর বেড়ে গেলো, কুঁজো হয়ে হাঁটেন, হাঁটতে হাঁটতে কিছুৰণ পর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, কোমর ধরে দাঁড়িয়ে থেকে কী যেনো ভেবে আবার চলতে শুরম্ন করেন।

কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো, এখানে আসার পর বুড়ি আর কখনও সেরকম পাগলামির কিছু বলেন না। শুধু বার বার বলেন, "ও নগেন চল না বাপ আমারে থুইয়া আসফি। বিলাইডা পার কইরা দিয়া আসফি বাপধন আমার, আমার এহেনে বালো লাগে না আর। বাড়ি যাবো বাপ, বাড়ি"। নগেন রাগ হয়ে বলে, "বাড়ি যাবার চাও যাও, আমারে আর জ্বালাইও না, আমি মরি আমার নিজের জ্বালায়, ও বাসনত্দি মারে এহেন থেকে সরাইয়া ন্যাও দি"।

কিন্তু বাসনত্দি সরিয়ে নেবেটা কোথায়? বাসনত্দি এটা ওটা করে, করারও কি ছাই কাজ কিছু আছে? এক কামরার একটা একচালা টিনের ছাপড়া গোছের ঘর। ছোট্ট একটু বারান্দার মতোও আছে আবার, সেখানেই বুড়ি সারাদিন থাকেন। তারই এক কোনে তোলা উনুন। কয়লা দিয়ে রান্না, কিন্তু এ জীবনে বাসনত্দি কয়লা দিয়ে কখনও রান্না করেনি, জানতোই না কয়লার ব্যবহার। এখন ধীরে ধীরে শিখছে, এখানে ঘুঁটেও কিনতে হয় নগদ পয়সায়। বাসনত্দির বুকের ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে আসে। আগে বুড়ি যখন শক্ত-পোক্ত ছিলেন তখন প্রতিদিন চক-পাথার ঘুরে ঝাকা-ভর্তি গোবর এনে নিজেই ঘুঁটে দিতেন, 'মুইঠ্যা' বানিয়ে রাখতেন বর্ষার জন্য। এখানে এসে আর সব কষ্ট ছাঁপিয়ে গেছে রান্নার কষ্টটা। বাসনত্দি বালতি ভর্তি জলের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই জলের ভেতর ওর চোখ থেকে জল পড়ে, দু'এক ফোঁটা কিন্তু জল তবু বাড়ে না।

আজও বাসনত্দি ভেবেছে যাওয়ার সময় যদি কোথাও থেকে একটু শুকনো ডাল কিংবা অন্য কিছু পাওয়া যায় জ্বালানোর জন্য তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু নিতাই খুড়োর দোকানে বসে বসে বাসনত্দি চারদিকে তাকিয়ে কোথায় এসব খুঁজতে যাবে ভেবে পায় না। দোকান থেকে অল্প দূরেই রেল লাইন দেখা যায়, চলে গেছে অনেক দূরের দিকে, বেশ ব্যসত্দ রেল লাইন, এরই মাঝে দু'তিনটে গাড়ি আসা-যাওয়া করলো। নিতাই খুড়ো কখন যে আসবেন, এভাবে দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে থাকতে বাসনত্দির ভালো লাগছিলো না মোটেই। দোকানের ছেলেটা তো বটেই আরও লোকজন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বাসনত্দি অস্বসত্দির তীব্রতা সামলাতে সামলাতে দেখতে পেলো নিতাই খুড়ো আসছে।

"কি বউ, কখন আইলা? আমার শরীলডা বেশি বালো না বউ। সকাল থিকা এই নিয়া পাঁচবার ঘাটে গেলাম, দুব্বল লাগতেছে খুব"_ নিতাই মন্ডল নাকি সুরে কথা বলে।

ঃ তাইলে আইজ নয় থাউক খুড়ো। _ বাসনত্দি হতাশা গিলে বলে।
ঃ না গো বউ, চলো যাই কষ্টে-মষ্টে। মাইতি দা'রে আমি কতা দিছিলাম তোমারে নিয়া আইজ যাবো তার কাছে। না গেলে যদি আবার রাগ অয়। চলো বউ।

