somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট গল্প "রাবেয়া"

০৯ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

| রাবেয়া |

বিকাল পর্যন্ত বেশ মানুষজন ছিল এই বুড়িগঙ্গার তীরে, বিলাপ করতে করতে এদিক-ওদিক চষে বেড়িয়েছে লঞ্চডুবিতে নিখোঁজ মানুষদের খোজে। সবাই খুজেছে কোথাও কোনো লাশ ভেসে উঠছে কিনা, আর রাবেয়া কান পেতে আছে বসে আছে “কই ছিলা সারাদিন?? কততো খুজলাম তোমারে!” এই কথা শোনার আশায়। একটা বারের জন্য যদি কথাটা শুনতো, কোনো উত্তর না দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখতো, আর মনে আসা সবগুলো উল্টা-পাল্টা ভয়কে কান্নার চিৎকারে নদীর ঐ পাড়ে পাঠিয়ে দিতো।

ছোট নৌকাটি ছোট ছোট ঢেউয়ের তালে বুকের ছটফটগুলোর মতো সারাদিন দুলছে। নোঙর করা একটা নৌকায় সকাল থেকে টানা ১৬ ঘন্টা উপোস বসে আছে বছর দুয়েকের বধু উপাধি পাওয়া মেয়েটি। গত রোজায় এর চেয়েও কম সময় উপোস ছিল, তখন বেলা গড়িয়ে আসার সাথে সাথে তেষ্টা লাগতো, অথচ আজ সারাদিন ক্ষুধা-তৃষ্ণার কোনোও খেয়াল নেই! চোখের সামনে এক এক করে কতগুলো লাশ উঠে এলো। অথচ তাজা এই মানুষগুলো আজ সকালে তার পাশেই বসা ছিল; কেউ চা খাচ্ছিল, কেউ ছিল ফোন নিয়ে ব্যস্ত, কেউ স্বামীর সাথে কথা বলতে গিয়ে আত্মীয়র পরিচয়ও বের হয়ে এসেছিল। সবাই নিশ্চই ভেবে রেখেছিল লঞ্চ থেকে নেমে কোথায় যাবে। সকাল ৯টার নির্ধারিত সময়েই লঞ্চটা অন্তিম গন্তব্যে পৌছেছে, কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হওয়ার পরও স্বেচ্ছায় কেউ লঞ্চ থেকে বের হলো না! শেষ পর্যন্ত ডুবুরীকে গিয়ে লঞ্চ থেকে টেনে তুলে আনতে হলো সবাইকে। কি সতেজ শরীর! দেখে মনে হচ্ছিল ভর দুপুরের অনিচ্ছার বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে আছে। লঞ্চের সেই প্রানবন্ত মানুষগুলো একে একে প্রায় সবাই ডাঙায় এসে শুয়েই রইল, কোনো কথাই বললো না। ওদের সব কথা কি লঞ্চেই শেষ হয়ে গিয়েছে? কিছু জানতেও চাইল না, “কি হয়েছে আমাদের সাথে? কেনো মাথায় চাদর ঢাকা?”

জামা-কাপড়ের ছোট ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে স্বামীকে নারিকেলের ভারী ব্যাগটা দিয়ে যখন লঞ্চঘাটের দিকে রওনা হয়েছিল, তখন সূর্য কেবলমাত্র উকি দিচ্ছিল, আর এখন চাঁদও হাই তুলছে। দুপুরের পর আর কোনো লাশের দেখা মেলেনি, সন্ধ্যায় অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে বিষন্ন মানুষগুলো নদীতীর শূন্য রেখে চলে যায়। তারপর রাত গভীর হবার সাথে সাথে বুড়িগঙ্গার দু’কূলও ঘুমিয়ে পড়েছে। অবিরত ছলাৎ ছলাৎ শব্দের নীস্তব্ধতার মাঝে শুধু পানি আর পাড়ের ধাক্কা-ধাক্কির শব্দ কানে বাজছে। মাঝে মাঝে আবছা আলোয় কালো জাহাজগুলোর শ’ শ’ শব্দ কানে বাজে, হয়তো জাগিয়ে রাখতে চাইছে রাবেয়াকে। “ও আল্লা, কততো বড় নদী!” রাবেয়ার এমন অবাক হওয়া দেখে স্বামী বলেছিল, “এর চেয়েও কততো বিশাল নদী আছে! একদিন তোমারে ঘুরতে নিয়া যামু।” হয়তো সেই বিশাল নদীর তালাশে গিয়েছে মানুষটা, হয়তো বউয়ের অবাক চেহারাটা আরেকবার দেখার তর সয় নাই তার। আগের রাতে ফোনে বোনকে বলে রেখেছিল দুপুরের আগেই অসুস্থ বোনজামাইকে দেখতে চলে আসবে। রাবেয়ার ফোন নাম্বারটা মুখস্থ নাই, থাকলে অন্তত জানিয়ে দিতে পারতো, “দুইজনই ঘাটে পৌছেছি, হয়তো দুই ভিন্ন ঘাটে…”

