বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডে বসবাসকারী সব জাতি-গোষ্ঠীর কাছে পহেলা বৈশাখ নববর্ষের দিন। বাঙালি, চাকমা, মারমা সবার কাছে এ দিনটি আসে উৎসবের আমেজে। বাঙালিত্বের সঙ্গে রয়েছে এ দেশের দুই প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী মুসলমান ও হিন্দুদের প্রাণের সম্পর্ক। বাঙালা ও বাঙালি শব্দ দুটি মুসলিম শাসনামলেরই অবদান। ইলিয়াস শাহের আমলে এ দেশ 'বাঙালা' নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলা ভাষার চর্চা শুরু হয় আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে।
বাংলা সনও মুসলিম শাসনের অবদান। এ সনের সঙ্গে রয়েছে হিজরির সম্পর্ক। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন জানিয়েছেন একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। একজন হিন্দু পূজারি যখন নতুন বছরকে আহ্বান জানিয়ে পূজা করেন তার বোধ হয় জানা থাকে না এ পূজা উপলক্ষে তিনি স্মরণ করছেন হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মদিনা যাত্রার পবিত্র দিনের কথা। এক সময় এ দেশের কাঠমোল্লারা প্রচার করত, বাংলা হলো হিন্দুয়ানি সন। পহেলা বৈশাখ পালনকে তারা হিন্দু সংস্কৃতি বলে নাক সিটকাতো। কাঠমোল্লাদের চেয়েও এক কাঠি সরেস হরকাতুল জিহাদের দুর্বৃত্তরা। তারা রমনার বটমূলে রিমোট কন্ট্রোল বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল পহেলা বৈশাখ ইসলামবিরোধী এ কল্পিত অভিযোগ তুলে।
অমর্ত্য সেন বাংলা সনের সঙ্গে রাসূল (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার যে সম্পর্ক টেনেছেন তা কোনো কল্পকথা নয়। সম্রাট আকবরের আমলে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে চালু হয় নতুন সন। হিজরি ৯৬৩ সনে 'তারিখ ইলাহি' নামের যে ক্যালেন্ডার বা দিনপঞ্জি চালু হয় তা কালক্রমে বাংলা সন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ওই বছরটিকে তারিখ ইলাহির ৯৬৩ সন হিসেবে ধরা হয়। হিজরি সন গড়ে উঠেছে চান্দ্রবর্ষের ভিত্তিতে। অন্যদিকে তারিখ ইলাহি বা আজকের বাংলা সনের ভিত্তি হলো সৌরবর্ষ। চন্দ্রবর্ষের চেয়ে সৌরবর্ষ অন্তত ১০ দিন বড়। যে কারণে গত ৪৫৬ বছরে হিজরির সঙ্গে বাংলা সনের ১৬ বছর পার্থক্য গড়ে উঠেছে।
বাংলা সন গড়ে উঠেছে পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর হিজরতকে ভিত্তি করে। বাংলা ভাষী মুসলমানদের সঙ্গে এ সনের প্রাণের বন্ধন সহজেই অনুমেয়। বাঙালি হিন্দুর পূজা-পার্বণ, বিয়ে ও অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানে বাংলা সন তিথি-নক্ষত্রের যোগাযোগ সবার জানা। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও তারা এ সনকে আত্তীকরণ করেছে। এ দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে বাংলা সন একাকার হয়েছে একইভাবে।
পহেলা বৈশাখ বা বাংলা সনকে উপলক্ষ করে জাতীয় ঐক্যের ও সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির যে বন্ধন গড়ে উঠেছে তা বাংলাদেশের মানুষের এক অমূল্য সম্পদ। বাংলাদেশকে সাধারণভাবে বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভাবা হয়। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ জাতি-রাষ্ট্রের ঐক্যের সুরকে পেঁৗছে দিয়েছে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-প্রকৃতিপূজারি নির্বিশেষে সব বাংলাদেশির মাঝে। পহেলা বৈশাখকে অস্বীকার করা বাংলাদেশ ও বাঙালিত্বকে অস্বীকার করার নামান্তর। যাদের নাড়ি পিন্ডি-ইসলামাবাদ কিংবা অন্য কোথাও পোঁতা তাদের পক্ষেই এটি সম্ভব। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তাদের উদ্দেশেই হয়তো ধিক্কার দিয়েছেন_ 'সে সবেত কাহার জনম নির্ণয় ন' জানি'।
দুই