নিতাই মণ্ডল একটা সাইকেল রিঙ্া ডেকে তাতে উঠে বসে। বাসনত্দির লজ্জা করে তার পাশে বসতে কিন্তু লজ্জা ফেলে রিঙ্ায় উঠে বসতেও সময় লাগে না। এই প্রথম শহরটা দেখছে বাসনত্দি। খুব ঘিঞ্জি, মনে হচ্ছে এই রেলস্টেশনকে ঘিরেই ছোট্টখাটো শহর, ফাঁক ফোঁকর দিয়ে দূরে সবুজ জমিজমা দেখা যাচ্ছে। বাসনত্দির এক দৌড়ে সেখানে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ হওয়ার আগেই ওরা একটা বড় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। বেশ গাছপালা ঘেরা বাড়িটা, ভেতরে নতুন দালান।

রিঙ্ার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নিতাই মণ্ডল আগে আগে বাড়ির ভেতর ঢুকে হাঁক দেয়, "মাইতি মহাশয় আছেন নিকি?"

ঘরের বারান্দা থেকে একটা মোটা গলার স্বর শোনা যায়, "ভেতরে এসো মণ্ডল, ভাবছিলাম বেরম্নবো একটু, বেশ তো লেট করিয়ে দিলে"_ এখানকার ভাষা, বাসনত্দির কানে লাগে খুব। মনে হয়, ও বুঝতে পারলেও ভাষাটাকেও কেমন বিদেশি বিদেশি লাগে।

ওরা বারন্দায় ঢুকে দেখে অনেকগুলো চেয়ার পাতা সেখানে, একটা টেবিলের সামনে এক ভদ্রলোক বসে আছে। বাসনত্দির মনে হয়, ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের ওপারে, ধুতির ওপর শাদা শার্ট পরনে। ঘরটা একটু অন্ধকার বলে বাসনত্দি লোকটার চেহারা ঠিক ঠাহর করতে পারে না। ওদের চেয়ারে বসতে ইশারা করলেও বাসনত্দি দাঁড়িয়ে থাকে, ঘোমটায় মুখ ঢেকে। নিতাই মণ্ডলই কথা শুরম্ন করে লোকটার সঙ্গে।

"এই হইতেছে নগেনের বউ মাইতিদা। এর লাইগ্যাই আপনেরে কইছিলাম। আইছে আইজ পাঁচ মাস ওইলো। এ্যাহনও কোনও কাম-টাম পায় নাই। আপনে যদি খালি র্যাশন কার্ডটা কইরা দ্যান তাও খাইয়া-পইরা বাঁচবে, আপনে কইছিলেন কইরা দিবেন"_ নিতাই মণ্ডলের গলায় আকুতি ঝরে পড়ে।

ঃ বলেছিলাম তো, কিন্তু খবরের কাগজগুলো যা শুরম্ন করেছে, তাতে শিগগিরই কিছু করতে পারবো বলে তো মনে হয় না। কয়েকজন বড় নেতার বিরম্নদ্ধেই তো অভিযোগ তোলা হয়েছে রেশন কার্ড জালিয়াতির। এখন সবার চোখ এদিকেই, চোখটা একটু সরালেই করে দেবো, তুমি ভেবো না মণ্ডল। তা পরিবারে ভোট ক'টা?

ঃ তিনটে মাইতি দা।
ঃ মাত্র? সেকি আমি তো জানতাম বাঙ্গালরা খেতে যেমন পারে, তেমনই ছেলেপুলে জন্মাতেও তাদের কমতি নেই। মাত্র তিনটে ভোটের জন্য তো আমি অতো বড় রিস্কটা নিতে পারি না হে মণ্ডল। আরে রেশন কার্ড হয়ে যাওয়া মানেই তো সব হওয়া, এই দেশে বৈধ হয়ে যাওয়া, এই দেশের ভোটার হয়ে যাওয়া, এতো বড় কাজটি করে বিনিময়ে কি এলো সেটাও তো দেখতে হবে নাকি মণ্ডল?

