একটি চেয়ার সবসময় অপেক্ষায় আমার পুবের ব্যালকনিতে। রৌদ্রছায়ার খেলা আমার ওখানেই চলে। ওখানেই ধরাদেয় আমার শিশু থেকে বুড়োকাল, জীবনের সকাল, বিকেল ও সন্ধ্যা। একটুখানি সুখ হয়ত আমার হৃদয়ে পুষে রাখা দুঃখের কূল ছাপিয়ে দাড়িয়ে যায় বর্তমানের অবলম্বন হিসেবে। আজও তেমনি বসেছি অনুভুতিকে ঝালিয়ে নিতে। আমার প্রানপ্রিয় সহধর্মিনী একটু আগে দিয়ে গেল এক মগ স্বর্গসুধা, যার উড়ন্ত ধোয়া আর সকালের রোদ মিলেমিশে আমার মস্তিস্ক টিউনিং করায়। শুরু হয় নিউরণের হাসাহাসি। রৌদ্রকণা আমার লোমকুপে উকি দিয়েই চামড়ার ভেতর গড়াগড়ি করতে থাকে। আর আমি আমার গত হওয়া আটপৌরে জীবনের পাতা ওল্টাতে থাকি। হঠাৎ রোদ্দুরে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা জোড়া চোখের পাতা ভার হয়ে নেশানেশা লাগে, গ্রীলের ডায়মন্ড আকৃতির হেলানো ছায়া যেন দুলতে থাকে, সাথে সাথে দুলতে থাকে আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকার অসহায় ইচ্ছা।
চায়েরকাপে একটি করে চমুক দিই আর নিরব স্মৃতির জাল ছড়িয়ে আমার ছেলেবেলাকে খিলখিল করে হাসতে দেখি। আমার কিশোর মুখের ছবি বর্তমানের এ বৃদ্ধ মুখমণ্ডলে বসিয়ে নিজেকে চেনার চেষ্টা করি। এ্যলবামে ঠাঁই নেয়া আমার বাবার সাথে আমাকে মেলাতে চাই।
আমিও শিশু ছিলাম, আমারও বাবা ছিল-
ভালবাসার একটা ঘর ছিল
মায়ের আদর ছিল
আমার পড়ার টেবিল ছিল
পরিক্ষার ব্যস্ততা ছিল
যৌবন ছিল
যৌবনের বন্ধু ছিল
ছিলনা শুধু অবশ্যম্ভাবী আজকের জন্য সামান্য প্রস্তুতি।
হঠাৎ করে বুকের হৃৎপিণ্ড দৌড়াতে শুরু করে, ইচ্ছে করেও তখন তাকে হাঁটাতে পারিনা, বুঝতে পারি আমি অনিয়ন্ত্রিত। ঠিক তখনি আমার স্কন্ধে চিরজনমের পরিচিত মানুষীর আলতো স্পর্শ অনুভব করলাম। আমি কোন দিনই এই মানুষটির চলে যাওয়া মেনে নিতে পারব না, তার সঙ্গে প্রায়ই এ বিষয়ে কথা হয়। সে জানে আমি খুব জেদি মানুষ। তার সহজ স্বীকারউক্তি, আমার আগে সে কোনদিন আমাকে ছাড়বে না, বলতে বলতে মায়াবী অসহায় চোখ গড়িয়ে হাহাকারাচ্ছন্ন টুপটাপ বৃষ্টি নামে। তার ভাঁজ পড়া মুখমণ্ডলে সেই কুমারী চোখের দ্যুতি দেখতে পাই, অবুঝ সেই বালিকা চাহনী চুপি চুপি বলে, আমাকে ছেড়ে যেওনা। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলি। সে আমার অশান্ত হৃদয়ে ঢেলে দেয় শান্তির শুরা। রান্না করার অজুহাতে চোখের বৃষ্টি মুছে ফেলার জন্য আমার কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্য পালিয়ে যায়। আমি তার উড়ন্ত আঁচলের দিকে চেয়ে থাকি।
গোছলের পর প্রত্যেকটা দিনের মত আজও আমার প্যারালাইজড পা জুড়ে কবিরাজের অক্রিয় তেল খেলা করবে, আর নতুন দিনের স্বপ্ন বুকে প্রিয় অর্ধাঙ্গ আমার কানে কানে বলবে পুরোনো মুখস্ত কথা গুলি।
প্রত্যেকদিন একই আশার জালবুনে ইশারায় ডাকে প্রাণপ্রিয় মানুষটি ----
কিন্তু ওকে বোঝাতে পারিনা জীবনের সকল সুখ তো পাওয়া হয়ে গেছে ।
এবার বুঝি চলেই যাব যেখানে কোন দিন যেতে চাইনি।
আর কিছুই নেই
নেবার ও দেবার
বলবার অথবা শোনাবার।
শুধু গ্রিলের ডায়মন্ড আকৃতির ছায়াটা ঝাপসা হয়ে আসে আর হৃৎপিণ্ডটা রকেটের বেগে দৌড়ায় নিরাকার গন্তব্যে।
০১.০৯.২০১১ ইং
দক্ষিন কোরিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৫:২৪