somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং আমার বিদ্বেষী বাবা

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"সেদিন খালেক এত সাহস পেয়েছিল,কারণ সে ছিল মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশ স্বাধীন করছিল। আর আমার বাবা-দাদা অসহায় ছিল,কারণ তারা দেশ স্বাধীন করছিল না!"

হাসপাতাল আর জেল,এই দুই স্থান আমার অপছন্দের।জেলখানায় আমার অতিপ্রিয় কারো সাথে কথা বলবো আর মাঝখানে থাকবে লোহার বেড়া; আমি দিব্যি আরামে চলছি-ফিরছি, আর অন্য মানুষ টা একদল লোকের সাথে হাসপাতালে পরে আছে, ভাবতেই খারাপ লাগে।

আমি এখন ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে,আমার অতি অপ্রিয় বাবার কাছে জানতে এসেছি, তিনি কেন আমাদের এলাকার গুনি মুক্তিযোদ্ধাকে মৃত্যুর পর লাথি মারলেন?

হ্যা,গতকাল আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল খালেক মারা গিয়েছেন।আমার বাবা তার মুখে অতি আক্রোশে তিনটা লাথি মেরেছেন।মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অতি সংবেদনশীল আমি খুব কষ্ট পেয়েছি!যার জন্য এই এলাকা-দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমার বাবা তাকেই..... ছি:ছি:
আমি কিছুতেই ঘটনাটা মেনে নিতে পারছিলাম না।

এ পপরিপ্রেক্ষিতেই আমার বড় ফুপি একটা কাহিনী বলছিলেন,
আমি সেভাবেই লিখে দিলাম।

:বড়াফা,বড়াফা,বানপাড়ের ক্ষেতে মাছ খলখল করতাছে।চল যাই,
:নারে,আব্বায় বাড়ির বাইরে যাইতে নিষেধ করেছে।

:তুই নামিস না,তুই খালই ধইরা পাড়ে খাড়ায়া থাকবি।
:না, যামু না।

:চল যাই,আব্বারে কবি,আমারে গোসল করাইতে গেছিস!
:না,পরে আবার মারবো!

তখনই বুটের আওয়াজ তুলে উঠানে প্রবেশ করলো একদল খাকি পোশাকধারী।
:খান ছাব,ঘাড়পে হে?ও খান ছাব!

কিশোর সাত্তার উত্তর দিলো।
:আব্বায় নামাজ পড়ে।

হুরমুছ আলী খান এই প্রথম নামাজ ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এলেন।
:জ্বি, আমি হুরমুছ আলী খান!
:আপকো হামারা জারুরাত হে,হামলোগকে ছাথ জানা পারেগা!

হুরমুছ আলী খান পলাশপাড়া গ্রামের সম্মানিত লোক,বড় কাপড়-পাট ব্যবসায়ী। তাকে খাকি পোশাকি পাকিস্তানি সেনারা ডেকে নিয়েছিল।

তিনি ফিরে এসেছিলেন। তার প্রতি নির্দেশ ছিল, যাতে কোন মুক্তি এই এলাকায় থাকে তাদের জানাতে হবে!

ঠিক সেদিন রাতেই একজন এসেছিল তাদের বাসায়, খালেক!
:কাহা, বাড়িত আছেন?
:খালেক!

:আইন্নেরে ধইরা নিছিলো নাহি?
:ডেকে নিয়েছিল,তখনি ফিরে আসছি।

:মাইর টাইর দেয় নাই!
:কি যে বল!

:না,আইন্নের বাইত নাহি রাইতে কারা খাইতে আহে!হাছানি?
:না,কই যে কি শুনো!

:আইন্নের কাছে একটা কথা আছিল!
:থাক, আর বলতে হবে না,আমি জানি।

:বকুলরে বিয়া দিবেন না আমার লগে!
:না, দিমু না!আমার মেয়ে কলেজে পড়ে,ওরে আমি ডাক্তার বানাবো।

:হা হা হা,বিয়া না দিলে,পাকিগো সব কইয়া দিমু!
হুরমুছ আলী খান মাথা নিচু করে ছিলেন।

হুরমুছ আলী খান পলাশপাড়ার সবচেয়ে শিক্ষিত লোক।তার ৩ মেয়ে;বকুল,শিউলি, পারভিন, এক ছেলে;ছাত্তার সবার ছোট।খালেক বাউন্ডুলে ছেলে,বকুলকে বিয়ে করতে চায়।এতদিন নিজে বলতে পারেনি,এলাকার সবাইকে বলে বেড়িয়েছে।আজ সুযোগ পেয়ে.....
তার ভাই ছায়েদ আলী খান এলাকার চেয়ারম্যান।তাই এতদিন ভয়ে বলেনি।

সেদিন রাতেও ৫-৮ জনের একটা দল সেই বাড়িতে এসেছিল।

হুরমুছ আলী খান,ছায়েদ আলী খান দুজনেই হাত জোড় করে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল,"বাবারা আমাদের ক্ষমা কর,আমাদের বড় মেয়েছেলে আছে।তোমরা আর এই বাড়ি এসো না।"

দলের লোকগুলো খুব অবাক হয়েছিল,আপসহীন এই লোক দুটোর হঠাৎ কি হয়ে গেল?সেদিন থেকে সে দলটিকে আর পলাশপাড়ায় দেখা না গেলেও,খালেকের মুক্তি বাহিনী ঠিকই এলাকায় ছিল!