পহেলা বৈশাখ বাঙালির নববর্ষ। বর্ষবরণের উৎসবে মেতেছে বাঙালিরা। মানব সমাজে বর্ষবরণ উৎসব কখন থেকে চালু হয়েছে তা স্পষ্ট করে বলার অবকাশ নেই। অনুমান করা হয় চার হাজার বছর আগে ব্যাবিলনে বর্ষবরণ উৎসবের প্রচলন। নববর্ষে মানুষ আশাবাদী হয়। অতীতের ব্যর্থতা ঝেড়ে নতুনভাবে জীবন গড়ার শপথ নেয়। জাতীয়ভাবেও আমরা এটিকে আশাবাদী হওয়ার দিন হিসেবে বেছে নিতে পারি। এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে আত্দবিশ্বাস প্রয়োজন তা আহরণ করতে পারি আমাদের সোনালি ইতিহাস ঘেঁটে।
সন্দেহ নেই বাঙালিরা এ মুহূর্তে এক পিছিয়ে পড়া জাতি। বাংলাদেশ এখনো এক স্বল্প আয়ের দেশ। তবে ইতিহাস বলে বাঙালিরা এক সময় ছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী জাতি। বিদেশি শাসন ও শোষণ বাংলাদেশকে এ হতশ্রী অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। আবারও ফিরতে চাই অমর্ত্য সেনের কাছে। এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঙালি সম্মেলনে তার বক্তৃতার দিকে দৃষ্টি দিতে চাই। তিনি বলেছেন 'অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তার লেখায় সেই যুগে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে ধরেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে উৎপাদন এবং বাণিজ্যভিত্তিক যোগাযোগ রাখতে খুবই উদগ্রীব ছিলেন সে সময়কার পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি ইংরেজ, ডেনিস ও ইউরোপীয় দেশগুলো। ১৭০৩ সালে প্রসিদ্ধ মানচিত্র শিল্পী থর্নটন খুব জোর দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন সেদিনের বাংলাদেশি মানচিত্র, সেটিকে বলেছিলেন 'দি রিচ কিংডম অব বেঙ্গল' অর্থাৎ ধনী বাংলাদেশের ছবি।'
১৭৫৭ সালে ইংরেজরা এ দেশ দখল করেছিল সুশাসন নিশ্চিত করতে। সে সুশাসনে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়। অনাহারে মারা যায় এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। এ দেশের বস্ত্রশিল্প ধ্বংস করতে তন্তুবায়ীদের হাতের আঙ্গুল কেটে নেওয়া হয়। তাদের সুশাসনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পরিণত হয় অভাবী দেশে। আর গড়ে উঠেছিল লন্ডনের সমৃদ্ধি। এমনকি আজ বিশ্বের সেরা সমৃদ্ধ যে দেশ আমেরিকা তার রাজধানী ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল হিল গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের টাকায়। এ দেশে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। গভর্নর জেনারেল পদে আসীন লর্ড কর্নওয়ালিস। তিনি ছিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপকার। এই জংলি ব্যবস্থা প্রণয়নে তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন টমাস ল নামের এক ইংরেজ সিভিলিয়ান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের আত্দীয় ছিলেন তিনি। টমাস ল এ দেশে দায়িত্ব পালনকালে সীমাহীন লুটপাটের আশ্রয় নেন। দেশীয় রাজা, জমিদার এমনকি সাধারণ প্রজাদের বিপদে ফেলে উৎকোচ আদায় করতেন তিনি। এভাবেই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে সমর্থ হন টমাস ল। দেশে ফেরার সময় তিনি বিপুল পরিমাণ সোনা-হীরা ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে যান। পথে এডেন বন্দরে ভিড়ে তাদের জাহাজ। সেখানে টমাস ল শুনতে পান বাংলাদেশে কর্মরত ইংরেজ অফিসারদের অর্জিত অবৈধ অর্থ সম্পর্কে বিলেতে তদন্ত শুরু হয়েছে। কাউকে কাউকে শাস্তিও পেতে হয়েছে। টমাস ল প্রমাদ গোনেন। তিনি দেশে ফেরার বদলে নেমে যান এডেন বন্দরে। ওঠেন আমেরিকাগামী এক জাহাজে। আজ যেখানে ক্যাপিটাল হিল সে জায়গাটি তার পছন্দ হয়। সেখানেই বসতি গড়ে তোলেন টমাস ল। একটি চিনির কলও তিনি তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে ক্যাপিটাল হিলের বিশাল ভূসম্পত্তি তিনি মার্কিন সরকারের কাছে বিক্রি করেন। সেখানেই স্থাপিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী।