শরীরটা খুব ব্যাথা করছে, সারাদিনের ক্লান্তির ভার নিয়ে একটা সময় মনের অজান্তেই হেলে পড়লো রাবেয়া, তবুও চোখ খোলা; স্বামীকে পাশে শুয়ে দেখার অভ্যাস কি আর একদিনে যায়? মৃদু বাতাসে নৌকা এখনও ছটফট করে দুলছে। পাটাতনে মাথা ঠেকতেই দেখলো একটা পানির বোতল সাথে বিস্কিটের প্যাকেট রাখা। ভীড়ের মাঝে কিছু মানুষও থাকে মাঝে মাঝে। এই নদীর বুকে কি আর কোনোদিন পানির তেষ্টা লাগবে রাবেয়ার? ধাক্কা দিয়ে বোতলটা দূরে ছুড়লো। ক্ষুধায় মাথা ঘুরাচ্ছে, বাধ্য হয়ে বিস্কিটের প্যাকেট হাতে নিলো, খুব কষ্টে প্যাকেটটি খুললো। বিস্কিট হাতে নিতেই মনে পড়লো শেষ চায়ের সাথে বিস্কিট ভিজিয়ে খেয়েছিলো মানুষটা। বুকটা তখনই ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো, কানফাটা আর্তনাদে বুড়িগঙ্গার তীর কেঁপে উঠল! সে চিৎকারে বুঝি মেঘেরও হুঁশ হলো; গুড়ি বৃষ্টি এসে নৌকার পাটাতনে জমা অশ্রু বিন্দুকে সাথে নিয়ে নদীর অতলে শুয়ে থাকা জীবন-তৃষ্ণার্ত মানুষটিকে আরেকটু জলের ঝাপটা দিতে লাগলো। যদি ঘুম ভাঙে, যদি শেষ একবার দেখা দিয়ে যেতে পারে তারই বুকের সামান্য ওপরে আছড়ে পড়ে থাকা এই অভাগীকে!

নাহ, শক্তি আর কুলালো না, চোখগুলোকে আর জাগিয়ে রাখতে পারলো না, অচেতন হয়ে পড়লো রাবেয়া। লজ্জায় বৃষ্টিও থেমে গেলো। “কি, আর বিস্কুট খাইবা না?” রাবেয়া বিস্কিটের প্যাকেট হাতে ধরে জিজ্ঞেস করলো স্বামীকে। “খামুতো, যদি তোমার হাতে খাওয়াও” ভরা লঞ্চের মধ্যে স্বামীর এই বেলাজ উত্তর শুনে ঘোমটার আড়ালে লজ্জায় লাল হয়ে যায় টুকটুকে বউ, স্বামীও ক্ষণিকের সেই লজ্জাকে উঁকি দিয়ে দেখতে ভুল করলো না। নৌকার বাইরে ঝুলে থাকা রাবেয়ার হাত থেকে বিস্কিটের খোলা প্যাকেটটা পানিতে পড়ে গেলো। ভেজা বিস্কিটগুলো একে একে সব ডুবে গেলো।

অঘোরে ঘুমাচ্ছে রাবেয়া। অনেক দিন পর বিছানার একটা পাশ খালি, অনেক দিন পর নিজ বালিশ ছেড়ে স্বামীর বুকে এসে মাথা রাখতে পারেনি, তবুও চোখে রাজ্যের ঘুম, সে রাজ্যে নিশ্চই মানুষটা কাত হয়ে শুয়ে সারা রাত গল্প করবে বউয়ের সাথে। কালতো আবার ভোর হবে, ঘুম যদি ভাঙে, প্রথম প্রশ্ন কি জাগবে রাবেয়ার মনে? বুকের ছটফটগুলোর তালে তালে নৌকাটা এখনও দুলছে, অগভীরে অচেতন একজনের শরীরও দুলছে।

| ফখরুল আমান ফয়সাল |

(. . . লঞ্চ দূর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানানোর কোনো ভাষা আমার নেই, তাদের দুঃখের ১ অংশের ভার বহনের ক্ষমতাও কারো নেই। শুধু দোয়া করছি এই দুঃসময় দ্রুত শেষ হোক, কামনা করছি প্রতিটি আত্মার মাগফিরাতের। কাল্পনিক গল্প, কারো সাথে যেনো কখনো মিলে না যায়।)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ২:০২
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×