ঃ তাতো অবশ্যই মাইতিদা, অবশ্যই_ নিতাই মণ্ডল আমতা আমতা করে।
ঃ তা ছেলেপেলে হয়নি কেন? বয়সটা কেমন দেখি, ঘোমটাটা সরাও তো?
ঃ বউ ওরকম ঘোমটা দিয়ে খাড়াইয়া রইলা ক্যান, ঘোমটা সরাও, তোমারে দ্যাখবার চায় মাইতি দা'।
বাসনত্দি অনেক কষ্টে মুখটা একটু বের করে দাঁড়ায়, অন্ধকার ঘরে তাতে খুব একটা হেরফের হলো বলে মনে হয় না।

ঃ তা ছেলেপুলে হয়নি কেন? দোষটা কার? তোমার নাকি তোমার বরের? _ মাইতি আবার প্রশ্ন করেন।
এখন এই প্রশ্নের উত্তরে বাসনত্দি কী বলবে? সনত্দান না হওয়া নিয়ে তার নিজের দুঃখ ব্যাপক, নগেনেরও দুঃখ আছে বাসনত্দি বোঝে, কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশির দুঃখটা যেনো একটু বেশি বেশিই ছিলো। এখানে আসার পর কারো সঙ্গে ওর তেমন পরিচয় নেই বলে তাকে এ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি তেমন একটা হতে হয় না। অনেক দিন পর প্রশ্নটা শোনার পর বাসনত্দি হতচকিত হয়ে গেলো, তার ওপর প্রশ্নকর্তা একজন পুুরম্নষ। বাসনত্দি নিরম্নত্তর দাঁড়িয়ে থাকে।

ঃ শরীর-স্বাস্থ্য তো মন্দ নয়। বয়সটাও বোধহয় চলিস্নশ পেরোয়নি, এখনও নিশ্চয়ই সময় আছে, চেষ্টা-টেষ্টা করে যাও, হলে হতেও পারে। তা রান্নাবান্না কিছু জানো নাকি?
ঃ জানে মাইতিদা, আমি নিজে খাইছি অগো বাড়িত, শুদ্দুর বাড়ির বউ, আবার গরিব, শাকপাতা খারাপ রান্দে না। ক্যান আপনাগো বাড়িত রাখবেন নি রান্দার লাইগ্যা _ নিতাই মণ্ডল উৎসাহি হয়ে প্রশ্ন করে।

ঃ নাহ্ ভাবছিলাম, আজ কেউ নেই বাড়িতে। সবাই গিয়েছে কোলকাতায় আমার শালার ছেলের অন্নপ্রাসনে। তাই কেউ যদি একটু রেঁধে দিতো খারাপ হতো না। তুমি এক কাজ করো না মণ্ডল, ওকে বরং এখানে রেখেই যাও। দুপুরের রান্নাটা করে খাওয়া-দাওয়াটা এখানেই সেরে একটা রিঙ্া ডেকে ওকে পাঠিয়ে দেবোৰণ। নয় আরেক কাজ করো, এখন তুমি যাও, বেলা পড়লে ওকে এসে নাহয় নিয়ে যেও, কী বলো মণ্ডল?

ঃ আপনি যা কইবেন মাইতি দা। তাইলে বউ তুমি থাকো, আমি যাই, বেইল পড়লি কাউরে পাডাইয়া দিবানে তোমারে নিয়া যাওনের লাইগ্যা। _ শেষের কথাগুলি বাসনত্দির দিকে ফিরে বলা।

এরপর নিতাই মণ্ডল ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, বাসনত্দি দাঁড়িয়ে থেকেই বুঝতে পারে, নিতাই মণ্ডল ঘর থেকে বেরম্নলো, তারপর সদর পেরিয়ে রাসত্দায় গিয়ে দাঁড়ালো রিঙ্া ধরার জন্য। ভাবতে ভাবতে বাসনত্দির ইচ্ছে করছিলো এক ছুটে গিয়ে নিতাই মণ্ডলকে বলে, "আমারে লইয়া যান খুড়ো, এইহানে আমারে ফালাইয়া রাইখা যাবেন না খুড়ো, দোহাই আপনার ভগবানের। ও খুড়ো .... খুড়ো গো....." _ বাসনত্দির বুকের ভেতর থেকে উথলে ওঠে কান্না। কান্না রম্নখতে বাসনত্দি মাথার ওপর অাঁচলটা আরও টেনে দিয়ে দেয়ালের দিকে আরও একটু সরে দাঁড়ায়।