খালেকের দল এলাকাকে স্বাধীন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।

কার মুরগি-খাসি জবরদস্ত,কার ঘরে উর্বশী মেয়ে আছে সব তার মুখস্থ ছিল।সে দেশ স্বাধীন করছে,এই জন্যও তার খাতির যত্ন করা উচিত সবার।

আর সবাই করতোও।যেমন লতিফ,কামাল, ইনসান সাহেবের মেয়েদের তার সেবায় নিযুক্ত করা হয়েছিল।প্রথমে একটু আপত্তি করলেও,খালেকের হাতে বন্দুক আর একটা গ্রেনেড দেখে সবাই চুপ করে গিয়েছিল।

হ্যা,ভুলেই গিয়েছিলাম। খালেক ট্রেনিং নিয়ে, সেখান থেকে এগুলা পেয়েছিল।সেই বন্দুক-গ্রেনেডের ভয়েই হোক,আর সে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে এই কারনেই হোক সবাই তাকে খুব ভয় করতো।

কিন্তু হুরমুজ আলী খান,ছায়েদ আলী খানের বাড়ির তিনটি মেয়ের কাছে সে কোন ভাবেই যেতে পারছিল না।খান সাহেব এমন করে তাকায় ভয়ে খালেকের আত্মা খাচা ছেড়ে পালাতে চায়।

সেদিন খালেক তার সাঙ্গপাঙ্গকে নিয়ে খান সাহেবের বাড়ি গেল।তার মাথায় দেশের পতাকা, কাধে বন্দুক,হাতে গ্রেনেড। খানের বেটা আজ ভয় পাবেই।

:কাহা বাইত আছেননি!
সে জোরে চিৎকার করে ডাকলো।
ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো, হাফপ্যান্ট পরা ছাত্তার।তাকে পেছন থেকে বকুল কিছুতেই বের হতে দিতে চাচ্ছিল না।

:আব্বায় বাইত না।পরে আইহেন।
:তর বড় বইনে আছে।বকুউউল,বকুল আছে?

:আছে,বড়াফা অংক করে।কতা কইতো না।যানগা।
:তর বাপে আমার লগে বকুলের বিয়া দিছে।আমি বকুলরে নিতে আইছি।

:মিছা কতা।আমার বড়াফারে আমি বিয়া দিমু না।হেয় আমার লগেই থাকতো। আপনি যান!
:আইচ্ছা, তর লগেই থাহুক।আমি একটু দেহা কইরা যাই।

খালেক জোর করেই ঘরে ঢুকে গেল।ছোট ছাত্তারের কি জোর আছে,তাকে আটকাতে পারবে।খালেকের এক সঙ্গী তাকে জোর করে আটকে রাখলো।

ছাত্তারের মা, ছফিনা বেগম দা হাতে পথ আগলে দাঁড়ালেন।
খালেক দাঁত মুখ ভেঙচিয়ে বলল
:শাশুড়ি আম্মা; শিউলি, পারভিন,আর আপনে অন্য ঘরে যান।অহন একলগে চাইর জনরে আদর করতে পারমু না।সারাদিনে ২-৩ডারে পোয়াতি বানাইছি।আইজকা খালি বকুলরে একলাই.......

হুরমুজ আলী খান,আর ছায়েদ আলী খান সেদিন বকুলকে উদ্ধার করেছিল।ঘটনার সাক্ষী হিসেবে খালেকের হাতে আর গালে ছিল কাটা দাগ। দায়ের কোপ!

সবাই জানতো দাগ দুটা সম্মুখ যুদ্ধ করতে গিয়ে আঘাত পেয়েছিল।আমিও তাই জানতাম!

কিছুদিন পরেই যুদ্ধ শেষ হয়েছিল।খালেক সরকার স্বীকৃত বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা হয়েগেল।
লতিফ,কামাল, ইনসান সাহেব সবাই সব ভুলে গেল।এলাকায় তার সম্মান বেড়ে গেল।মিটিং, সভা-সেমিনারে আব্দুল খালেক প্রধান অতিথি।মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার কদর বেড়ে গেল।
মানুষ কত তাড়াতাড়ি সব ভুলে যায়, তাই না?

হ্যা,কঠিন দাগ ছাত্তার,ছায়েদ খান, আর হুরমুজ খানের মনেও পরেছিল।ছাত্তারের মনের দাগ গতকাল হয়তো একটু মুছে গেল।

সেদিনের ছোট্ট ছাত্তারই আমার আব্বা।

আর হ্যা,আমি আর আব্বার সাথে দেখা করব না।তিনি এখনো আমার অতি অপ্রিয় মানুষ। তিনি প্রতিবার তার মুক্তিযুদ্ধ বিদ্বেষ নিয়ে, আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন।

বকুল ফুপির চোখে-মুখে আমি আজও সেদিনের আতঙ্কটা দেখতে পেলাম।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×