তিন
আগেই বলেছি বাংলাদেশ এখন স্বল্প আয়ের দেশ। যে দেশটি ছিল বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি_ তারা এখন অনেকের চেয়ে পিছিয়ে। দেশের মন্দ রাজনীতি নিয়ে হতাশা থাকলেও অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী হওয়ার অনেক কিছুই ঘটছে। দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। দুনিয়ার যেসব দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ তারই একটি। এদিক থেকে মাত্র ৪-৫টি দেশ বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী_ চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ইত্যাদি। বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার এ বিশ্বমন্দার দুঃসময়েও সাত শতাংশের কাছাকাছি। সোজা কথায়, প্রতি ৫ বছরে বাংলাদেশের সম্পদ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। ৪১ বছর আগে এ দেশে আলপিনও তৈরি হতো না। আজ বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ ইউরোপের জার্মানিসহ অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ফ্রিজ, মোটরসাইকেল রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। ইউরোপ আমেরিকায় যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে। যে দেশের লোকজন এক সময় বিদেশ থেকে আনা পুরান কাপড় পরে লজ্জা ঢাকতো সে দেশের পোশাক এখন বিশ্বজুড়ে রাজত্ব করছে। আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে আত্দপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য যে সোনালি ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছে তা স্বীকার করেছেন বিশ্বের অর্থনীতি গবেষকরা। বলা হচ্ছে, আর ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ আর্থিক সামর্থ্যের ক্ষেত্রে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইরান তো বটেই ইউরোপের এগিয়ে থাকা অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি থাকলেও জনসম্পদ বাংলাদেশকে এ সাফল্য এনে দেবে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, '২০৩০ সালের মধ্যে চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। আর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে ভারত। আমরা আছি এই দুই বিরাট জায়েন্টের মাঝখানে। এই দুই অর্থনৈতিক জায়ান্টের চাহিদা পূরণে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। ২০৩০ সালে কোথায় যাব তা ঠিক করতে না পারলে আমরা তলিয়ে যাব_ পথ হারা হব।'
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি বাংলাদেশকে সম্ভাবনার পাদপ্রদীপের নিচে নিয়ে এসেছে। আশা করা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সমুদ্র-সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তিও সম্ভব হবে। সমুদ্রের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সস্তা ও সহজে পণ্য পরিবহনে চাই_ সমুদ্র। আমরা সে সৌভাগ্যের অধিকারী। অজুত সম্ভাবনা বাংলাদেশের মানুষকে হাতছানি দিলেও এটি শেষ কথা নয়। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য দরকার নষ্ট রাজনীতির অবসান। রাজনীতির নামে হানাহানি ও লুটপাটের ইতি ঘটাতে হবে। কালো বিড়াল ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেরাই কালো বিড়াল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। রাজনীতিকে রাজপথ থেকে সংসদমুখী করাও জরুরি। বিরোধী দলকে আস্থায় এনে সরকার পরিচালনার ঔদার্যও ক্ষমতাসীনদের অর্জন করতে হবে।
সুত্রঃ Click This Link