ঘরের নীরবতা ভেঙে মাইতি বলে, "এ কি, তুমি দেখছি একদম জড়ভরত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে, এদিকে এসো, তোমাকে দেখি। বাঙাল মেয়েরা কিন্তু বেশ চটপটে হয়, তোমাকে তো মনে হচ্ছে একদম কাপড়ের পুঁটলি হয়ে গিয়েছো"। বাসনত্দি এরপরও তার দিকে এগিয়ে না গেলে মাইতিই উঠে এসে বাসনত্দিকে তার দিকে টেনে নেয়, তারপর বাসনত্দির কানে কানে বলে, "আসলে হয়েছে কি জানো, বাড়িতে কেউ নেই, বড্ড একা একা লাগছে। তাই তোমাকে রেখে দিলাম গল্প করার জন্যে। রান্না-বান্না করাই আছে, আর আমি বেশি কিছু খেতেও পারি না, অম্বল হয়, বুঝলে" _ বাসনত্দিকে আরও কাছে টানতে টানতে মাইতি আরও অনেক কিছু বলে, আরও অনেক কিছুই করে।

শেষ বিকেলে ঘরের সামনে নগেনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরে খবর দেওয়ার পর বাসনত্দিকে নিয়ে মাইতি নিজেই বেরিয়ে আসে। তারপর নগেনের দিকে তাকিয়ে বলে, "কী হে, তোমার পরিবারে ভোট মাত্র তিনটে, এর জন্যই এখন আমাকে একটা বিরাট রিস্ক নিতে হচ্ছে, কী আর করা। তুমি এক কাজ করো, মাঝে মাঝে আমাদের রান্নার লোকের অভাব হলে বাসনত্দিকে একবার পাঠিয়ে দিও দিকিনি। এর রান্নার হাতটা দেখছি ভালোই"।

ঃ জে পাডাইয়া দিবানে, আপনে শুধু খবরটা দিয়েন।
ঃ আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু মুশকিল হলো ওই যে, মাত্র তিনটে ভোট _ মাইতি ঘরের দিকে ফিরতে ফিরতে বলে।

বাসনত্দি নগেনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পেছন দিকে মুড়ে কী মনে করে যেনো বলে, "ভোট তিনডা না, ভোট পুনারডা। আপনে পুনারো জনের লাইগ্যাই র্যাশন কার্ড বানাইয়েন"।

রিঙ্ায় বসে নগেন জানতে চায়, "কী রে, পুনারডা ভোট কইলি ক্যা? অতো মানুষ তুই কুহানে দেখলি?"
ঃ তুমি বুঝবা না, তিনজনও যা, পুনারও জনও তাই। তুমি খোঁজ কইরা আমার বাপ-ভাইরে এহেনে নিয়া আইসো গিয়া, তাগো না পাইলে আমাগো গ্রামের অন্য কাউরে, তারো না পাইলে যারে পাও তারে আইতে কউ, র্যাশন কার্ড এ্যাহন পাইতে কোনও অসুবিদা অবে নানে। আমি এ্যাহন র্যাশন-কার্ড দেওনের যাদু শিখছি বুঝলা...

বাসনত্দি হা হা করে হাসতে থাকে, রিঙ্া চালকও ফিরে তাকায় সেই হাসিতে।
বাসনত্দির গলার স্বরে কী ছিল কে জানে, নগেন চুপ করে থাকে। রিঙ্া চলে ওদের টিনের একচালার দিকে। বাইরে তখন সন্ধ্যা হয় হয় করছে।

দুই.
বাসনত্দি বেরিয়ে যাওয়ার পরও অনেকৰণ পিঁপড়ার মা বুড়ি ঘরের দাওয়ায় বসে নগেনকে ডেকেছেন। কেউই সাড়া দেয়নি, দেওয়ার কথাও নয়, কেউতো নেই সেখানে। তারপরই বুড়ি বেরিয়ে পড়েছেন।
সমসত্দ দুপুর হেঁটেছেন। এখন সন্ধ্যা উতরে গেছে, বুড়ি হাঁটছেন রেল লাইন ধরে, কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে খুব, কিন্তু কী আর করা, নগেনতো নিয়ে যাবে না, বুড়ি একাই চলেছেন পূবকান্দার দিকে। পূবকান্দা আর কতোদূর কে জানে?


সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×